এক সপ্তাহে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার ১.১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে ১০.৪৫ শতাংশে নেমেছে

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ধারের প্রবণতা কম থাকায় এবং বাজারে টাকার তারল্য বাড়ায় ৯১ দিন মেয়াদের ট্রেজারি বিলের সুদহার ১০.৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংক তিন মেয়াদের ট্রেজারি বিলের নিলাম করে। এর মধ্যে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার কমে ১০.৪৫ শতাংশে নেমে আসে। সর্বশেষ ১৩ জুলাইয়ের নিলামে এই বিলের সুদের হার ১১.৫৮ শতাংশে উঠেছিল। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে সুদের হার কমেছে ১.১৩ শতাংশীয় পয়েন্ট।
এর বাইরে ১৮২ দিন ও ৩৬৭ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহারও কমেছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ৮৫ বেসিস পয়েন্ট কমে গত রোববারের অকশনে ১৮২ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়িয়েছে ১১.৭০ শতাংশ। একইসঙ্গে ৩৬৭ দিন মেয়াদের ট্রেজারি বিলের সুদের হার ২৭ বেসিস পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ১০.৯৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ১৬ জুনের নিলামে ৯১ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদহার দাঁড়িয়েছিল সর্বকালের সর্বোচ্চ ১২.০১ শতাংশ। একইয়াবে ১৮২ ও ৩৬৭ দিনের ট্রেজারি বিলের সুদের হারও উঠেছিল যথাক্রমে ১২.১১ শতাংশ ও ১২.২৪ শতাংশে। জুনের বাকি নিলামগুলোতেও সুদহার ছিল ১২ শতাংশের বেশি।
তবে জুলাইয়ের গোড়া থেকে নামতে শুরু করে সুদের হার। সর্বশেষ গতকালের নিলামে সবগুলো বিলের সুদের হার ১১ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এর আগে ১১ শতাংশের কম সুদ দেখা গিয়েছিল চলতি বছরের ১৬ মার্চ। সে হিসাবে ট্রেজারি বিলের সুদের হার গত চার মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে।
বেশ কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টিবিএসকে বলেন, ১৪ দিন মেয়াদের রিপারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট (রেপো) ও অ্যাশিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট (এএলএস) জুলাই মাস থেকে বন্ধ হয়ে যেতে পারে, এমন ধারণার ওপর ভিত্তি করে জুনে সুদহারগুলো বেড়েছিল। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এসব তারল্য সহায়তা সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানালে সুদহার কমতে শুরু করে।
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ টিবিএসকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার কেনার কারণে বাজারে তারল্য বেড়ে যাওয়া, মূল্যস্ফীতির হার কমে আসা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির (এসডিএফ) সুদহার কমিয়ে দেওয়াসহ অনেকগুলো কারণই রয়েছে ট্রেজারি বিলের সুদহার কমার ধারাবাহিকতার পেছনে।
একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম প্রান্তিকে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের নিট ঋণ নেগেটিভ থাকবে। অর্থাৎ ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে সরকার এই তিন মাসে যে পরিমাণ নতুন ধার করবে, পুরনো ধার পরিশোধ করবে বা বিলের রিটায়ারমেন্ট অ্যামাউন্ট হবে তারচেয়ে বেশি।
অন্যদিকে, সব ব্যাংক সমানভাবে আমানতে প্রবৃদ্ধি করতে পারছে না। বিশেষ করে ভালো ব্যাংকগুলোতে আমানতে প্রবৃদ্ধি বেশি থাকায় তাদের তারল্যের পরিমাণ ভালো। আবার বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কম থাকায় ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের খাতও সীমিত বলে উল্লেখ করেন ওই কর্মকর্তা।
'ব্যাংকগুলোর জন্য তাই ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করা একটি লাভজনক বিকল্প। এসব কারণে ব্যাংকগুলো এখন ট্রেজারি বিল ও বন্ডগুলোতে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। অনেক ব্যাংক এসব বিলে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করায় সুদের হারও কমে আসছে,' বলেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের মে মাসে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৯৫ শতাংশ, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ৯.৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম।
অন্যদিকে, গত মে মাসে আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭.৭৩ শতাংশ। অর্থাৎ, আমানতের প্রবৃদ্ধি কম হলেও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি তারচেয়েও ৭৮ বেসিস পয়েন্ট কম।
আরেকটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ট্রেজারি বিলের রেট কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে থেকে ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার কিনেছে, ফলে বাজারে তারল্য বেড়েছে ৫ হাজার ৮৮১ কোটি টাকা।
'ব্যাংকগুলোর হাতে টাকা থাকায় তারা নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিলে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে। প্রতিযোগী ও বিড বেড়ে যাওয়ায় সুদের হার কমেছে,' বলেন তিনি।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলকে (আইএমএফ) জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশের নিচে নেমে এলে তারা নীতি সুদহার কমানোর বিষয়টি বিবেচনা করবে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার বর্তমানের ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে দিতে পারে—এ ধারণা মাথায় রেখে ব্যাংকগুলো তাদের হাতে থাকা তরল তহবিল বিলে বিনিয়োগ করে দিতে চাচ্ছে, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কমালে তারা লাভবান হয়।
ওই কর্মকর্তার মতে, তৃতীয় কারণ হচ্ছে, ডলারের তারল্য ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি।
তিনি বলেন, 'রেমিট্যান্স ও রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি থাকায় এমন তারল্য পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে। কারণ, জাতীয় নির্বাচনের আগে ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে যাবেন না। ফলে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানিসহ বিনিয়োগসংক্রান্ত আমদানি আপাতত বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারকে ঠিক রাখতে আবারও ডলার কেনার সম্ভাবনা রয়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনলে স্থানীয় মুদ্রাবাজারে তারল্য বাড়বে। ট্রেজারি বিলের সুদহার কমার পেছনে এই স্পেকুলেশনও কাজ করছে।'