মার্কিন শুল্কের চাপ, চাহিদার পতনে ভারতের উৎপাদনখাতে প্রবৃদ্ধি ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন
ভারতের উৎপাদন খাত নভেম্বর মাসে গতি হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত উচ্চ শুল্ক ভোক্তাচাহিদার ওপর বড় ধরনের চাপ ফেলায় দেশটির প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে গত ৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে। গতকাল সোমবার প্রকাশিত পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্সের (পিএমআই) এর সমীক্ষায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এই হতাশাজনক ফলাফল এশিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির জন্য অস্বস্তিকর, কারণ সরকারি হিসাব অনুযায়ী গত প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি—৮.২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে উৎপাদন খাত ছিল শক্তিশালী, তবে চলতি প্রান্তিকে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপ করা ভারী শুল্কের প্রভাবে তা শ্লথ হয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এইচএসবিসি–এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের যৌথভাবে প্রস্তুত করা ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং পারচেজিং ম্যানেজারস ইনডেক্স বা পিএমআই সূচকের মান অক্টোবরের শক্তিশালী ৫৯.২ পয়েন্ট থেকে নেমে নভেম্বর মাসে দাঁড়িয়েছে ৫৬.৬-এ, যা আগাম প্রাক্কলিত ৫৭.৪–এরও নিচে।
তবে সূচকটি টানা ৫৩ মাস ধরে ৫০-এর ওপর রয়েছে। ২০০৫ সালের মার্চে এই জরিপ শুরুর পর যা সবচেয়ে দীর্ঘ প্রবৃদ্ধির ধারা। পিএমআই ৫০ পয়েন্টের ওপরে থাকার মানে উৎপাদনভিত্তিক অর্থনীতির সম্প্রসারণ, আর এর নিচে নামলে তা সংকোচন বলে ধরা হয়।
উৎপাদনখাতের সাম্প্রতিক এ মন্থরতার প্রভাব পিএমআইয়ের মূল সূচকগুলোতেই স্পষ্ট। কারখানা পর্যায়ে উৎপাদন ও মোট নতুন অর্ডার—যা চাহিদার একটা মূল সূচক—দুটোই ফেব্রুয়ারির পর সবচেয়ে দুর্বল প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে। বাজারের প্রতিকূল পরিস্থিতি, প্রকল্প শুরুতে বিলম্ব হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক প্রতিযোগিতাকে এ প্রবণতার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ। যদিও জরিপে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি, তবুও যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানিবাজার। এছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাজারেও ভোক্তাচাহিদা কমে গেছে। এই অবস্থায়, ভারতের নতুন রপ্তানি আদেশের প্রবৃদ্ধি গত এক বছরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি বাড়লেও সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি কমেছে।
ভারতের সরকারি তথ্য বলছে, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। এরপরেও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বছরওয়ারি প্রায় ৯ শতাংশ কমে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতীয় পণ্যে বড় ধরনের আঘাত হেনেছে।
এইচএসবিসির প্রধান ভারত অর্থনীতিবিদ প্রাঞ্জুল ভাণ্ডারি মন্তব্য করেন, "নভেম্বরের চূড়ান্ত পিএমআই প্রমাণ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ভারতের উৎপাদন প্রবৃদ্ধিকে ধীর করেছে।"
তিনি আরও বলেন, "ভবিষ্যৎ উৎপাদন নিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের আস্থার সূচক নভেম্বর মাসে তীব্রভাবে কমেছে—সম্ভবত শুল্কজনিত প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার কারণে। সরকারের তরফ থেকে পণ্য ও পরিষেবা কর (জিএসটি) কমানোর যে প্রভাব ছিল তা হয়তো ক্ষয়ে যাচ্ছে, এবং তা শুল্কজনিত চাহিদা-ধাক্কা সামলানোর জন্য এটা যথেষ্টও নয়।"
কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রবৃদ্ধিও ধীর হয়েছে, যা গত ২১ মাসের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আসে নভেম্বরে। ভবিষ্যৎ উৎপাদন নিয়ে ব্যবসায়ীদের আস্থা সূচক নেমেছে ২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ের পর সর্বনিম্ন পর্যায়ে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতামূলক চাপের উদ্বেগ এর পেছনে কাজ করছে।
তবে পণ্যের দাম চাপ না থাকাটা ছিল ভোক্তাদের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। উৎপাদনের কাঁচামাল কেনার খরচ নয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম ছিল, যা প্রস্তুতকারকদের দাম বাড়ানো সীমিত রাখতে সহায়তা করেছে। ফলে নভেম্বরে উৎপাদিত পণ্যের দাম ছিল মার্চের পর সবচেয়ে কম।
মূল্যস্ফীতির চাপ কম থাকার এই বিষয়টি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক—রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে চলতি সপ্তাহের বৈঠকে নীতি সুদের হার (রেপো রেট) ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ৫.২৫ শতাংশ করার সুযোগ দেবে, কারণ ভোক্তাপর্যায়ে মূল্যস্ফীতি এখন রেকর্ড নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে।
