পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ ও বিনিয়োগ আসতে চাচ্ছে, তবে এখনো বড় বাধা গ্যাস সংকট

এই বছরের জানুয়ারিতে ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যের উপর নতুন করে শুল্ক বসালে খুব কম মানুষই ভাবতে পেরেছিল, এর প্রভাব সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও চট্টগ্রামের পোশাকশিল্পে গিয়ে পৌঁছাবে। কিন্তু আন্তঃসংযুক্ত বৈশ্বিক বাণিজ্যের বাস্তবতায় একটি দেশের বাধা কখনও কখনও অন্য দেশের জন্য হয়ে ওঠে নতুন সম্ভাবনা।
এখন আমেরিকান পোশাক ক্রেতারা—যারা আগে চীনের উৎপাদনকেন্দ্রের উপর নির্ভর করতেন—চুপচাপ তাদের উৎস বেছে নেওয়ার কৌশল বদলে ফেলছেন। অনেকেই নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিকল্প খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশের দিকে নজর দিচ্ছেন।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, এটি নিছক কাকতালীয় নয়। বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানের কারণেই দেশটি এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
তবে এই গল্প কেবল পরিসংখ্যানের নয়—এটি ক্রেতাদের আচরণেও প্রতিফলিত হচ্ছে। যেখানে একসময় সোর্সিংয়ের সিদ্ধান্ত হতো হংকংয়ের বোর্ডরুমে বা দুবাইয়ের কোনো হোটেল স্যুইটে, এখন মার্কিন ক্রয় ব্যবস্থাপকরা ঢাকায় এসে নিজের চোখে কারখানা দেখছেন, স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে বসছেন এবং উপকরণ ঘনিষ্ঠভাবে যাচাই করছেন। এটি বাংলাদেশের প্রতি তাদের আস্থার নতুন ইঙ্গিত।
পরিস্থিতি যাচাই করছেন ক্রেতারা
চীনে শুল্ক বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা এখন নতুন উৎসের সন্ধানে অনুসন্ধানমূলক আলোচনা শুরু করেছেন। একই সঙ্গে, চীনা বিনিয়োগকারীরাও—বিশেষ করে টেক্সটাইল ও পোশাক খাতের বিনিয়োগকারীরা মার্কিন-চীন উত্তেজনার কারণে বাংলাদেশকে সম্ভাব্য গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করছেন।
তবে এই সুযোগের পথেও রয়েছে একটি বড় বাধা—জ্বালানি নিরাপত্তাহীনতা। চাহিদা বাড়লেও গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ছে না, যা উদ্যোক্তা ও বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, গ্যাস-নির্ভর কারখানাগুলো তাদের প্রয়োজনের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ গ্যাস পাচ্ছে। এই ধারা চলতে থাকলে বিশেষ করে জ্বালানি-নির্ভর খাতে নতুন বিনিয়োগ টানা কঠিন হবে।
এদিকে, মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কের ৯০ দিনের স্থগিতাদেশ শেষ হতে চলেছে, এবং ভবিষ্যতের শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে।
ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসছে। বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বলছেন, এ অবস্থায় ক্রেতারা তাদের কাছে জানতে চাইছেন সরকার এ বিষয়ে কী ধরনের কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছে।
গত সপ্তাহে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পোশাক ব্র্যান্ড গ্যাপ ইনকর্পোরেটেড চট্টগ্রামের এক রপ্তানিকারকের সঙ্গে অর্ডার সম্প্রসারণ নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছে। ২০২৪ সালে ওই প্রতিষ্ঠানের মোট চালানের ৪৫ শতাংশই গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।
ওই প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ওই ক্রেতা চীন থেকে কিছু উৎপাদন সরিয়ে নিতে চাইছেন এবং আমাদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছেন।'
টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, 'গত সপ্তাহে, দুইজন মার্কিন ক্রেতা—যারা সাধারণত চীন থেকেই পণ্য সংগ্রহ করেন—বাংলাদেশে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা এখানে অর্ডার বাড়াতে আগ্রহী। এটি একটি ইতিবাচক বার্তা।' বর্তমানে টিম গ্রুপ এটির রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড কথা বলেছে ১০ জন শীর্ষ রপ্তানিকারকের সঙ্গে। তাদের মধ্যে চারজন নিশ্চিত করেছেন, মার্কিন ক্রেতাদের কাছ থেকে আগ্রহ ও অনুসন্ধান বেড়েছে। যারা আগে থেকেই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আনেন, তারাও এখন চীনের কিছু অর্ডার এখানে স্থানান্তরের কথা ভাবছেন।
শিল্প নেতারা একমত—চীনের উপর নির্ভরতা কমানোর এ ধারা এখন প্রায় অনিবার্য, এবং যদি বাংলাদেশ জ্বালানি ও অবকাঠামো-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো সামলাতে পারে, তবে এটি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হতে পারে।
এপ্রিলের শুরুতে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের উপর নতুন করে শুল্ক বসায়। চীনা পোশাকপণ্যের উপর শুল্ক ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চীন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও শুল্ক সাময়িকভাবে ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫২ শতাংশ করা হয়। পরে, চীন ছাড়া অন্য সব দেশের জন্য সেই শুল্ক কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
