রেকর্ড ৫১৭ সরকারি কর্মকর্তা এখন ওএসডি, সেবাপ্রদান ছাড়াই বেতন-ভাতায় যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা

অন্তর্বর্তী সরকার এপর্যন্ত রেকর্ড ৫১৭ জনকে অফিসার বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) করেছে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের রয়েছেন ১২১ জন। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে এসব ওএসডি করা হয়েছে। ফলে এসব কর্মকর্তারা নিস্ক্রিয় থাকলেও— তাঁদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি বাবদ সরকারি তহবিল থেকেই মেটাতে হচ্ছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ওএসডিতে পাঠানোর এটিই সর্বোচ্চ সংখ্যা। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে, আওয়ামী লীগের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত কর্মকর্তাদের থেকে জনপ্রশাসন মুক্ত করতে প্রচুর কর্মকর্তাকে বদলী, ওএসডি, বাধ্যতামুলক অবসর দেওয়া হয়। বাতিল করা হয় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ।
তাঁরা বলছেন, ওএসডিতে থাকা কর্মকর্তারা সরাসরি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কোনো শাখার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন না। সুনির্দিষ্ট বসার জায়গা বা দপ্তর নেই তাদের। ফলে কোনো কাজ করেন না তারা। অফিসেও উপস্থিত হন কম। বলা যায় চাকরিতে থেকেও এক ধরনের বেকার জীবন তাদের। কিন্তু তারা বেতন, ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা পান সময়মতো।
জনপ্রশাসনে ওএসডিকে এক ধরনের শাস্তিমুলক বদলী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে পদোন্নতিজনিত কারণে, প্রশিক্ষণ, লিয়েন, প্রশিক্ষণ ফেরত, প্রেষণে থাকার কারণেও কিছু কর্মকর্তা ওএসডি থাকেন। তবে প্রশাসনিক কারণে যেসব কর্মকর্তাকে ওএসডি হিসেবে বদলী করা হয়, সেটি মূলত শাস্তি। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্তকালীন সময়টাতেও তাঁকে ওএসডি করা যায়।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্তমানে এটি রাজনৈতিক কারণে বা অন্য উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে, যা একটি অপসংস্কৃতি। এতে দক্ষ কর্মকর্তারা বেকার বসে থাকছেন। তাদের থেকে সরকার বা জনসাধারণ কোনো সেবা পাচ্ছে না। অন্যদিকে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ মাসে মাসে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।
ওএসডি থাকা একজন সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আমাকে কেনো ওএসডি করা হয়েছে – সেটা কেউ আমাকে জানায়নি। এবিষয়ে সাধারণ ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমি নাকি আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কিন্তু, আমি তা মনে করি না।"
তিনি দাবি করেন, "আমাকে যখন যেখানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি সেটা যথাযথভাবে পালন করেছি। আমি কখনও তদবির করে কোনো পোস্টিং নিইনি। একজন গণকর্মচারী যখন যে সরকার থাকে, তাদের অধীনে কাজ করে। সেখানে কর্মীর কিছু করার থাকে না।"
"ওএসডি, বাধ্যতামুলক অবসরে পাঠানো কোনো সিদ্ধান্তই যৌক্তিকভাবে হচ্ছে না"- যোগ করেন তিনি।
সাবেক সচিব আবু আলম মো: শহিদ খান এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, ওএসডি একটি ডাম্পিং ব্যবস্থা। জনগণের অর্থের অপচয়। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থাকলে– সেটি আমলে নিয়ে তদন্ত করা যেতে পারে, বিচার হতে পারে। কিন্তু, ওএসডি করে ফেলে রেখে কোনো সমাধান হয় না।
"একইভাবে কারোর দক্ষতার ঘাটতি থাকলে সে যে বিষয়ে দক্ষ সেখানে কাজ করানো যেতে পারে। কিন্তু ওএসডি কোনো সমাধান নয়"- মন্তব্য করেন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে ওএসডি
এদিকে নিরপেক্ষ জনপ্রশাসন নিশ্চিত করার জন্য, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে ওএসডি না করার সুপারিশ করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। গত ২৫ জানুয়ারি এই কমিশন প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
কমিশন তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, কোনো ওএসডি কর্মকর্তাকে কাজ না দিয়ে বেতন-ভাতা দেওয়ার পরিবর্তে তাদের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষকতা বা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সাময়িকভাবে পদায়ন করা যেতে পারে।
তবু এই চর্চা অব্যাহত রয়েছে, গত ২০ ফেব্রুয়ারিতেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে কর্মরত যুগ্ম সচিব ও সমপর্যায়ের পদে থাকা প্রশাসনের ৩৩ কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা ওএসডি করে বদলী করেছে সরকার। এসব কর্মকর্তা ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার আগে একই কারণে ১২ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছিল।
এছাড়া গত ২৫ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ ডিআইজি, অতিরিক্ত ডিআইজি পদ মর্যাদার ৮২ জন কর্মকর্তাকে ওএসডি করেছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তারাও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপার ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন।
সাবেক সচিব আবু আলম মো: শহিদ খান বলেন, ওএসডির পাশাপাশি চাকরির বয়স ২৫ বছর হলে সরকার তাকে বাধ্যতামুলক অবসরে পাঠাতে পারবে, সংস্কার কমিশন এই আইন রহিত করে বাধ্যতামুলক অবসর ব্যবস্থা বন্ধ করার সুপারিশ করেছে। এসডি না করারও সুপারিশ করেছে। কিন্তু সরকার সেটা করেই যাচ্ছে। তাহলে সংস্কার কমিশন করার কি দরকার ছিল?
