আমদানিতে অগ্রিম কর ২.৫ শতাংশ বাড়ছে, প্রভাব পড়বে শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে গাড়িতে

সরকার আসন্ন ২০২৫-২৬ বাজেটে বাণিজ্যিক আমদানির ওপর অগ্রিম কর উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং ভ্যাট আদায়ে চলমান অনিয়ম ও ফাঁকি পুষিয়ে নিতে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তবে প্রস্তাবিত এ কর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকারকর্মীরা ইতোমধ্যে কড়া সমালোচনা করেছেন। তাদের আশঙ্কা, এ সিদ্ধান্তের ফলে বিভিন্ন পণ্যের দামে তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়বে।
নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী, শিশু খাদ্য, মশলা, ফল, পোশাক, যানবাহন, খেলনা, সিরামিক পণ্য, বাথরুম ও বৈদ্যুতিক ফিটিংস, সুইচ এবং চিকিৎসা সরঞ্জামসহ বিভিন্ন আমদানিকৃত পণ্যে অগ্রিম করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হবে। একই সঙ্গে আগামী অর্থবছর থেকে স্থানীয় সরবরাহে বর্তমানে আরোপিত ৭.৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব রয়েছে। এছাড়া, শিল্প উপকরণের ওপর আরোপিত ৩ শতাংশ অগ্রিম কর কমিয়ে ২ শতাংশ করা হতে পারে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে ব্যাপক ভ্যাট ফাঁকির প্রেক্ষাপটে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তাদের ধারণা, আমদানির ওপর অগ্রিম কর বাড়ালে আগামী অর্থবছরে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে।
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাতে আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল) আদায় হয়েছে ১১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এনবিআর কর্মকর্তা এ সিদ্ধান্তের পেছনের যুক্তি ব্যাখ্যা করে বলেন, 'স্থানীয় বিক্রয় থেকে খুব সামান্য ভ্যাট আদায় হয়। অপরদিকে, শিল্প কাঁচামালের ওপর পরিশোধিত অগ্রিম কর পরে ফেরত দেওয়া হয় বা সমন্বয় করা হয়। ফলে আমদানির সময় অগ্রিম কর আদায় করাই বেশি কার্যকর; এতে আদায় নিশ্চিত হয় এবং ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়।' তিনি আরও বলেন, 'ভ্যাট হার কমালে বা অব্যাহতি দিলেও রাজস্বে বড় ধরনের ক্ষতি হয় না। কিন্তু আমদানিতে অগ্রিম কর বাড়ালে রাজস্ব অনেক বেশি বাড়বে।'
তবে বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ী নেতারা এ পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ভ্যাট ফাঁকিবাজদের ধরার বদলে সরকার সব আমদানিকারককে শাস্তি দিচ্ছে। এর ফলে পরদিন থেকেই দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাবে।' তিনি আরও বলেন, 'এ ধরনের কর বৃদ্ধিতে সৎ ব্যবসায়ীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। আর অসৎ ব্যবসায়ীরা, যারা প্রায়ই কর্মকর্তাদের সঙ্গে সমঝোতা করেন, তাদের কিছুই হয় না। শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই চড়া দাম দিয়ে কষ্ট করতে হয়। কর বাড়িয়ে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানো ন্যায্য নয়।'
এক সময় অগ্রিম ট্রেড ভ্যাট হিসেবে আগাম ভ্যাট আদায় হতো। পরে নতুন ভ্যাট আইনে তা বাতিল করা হলেও এখন অগ্রিম কর এখন আমদানির পর্যায়ে বিকল্প ভ্যাট হিসেবে কার্যকর হচ্ছে। তবে অগ্রিম কর ভোজ্যতেল, চিনি, নির্দিষ্ট জ্বালানি, শিল্প যন্ত্রপাতি ও উৎপাদন কাঁচামালের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। মূলত, এটি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি হওয়া বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের ওপরই আরোপিত।
আমদানিকারকদের উদ্বেগ
