সংকটগ্রস্ত এনবিএফআই অবসায়নে সরকারের খরচ হতে পারে ১২,০০০ কোটি টাকা

দেশের ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ও সংকটগ্রস্ত ইসলামি ব্যাংকগুলোর ব্যাপক সংকট মোকাবিলায় সরকারকে বড় অঙ্কের আর্থিক ব্যয়ের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে, যার জন্য সরকারি তহবিল থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় করতে হতে পারে।
এই বিপুল ব্যয়ের বেশিরভাগটাই সরকারের বাজেট থেকে আসবে বলে নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
ব্যাপক হারে এনবিএফআই অবসায়নের পথে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ১৫ থেকে ২০টি সংকটগ্রস্ত এনবিএফআই অবসায়নের পরিকল্পনা করছে। এই পদক্ষেপে সরকারি কোষাগার থেকে অন্তত ১০-১২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গভর্নর মনসুর জানিয়েছেন, বর্তমানে ২০টি এনবিএফআই 'লাল তালিকায়' রয়েছে, যার বেশিরভাগই আর কার্যকর নেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিলুপ্ত করে 'খাতটিকে পরিশুদ্ধ করাই' মূল লক্ষ্য।
গভর্নর মনসুর একটি বড় চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেছেন। বর্তমান আইন অনুযায়ী, এনবিএফআইয়ের আমানতকারীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকার আইনত বাধ্য নয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন সংশোধিত ডিপোজিট ইনস্যুরেন্স অ্যাক্টে এনবিএফআইগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে, যা আমানতকারীদের ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানতের সুরক্ষা দেবে। এই পরিবর্তনের লক্ষ্য হলো ভবিষ্যতে আমানতকারীদের জন্য অন্তত আংশিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের ৩৫টি এনবিএফআইয়ের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচটি বর্তমানে ভালোভাবে চলছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে: সমস্ত এনবিএফআইয়ের মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৩৩.২৫ শতাংশ (২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা) খেলাপি হিসেবে শ্রেণিকৃত।
চিহ্নিত ২০টি সংকটগ্রস্ত এনবিএফআইয়ের হাতেই গত ডিসেম্বর শেষে ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকার ঋণ ছিল। উদ্বেগজনকভাবে এর মধ্যে ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা—অর্থাৎ ৮৩.১৬ শতাংশ—খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে, যার বিপরীতে জামানত রয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় চরম দুর্বলতা রয়েছে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিপুল অর্থ আত্মসাতের জন্য কুখ্যাত পিকে হালদার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীদের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে ভালো অবস্থানে থাকা ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর প্রতিও সাধারণ আমানতকারীদের আস্থা কমে যাচ্ছে।
সংকটগ্রস্ত ২০ প্রতিষ্ঠান
যে ২০টি সংকটগ্রস্ত এনবিএফআই সম্ভাব্য অবসায়নের মুখোমুখি, সেগুলো হলো: সিভিসি ফাইন্যান্স, বে লিজিং, ইসলামিক ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, হজ্জ ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (আইআইডিএফসি), প্রিমিয়ার লিজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স, উত্তরা ফাইন্যান্স, আভিভা ফাইন্যান্স, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি লিমিটেড (বিআইএফসি), ফারইস্ট ফাইন্যান্স ও এফএএস ফাইন্যান্স। এর মধ্যে সাতটির খেলাপি ঋণের হার ৯০ শতাংশেরও বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এই ২০টি এনবিএফআইকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে জানতে চেয়েছে, কেন তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে না। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে মোট আমানতের পরিমাণ ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক ও ২৬ শতাংশ ব্যক্তিগত আমানত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান টিবিএসকে বলেন, 'কিছু এনবিএফআই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নোটিশের জবাব দিয়েছে, বাকিরাও শিগগিরই দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। যাদের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক হবে না, তাদের অবসায়নের আওতায় আনা হবে। তবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কিছুটা সময় লাগবে।'
তিনি আরও বলেন, এই এনবিএফআইগুলোতে ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলনামূলক ভালো হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ১৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে। এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের পরিমাণ ৪৯ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রেণিকৃত ঋণের পরিমাণ মাত্র ৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৭.৩১ শতাংশ।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-এর (বিআইবিএম) অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবীব বলেন, 'বেশিরভাগ এনবিএফআই ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহক নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জামানতকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত ছিল।'
তিনি আরও বলেন, এনবিএফআইগুলো দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন প্রদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগই সেই লক্ষ্যে ব্যর্থ হয়েছে। সামনে একটি শক্তিশালী এনবিএফআই খাত প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের বেশিরভাগই ভালো করছে না। বন্ড ও সিকিউরিটিজ মার্কেটের সংস্কারসহ এই খাতকে বাঁচাতে জরুরি সহায়তার আহ্বান জানান তিনি।
ব্যাংক একীভূতকরণে প্রাথমিক ধাপে প্রয়োজন ২০,০০০ কোটি টাকা
এনবিএফআই ছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বপরিকল্পিত পাঁচটি সংকটগ্রস্ত ইসলামি ব্যাংক একীভূত করতে প্রাথমিক পর্যায়ে আরও ১৫-২০ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে। ফলে মোট আর্থিক বোঝার পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৩০ হাজার কোটি টাকা।
গভর্নর মনসুর বলেন, 'আমরা হিসাব করছি। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি ব্যাংকের পুনর্গঠন করতে গেলে প্রথম দফায় ১৫-২০ হাজার কোটি টাকা লেগে যাবে। পরে ধাপে ধাপে আরও বিনিয়োগ করতে হবে।'
এই একীভূতকরণের জন্য প্রাথমিক মূলধন আসবে সরকারি বাজেট থেকে, যা পুনঃমূলধনীকরণ প্রকল্পের অধীনে বন্ডের মাধ্যমে সরবরাহ করা হতে পারে।
প্রথমদিকে সরকার সুদের অর্থ পরিশোধ করবে, আর আসল টাকা থাকবে বন্ড আকারে। এই তহবিল ব্যাংকের মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করবে।
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো, এই পুনর্গঠিত ব্যাংকগুলোকে ধীরে ধীরে দেশি-বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের কাছে হস্তান্তর করা এবং শেয়ারবাজারে শেয়ার ছেড়ে দিয়ে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংকগুলোর মূলধনে পুনঃবিনিয়োগ করা।
গভর্নর মনসুর বলেন, যদি কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী শতভাগ মালিকানা নিতে চায়, সে ব্যাপারেও তাদের আপত্তি থাকবে না।
একীভূতকরণের জন্য চিহ্নিত পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক হলো: ফার্স্ট সিকিউরিটি, এক্সিম, সোশ্যাল ইসলামী, ইউনিয়ন ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের করা একটি বহিরাগত অডিটে এই ব্যাংকগুলোর ঋণের ওপর ৬০-৯৫ শতাংশ পর্যন্ত উদ্বেগজনক খেলাপি হার প্রকাশ পেয়েছে।