এই পদক্ষেপ চীনের জন্য বড় ধাক্কা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই শুল্কই বাংলাদেশের জন্য বাজারে বড় সুযোগ এনে দিতে পারে।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও, বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে মার্কিন-চীন বাণিজ্য সংঘাত চলতে পারে। এতে করে ক্রেতারা বিকল্প উৎস খুঁজতে বাধ্য হবেন—এবং বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে রয়েছে।'
ভারত, পাকিস্তান বা ভিয়েতনাম কেন সেই বিকল্প নয়—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে চীনের বড় ধরনের বিনিয়োগ আছে, যা মার্কিন ক্রেতাদের সাবধানী করে তুলতে পারে। ভারতেও চীনের বিনিয়োগ আছে। তবে পোশাক খাতে বাংলাদেশই সবচেয়ে শক্তিশালী বিকল্প।'
বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে চীনা বিনিয়োগকারীরা
যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ শুল্কের কারণে প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখতে চীনের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস কোম্পানিগুলো বিদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন তাদের অন্যতম পছন্দের দেশ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, 'গত দুই সপ্তাহে তিনজন চীনা ও একজন জাপানি বিনিয়োগকারী আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।'
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সভাপতি মো. খোরশেদ আলম জানান, তিনটি চীনা কোম্পানি যোগাযোগ করেছে, এর মধ্যে একটি বিশেষভাবে টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী।
চলতি মাসের শেষ দিকে একটি উচ্চপর্যায়ের চীনা বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসছে। তারা এখানে বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করবেন।
জ্বালানি সংকট: বড় বাধা
তবে শিল্প নেতারা সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের দেশের বিদ্যমান জ্বালানি সংকট সম্পর্কে সতর্ক করছেন। খোরশেদ আলম বলেন, 'গ্যাস সংকটে অনেক টেক্সটাইল মিল এখন মাত্র ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতায় চলছে।' তিনি চীনা কোম্পানিগুলোকে নতুন কারখানা গড়ে তোলার বদলে বিদ্যমান কারখানা ইজারা নেয় বা যৌথভাবে কাজ করার পরামর্শ দিচ্ছেন।
তিনি জানান, তার নারায়ণগঞ্জের ইনটিমেট টেক্সটাইল মিলস ও আশুলিয়ার লিটল স্টার স্পিনিং মিলস গ্যাস সংকটের মধ্যেও চালু আছে। গতকাল দুপুর ১টায় ইনটিমেট টেক্সটাইল মিলসে গ্যাসচাপ ছিল মাত্র ০.৫ পিএসআই, যেখানে আদর্শ চাপ ১০ পিএসআই। এই ঘাটতি ৪৮ ঘণ্টা ধরে চলছে।
এর সঙ্গে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। গতকাল সকাল ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে দুই দফায় ৫০ মিনিট লোডশেডিং হয়েছে।
আশুলিয়ার কারখানায় গ্যাসচাপ কিছুটা বেশি—১.৫ পিএসআই। তবে সেখানে পাঁচটি উৎপাদন লাইনের মধ্যে মাত্র দুটি আংশিকভাবে চালু রাখা যাচ্ছে। কারখানাটি এখন বিকল্প উপায়ে ৩০ শতাংশ সক্ষমতায় চলছে।
নারায়ণগঞ্জের আরেকটি স্পিনিং ও ডাইং প্ল্যান্ট এনজেড টেক্সটাইল মিলস লিমিটেড প্রতিদিনই বাড়তে থাকা এ জ্বালানি সংকটে ভুগছে। সোমবার প্রতিষ্ঠানটিকে ৫.৫ ঘণ্টা লোডশেডিং নিতে হয়েছে এবং গড় গ্যাসচাপ ছিল ১ পিএসআই।
এনজেড টেক্সটাইল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউদ জামান খান জিতু বলেন, 'আমরা এখন গ্যাস, পল্লী বিদ্যুৎ ও ব্যয়বহুল ডিজেল মিলিয়ে অর্ধেক সক্ষমতায় কাজ চালাচ্ছি। ডাইং ইউনিট সচল রাখতে এলপিজিও ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন কোনো অর্ডার নিতে পারছি না।'
চীনা বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, 'সরকার যদি নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করে, তাহলে আমরা নতুন অর্ডার নিতে পারব এবং বেশি বিনিয়োগ টানতে পারব। পূর্ণ সক্ষমতায় চলতে পারলে রপ্তানি আয় আরও ১৭ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব।'
ড. রাজ্জাকও বলেন, 'জ্বালানি নিরাপত্তা ছাড়া আমরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না। মাথাপিছু জ্বালানি ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম নিচের দিকে। আমাদের রপ্তানির সক্ষমতা জ্বালানি সরবরাহের তুলনায় অনেক বেশি—এ রকম ভারসাম্যহীনতা টেকসই নয়।'
তিনি আরও বলেন, 'বিনিয়োগ ও ব্যবসার প্রসার ধরে রাখতে অবকাঠামো ও জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় দ্রুত সংস্কার দরকার।'
তবে সংকটের মধ্যেও কিছুটা আশাবাদের ইঙ্গিত মিলছে। গতকাল এক ভার্চুয়াল বৈঠকে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে দেশের জ্বালানি পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা এসকে বশির উদ্দিন বলেন, এলএনজি অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা পূর্ণভাবে চালু হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে শিল্প খাত সাশ্রয়ী ও মানসম্পন্ন জ্বালানি পাবে।
তিনি আরও বলেন, 'যেকোনো সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে এসে তাৎক্ষণিকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস সুবিধা পেতে পারেন।'