তাঁর মতে, "বর্তমান সরকারও যদি ফ্যাসিস্ট সরকারের মতো আচরণ করে, তাহলে বিগত স্বৈরাচারী সরকার আর এই সরকারের মতো পার্থক্য কোথায় থাকল।"
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,পদোন্নতি, প্রশিক্ষণ, লিয়েন, প্রশিক্ষণ ফেরত, প্রেষণের বাইরে যে ওএসডি হয়, সেগুলো মুলত সরকারের চাওয়ায় বা রাজনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। "তবে গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে দু-একটি কেস থাকে। কিন্তু, যেসব ওএসডি প্রশাসনিক কারণে করা হয়েছে বলা হয়, তার সিংহভাগ হয় সরকারের ইচ্ছায়।"
ওএসডিতে সরকারের ব্যয়
২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী, সচিবদের মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা, আর সিনিয়র সচিবরা আরও ৫ হাজার টাকা বেশি পান।
অতিরিক্ত সচিবদের মূল বেতন ৬৬ হাজার থেকে ৭৬ হাজার ৪৯০ টাকার মধ্যে। যুগ্ম সচিবরা সাড়ে ৫৬ হাজার টাকা থেকে শুরু কওরে ৭৪ হাজার ৪০০ টাকা পর্যন্ত পান। উপ-সচিবদের মৌলিক বেতন ৫০ হাজার থেকে ৭১ হাজার ২০০ টাকা।
এছাড়া, বাড়িভাড়ার ৬০ শতাংশ ভাতা এবং ১,৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতাও পান তাঁরা।
২০১৩ সালে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দুটি পর্যায়ে, ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওএসডি করা কর্মকর্তাদের একটি তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয়। ওই সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এই ৯ বছরে ৩,৬০৫ জনকে ওএসডি করা হয়। এসময়ে তাদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাবদ সরকারের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ১৫১ কোটি টাকা।
২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সময়ে ওএসডি কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ১,৬১৬ জন। তাঁদের পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে ৪৭.৬৬ কোটি টাকা।
এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০০৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওএসডি সংক্রান্ত বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই সময়ে ১,৯৮৯ কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়। এসময়ে তাঁদের পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছিল মোট ১০৩.২৫ কোটি টাকা।
ওএসডি ৫১৭ জন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১১ মার্চ তারিখ পর্যন্ত জনপ্রশাসনে মোট ৫১৭ কর্মকর্তা ওএসডি আছেন। এদের মধ্যে সিনিয়র সচিব ও সচিব মিলিয়ে ১৩ জন ওএসডি রয়েছেন। জনপ্রশাসনে এটিই সর্বোচ্চ পদ। মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, একসাথে এতজন সচিবের ওএসডি থাকা আগে কখনও ঘটেনি।
এছাড়া গ্রেড-১ পদের দুই জন, অতিরিক্ত সচিব ৩৩ জন ওএসডি। যুগ্মসচিব ওএসডি আছেন ৭৬ জন। আর উপসচিব ১৩৬ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব ১৫৫ জন, সহকারী সচিব ৯৪ জন, সিনিয়র সহকারী প্রধান ৮ জন ওএসডি আছেন।
এদের মধ্যে ৫ আগস্টের পরে প্রশাসনিক কারণে ওএসডি আছেন ১২১ জন কর্মকর্তা। এদের মধ্যে আছেন সিনিয়র সচিব ও সচিব ১৩ জন, গ্রেড-১ এর দুজন, অতিরিক্ত সচিব ২৫ জন, যুগ্মসচিব ৪৫ জন, উপসচিব ২১ জন, সিনিয়র সহকারী সচিব ৪ জন, সহকারী সচিব ৩ জন, সিনিয়র সহকারী প্রধান ৮ জন। এর বাইরে অন্যরা পদোন্নতিজনিত, প্রশিক্ষণ, লিয়েন, প্রশিক্ষণ ফেরত, প্রেষণে থাকার কারণে ওএসডি রয়েছেন।
এরা সবাই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বাইরে অন্যান্য ক্যাডারেও— এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। যাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরে সংযুক্ত হিসেবে উল্লেখ করে বদলী করা হয়েছে। এ ধরনের কর্মকর্তার সংখ্যাও কমপক্ষে দুই শতাধিক।