পুঁজিবাজারের অস্থিরতায় রেকর্ড ১,২১৩ কোটি টাকা লোকসান আইসিবির; এই প্রথম দেবে না লভ্যাংশ
 
একসময় উচ্চ মুনাফায় থাকা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অভ বাংলাদেশ (আইসিবি)—পুঁজিবাজারকে সহায়তা দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান—ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ১ হাজার কোটি টাকার বেশি রেকর্ড লোকসান দিয়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই ১ হাজার ২১৩.৮৬ কোটি টাকা লোকসানের পেছনে রয়েছে কয়েকটি দুর্বল ব্যাংক-বর্হিভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে (এনবিএফআই) ভুল বিনিয়োগের কারণে উচ্চ হারে প্রভিশনিং, গত এক বছরের অস্থির পুঁজিবাজারে পোর্টফোলিও কমে যাওয়া এবং পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য নেওয়া চড়া সুদের ব্যাংকঋণ।
এক বছরের এই মোট লোকসানের মধ্যে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই–মার্চ) ২৭৯ কোটি টাকা লোকসান দেখানোর পর চতুর্থ প্রান্তিকে, অর্থাৎ ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে জুনে আইসিবি লোকসান করেছে ৯৩৫ কোটি টাকা।
আইসিবির সূত্রমতে, এর আগেও পুঁজিবাজারের অস্থিরতার কারণে প্রতিষ্ঠানটি ত্রৈমাসিক লোকসানে পড়লেও এত বিপুল অঙ্কের বার্ষিক লোকসান এবারই প্রথম হলো।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ প্রান্তিকে পুঁজিবাজারে অস্থির পরিস্থিতি ছিল। এ সময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৩১২ পয়েন্ট হারায় এবং বাজার মূলধন—কোম্পানিগুলোর মোট শেয়ারমূল্য—১৪ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা কমে যায়।
এই বিপুল লোকসানের কারণে ১৯৭৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর এই প্রথম রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বড় লোকসান ও লভ্যাংশ না দেওয়ার ঘোষণার পর ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) আইসিবির প্রত্যেক শেয়ারের দাম ৬.১৪ শতাংশ কমে ৪২.৮০ টাকায় নেমে আসে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরেও প্রথম নয় মাসে ২৬৭ কোটি টাকা লোকসানে ছিল এই বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান। তা সত্ত্বেও অর্থবছর শেষে ৩২.৬৮ কোটি টাকা মুনাফা করে এবং শেয়ারহোল্ডারদের ২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেয়।
আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ এই লোকসানের জন্য মূলত বিনিয়োগের বিপরীতে প্রভিশনিং বৃদ্ধি, অস্থির পুঁজিবাজারে নিষ্ক্রিয়তার কারণে পোর্টফোলিও হ্রাস এবং ব্যাংকঋণের ওপর উচ্চ সুদব্যয়কে দায়ী করেন।
আইসিবি এখনও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের পূর্ণাঙ্গ আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটির ১০টি এনবিএফআই ও দুটি ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট (এফডিআর) হিসেবে ৯২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকতে হিমশিম খাওয়ায় এসব বিনিয়োগ বছরের পর বছর ধরে আটকে রয়েছে।
কয়েকটি দুর্বল এনবিএফআই গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সেগুলোকে একীভূত করার বিষয়ে আলোচনা চলছে।
এসব কারণে এবং আর্থিক মানদণ্ড মেনে চলার জন্য অডিটরের পরামর্শ অনুসরণ করতে গিয়ে আইসিবিকে এই প্রভিশন রাখতে হয়েছে।
আইসিবির কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, এফডিআর-সংক্রান্ত অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটিকে ৫৫০ কোটি টাকার বেশি প্রভিশন রাখতে হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিনিয়োগের জন্য রাখতে হয়েছে আরও প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
২০১৭ সালে আইসিবি সি পার্ল বিচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা-এর ছাড়া একটি রূপান্তরযোগ্য বন্ডে ৩২৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল। ওই বন্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সি পার্ল বিনিয়োগকৃত অর্থ পরিশোধ করতে পারেনি; এ নিয়ে এখন আদালতে একটি মামলা চলমান রয়েছে।
গত বছর আইসিবি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল পেয়েছিল। চড়া সুদের ঋণ সমন্বয়ের লক্ষ্যে আইসিবি সরকারের কাছে আরও ১৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছে এবং একটি পুনরুজ্জীবন পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। তবে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটি এখনও সেই তহবিল পায়নি।
নিরঞ্জন বলেন, 'অতীতে পুঁজিবাজারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নেওয়া হয়েছিল; শুধু সেই সুদ পরিশোধ করতেই মাসিক ব্যয় ৯০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বাজারের নিষ্ক্রিয়তার কারণে পোর্টফোলিওতে থাকা অনেক কোম্পানির শেয়ারে লোকসান হয়েছে, মূলধনী মুনাফা কমে গেছে, তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশও কমে গেছে।'
তিনি আরও বলেন, '২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি ভালো মুনাফা করেছে এবং লভ্যাংশ দিয়েছে। এর উন্নয়নের জন্য সরকারকে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য ব্যাংক থেকে নেওয়া উচ্চ সুদের ঋণ পরিশোধ করা অপরিহার্য। এজন্য সরকারের কাছে নতুন করে তহবিল চাওয়া হয়েছে।'
করদাতাদের অর্থ ব্যবহার করে সরকার আইসিবিকে আরও সহায়তা দেবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, '২০১০ সাল থেকে সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করে আইসিবি পুঁজিবাজারকে সহায়তা দেওয়ার জন্য বিনিয়োগ করেছে, যা বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ঋণগুলো ঠিক এ কারণেই নেওয়া হয়েছিল যে সরকার আইসিবিকে বলেছিল বাজারকে সহায়তা করার জন্য। তবে ধার করা অর্থ শেয়ারে বিনিয়োগ করা উপযুক্ত ছিল কি না, তা বিবেচনা করার সুযোগ ছিল, কিন্তু সেটি করা হয়নি।'
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, 'আইসিবির বর্তমান পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদনে প্রকৃত চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে। পরিস্থিতি সমাধানে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, আশা করি পুঁজিবাজার আরও গতিশীল হলে এবং নতুন নতুন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হলে আইসিবি তার আগের অবস্থানে ফিরে আসবে।'

 
             
 
 
 
 