প্রস্তাবিত এ পরিবর্তনে ফল ও যানবাহন আমদানিকারকদের মধ্যে বিশেষভাবে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সরকার সাময়িকভাবে ফল আমদানির ওপর অগ্রিম কর স্থগিত করেছিল, তবে এ সুবিধা জুন মাসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। যদি অগ্রিম কর বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়, তাহলে আপেল, কমলা ও আঙ্গুরের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ফল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, 'যদি জুলাই মাসে এটি আবার চালু হয়ে ৭.৫ শতাংশে উন্নীত হয়, তাহলে আপেল, কমলা ও আঙ্গুরের দাম প্রচণ্ডভাবে বাড়বে।' তিনি জানান, বর্তমানে আমদানিকৃত ফলের ওপর মোট করের হার প্রতি ১০০ টাকায় প্রায় ১১০ টাকা। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'কর বেশি হওয়ার কারণে ফলের চাহিদা ইতিমধ্যেই কমে গেছে। এ করবৃদ্ধি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।'
যানবাহন আমদানিকারকেরাও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ রিকন্ডিশনড ভেহিকলস ইম্পোর্টারস অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ-সভাপতি এবং একজন অভিজ্ঞ আমদানিকারক মো. শহীদুল ইসলাম জানান, অগ্রিম কর ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধির ফলে ৪০ লাখ টাকার একটি গাড়ির দামে অতিরিক্ত এক লাখ টাকা যুক্ত হবে, যার বোঝা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে। তিনি স্থানীয় সরবরাহে ৭.৫ শতাংশ অগ্রিম কর তুলে দেওয়ার প্রস্তাবকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, 'একবার আমদানি পর্যায়ে অগ্রিম কর পরিশোধ হয়ে গেলে স্থানীয় বিক্রয়ের সময় তা আবার আরোপ করা হয় না। এতে সরকারের বাড়তি কোনো আয় হয় না।' তিনি আরও জানান, টাকার অবমূল্যায়ন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে এ বছর যানবাহন বিক্রি প্রায় ৪০ শতাংশ কমেছে, আর এ করবৃদ্ধি বিক্রি আরও কমিয়ে দেবে।
লক্ষ্যভিত্তিক সমাধানের পরামর্শ
বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত এ করবৃদ্ধিকে মোটের ওপর অকার্যকর বলে মন্তব্য করে লক্ষ্যভিত্তিক সমাধানের পরামর্শ দিয়েছেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান জাইদি সাত্তার সরকারের এ কৌশলের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'স্থানীয় বিক্রয় থেকে ভ্যাট আদায়ে দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার পরিবর্তে সরকার সব ধরনের বাণিজ্যিক আমদানির ওপর কর বাড়াচ্ছে। এ পদক্ষেপ অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।' তিনি বলেন, আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যের ওপর কর বাড়ালে প্রতিযোগিতা কমে যায় এবং এটি একটি পরিণত অর্থনীতির জন্য অস্থিতিশীল কৌশল।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, অগ্রিম কর কাগজে-কলমে মূল্য সংযোজনের ভিত্তিতে ফেরতযোগ্য হলেও, বাস্তবে খুব কম ব্যবসায়ীই তা ফেরত পেতে সক্ষম হন। এনবিআর আমদানি পর্যায়ের কর সংগ্রহকে কার্যকর কর পরিপালনের বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করছে, যা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে।
এনবিআরের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১৭ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৭ লাখ কোটি টাকা। যদি এর পুরো ভ্যাট আদায় সম্ভব হতো, তাহলে রাজস্ব আদায় ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাতে পারত। অথচ বর্তমানে আদায় হচ্ছে মাত্র ৪ হাজার কোটি টাকা। কর বিশেষজ্ঞ স্নেহাশিস বড়ুয়া বলেন, 'সরকার একাধিক আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার পরও স্থানীয় পর্যায়ে কার্যকরভাবে ভ্যাট আদায়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাই এখন তারা সহজ পথ হিসেবে আমদানির ওপর কর আরোপ করছে।' তিনি আবারও জোর দিয়ে বলেন, 'সরকার যতই রাজস্ব আদায় করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত এর পুরোটা ভোক্তাদের পকেট থেকেই যাবে।'