একটি অকার্যকরী ‘না ভোট’ ব্যবস্থা পুনর্বহাল করছে নির্বাচন কমিশন

ভালো খবর হলো, নির্বাচন কমিশন আসন্ন নির্বাচনে 'না ভোট' ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে চায়। কিন্তু খারাপ খবর হলো, এই 'না ভোট'-এর সুযোগ শুধু সেইসব আসনে দেওয়া হবে, যেখানে একক প্রার্থী থাকবেন।
সাধারণত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে কোনো আসনে একক প্রার্থী থাকা খুবই বিরল; একক প্রার্থী তখনই হয় যখন অন্য দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। এর সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, যখন বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল ভোট বর্জন করায় আওয়ামী লীগ ৩০০টির মধ্যে ১৫৩ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পায়।
নির্বাচন কমিশন 'না ভোট' ব্যবস্থা পুনরায় চালুর প্রস্তাব করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য হলো বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন থেকে রক্ষা পাওয়া।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ সোমবার বলেন, 'সব জায়গায় 'না ভোট' থাকবে না; যদি কোনো এলাকায় একমাত্র প্রার্থী থাকে, সেখানে 'না ভোট' থাকবে।'
আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাই কোনো এলাকায় একক প্রার্থী থাকা কঠিন, ফলে 'না ভোট' ব্যবস্থার কার্যকারিতা সীমিত হবে।
২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে চালু করা 'না ভোট' ব্যবস্থা তখন বেশ কার্যকর ছিল। ভোটাররা যদি কোনো প্রার্থী পছন্দ না করতেন, তাহলে তাদেরকে 'না' বলার অধিকার পেতেন। প্রতিটি নির্বাচনী কেন্দ্রে প্রতিটি ব্যালটে এই বিকল্পটি ছিল।
যদি কোনো নির্বাচনী এলাকায় 'সব প্রার্থীকে না' বা 'না ভোট' প্রতীক ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পায়, তাহলে সেখানে ফলাফল বাতিল হতো এবং পুনঃনির্বাচনের ব্যবস্থা হতো।
কিন্তু ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের দুই মাস পর ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনার সরকার ওই 'না ভোট' ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়।
'না ভোট' চালু করার সময় তখনকার প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা নেতৃত্বাধীন কমিশন কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। যদিও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সেটির জোর বিরোধিতা করেছিল।
কমিশন বলেছিল, 'না ভোট' দেওয়া একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। এটি ভোটারদের অতিরিক্ত একটি বিকল্প দেয়, যা মনোনীত প্রার্থী প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ করে দেয়।
বাংলাদেশ ছিল সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম, যেটি নাগরিকদের 'না' বলার অধিকার দিয়েছে। পরবর্তীতে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০১৩ সালের ঐতিহাসিক রায়ে এই অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০১৪ সালের নির্বাচনে 'না ভোট' অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ দেয়।
ভারতের নির্বাচন কমিশন ২০০৯ সালে 'না ভোট' চালুর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রাজনৈতিক দলের বাধার কারণে তা সম্ভব হয়নি।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছেন, 'না ভোট' ভোটের স্বচ্ছতা বাড়াবে এবং নির্বাচনে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে।
সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, 'গণতন্ত্রে ভোটারদের বাছাই করার স্বাধীনতা ও 'না' বলার অধিকার সমান গুরুত্ব বহন করে। ভোট দেওয়ার অধিকার এবং 'না' বলার অধিকার—দুটি মিলেই ভোটারের মৌলিক অধিকার।'
সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছেন, 'সুষ্ঠু শাসনের জন্য যোগ্য ও নৈতিক ব্যক্তিদের নির্বাচন জরুরি, যারা ইতিবাচক ভোটে জয়লাভ করে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে।'
অতএব 'না ভোট' বিকল্প হিসেবে থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো ভালো ও যোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিতে বাধ্য হবে। 'না' বলার সুযোগ না দিলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে বলে আদালত মনে করে।
বর্তমানে ফ্রান্স, স্পেন, কানাডা, আর্জেন্টিনা, গ্রিসসহ অনেক দেশের নির্বাচনে 'না ভোট' ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
বাংলাদেশে 'না ভোট' পুনর্বহালের দাবি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী সংস্কার আলোচনায় বহুবার উঠেছিল। কিন্তু কাজী রকিবুদ্দিন আহমেদ ও নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কোনো কমিশন এ বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ সীমিত হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে কথা হলেও, নির্বাচন কমিশন 'না ভোট' পুনর্বহাল থেকে বিরত রয়েছে। শুধু একক প্রার্থীর ক্ষেত্রে 'না ভোট' দেওয়ার প্রস্তাব এসেছে, যা নির্বাচনে তেমন প্রভাব ফেলবে না।
২০০৮ সালের কমিশন 'না ভোট' ব্যবস্থার জন্য তীব্র প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়েছিল, কিন্তু বর্তমান কমিশনের সিদ্ধান্ত নিয়ে তেমন কোনো বিরোধিতা নেই। তবুও তারা মূলত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন নিয়ে মনোযোগী, ভোটারদের 'না' বলার অধিকার বাড়াতে আগ্রহী নয়।
অন্যদিকে, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপে দেখা গেছে, গত অক্টোবর থেকে ভোটারদের মধ্যে অনিশ্চয়তার মাত্রা ৩৮ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৮ শতাংশের বেশি হয়েছে।
১১ আগস্ট প্রকাশিত 'জনগণের মতামত, অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা, জুলাই ২০২৫' শিরোনামের ওই জরিপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হলো, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামের জনপ্রিয়তা কমেছে, কিন্তু জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জনপ্রিয়তায় সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।