২০২৪ সালে বিদেশি বিনিয়োগ কমে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন

দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ডলার সংকট এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ২০২৪ সালে বিগত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম নেট বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে বাংলাদেশে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মোট নেট এফডিআই এসেছে ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে এই অঙ্ক ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার কমেছে এফডিআই।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে খুব বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসেনি। এরপর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আগস্টে সরকার পতন ঘটে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়। যদিও বছরের শেষ দিকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে।"
"এই অনিশ্চয়তা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতায় ফেলে দিয়েছে, যার কারণে বিনিয়োগ কমে গেছে," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২১ সালে দেশে নেট এফডিআই এসেছিল ১.৫৭ বিলিয়ন ডলার, এরপর থেকে প্রতি বছর আগের বছরের তুলনায় এফডিআই কমেছে। সবমিলিয়ে, ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বিএমপি৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী রিভাইজড ডেটা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালে এসেছে সবচেয়ে কম এফডিআই। ২০০০ সালের আগের তথ্য বিএমপি৫ ম্যানুয়াল অনুসারে সংরক্ষিত হওয়ায় সেগুলোর সঙ্গে তুলনা সম্ভব হয়নি।
২০২৪ সালে আসা মোট এফডিআইয়ের মধ্যে ৬২২ মিলিয়ন ডলার ছিল রিইনভেস্টেড আর্নিংস—অর্থাৎ পুরনো বিনিয়োগ থেকে আয় আবার বিনিয়োগ করা। এটি মোট এফডিআইয়ের প্রায় ৪৯ শতাংশ। এছাড়া, ইক্যুইটি ক্যাপিটাল এসেছে ৫৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ইন্ট্রা-কোম্পানি লোন বা আন্তঃকোম্পানি ঋণ এসেছে ১০৪ মিলিয়ন ডলার।
রিইনভেস্টমেন্ট কেন বেশি জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, "বাংলাদেশে বিনিয়োগে রিটার্ন ভালো। তবে বিনিয়োগকারীরা অনেক সময় ডলার সংকট ও অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার কারণে আয় ফিরিয়ে নিতে পারেন না, তাই বাধ্য হয়ে পুনঃবিনিয়োগ করেন।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ব্যাংকিং খাতে—৪১৬ মিলিয়ন ডলার। এরপর রয়েছে টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট খাত—৪০৭ মিলিয়ন ডলার। ওষুধ ও রাসায়নিক, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি এবং খাদ্য খাতেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বলেন, "এফডিআই আসার জন্য সময়টা ভালো ছিল না। জুলাই-অগাস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর সেপ্টেম্বরেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো ছিল না। এছাড়া, বিভিন্ন কারখানায় বিচ্ছিন্ন আন্দোলনও হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক সময় ট্যাক্স নীতিসহ বিভিন্ন নীতিতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা থাকে। যেহেতু বর্তমান সরকার স্বল্পমেয়াদি, তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষা করছেন স্থায়ী সরকার ও স্থিতিশীল নীতির জন্য।"
এদিকে, চলতি এপ্রিলে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) ও বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি (বেজা) যৌথভাবে 'বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫' আয়োজন করে।
বিডা ও বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন জানান, এই সামিটে ৫০টি দেশের ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি অংশ নেন এবং এই আয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে।
এই সামিটের সুফল কবে আসতে পারে—জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী বলেন, "সামিটের পর বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা যাচাই করেন। এতে সময় লাগে। সবকিছু অনুকূলে থাকলে বিনিয়োগ আসতে অন্তত এক বছর সময় লাগবে।"
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে কী করতে হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "নতুন সরকার যেসব আর্থিক খাত সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে, সেগুলো সবার মতামতের ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে খাতভিত্তিক স্বচ্ছতা বাড়বে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে।"
"এছাড়া, রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় বসলে নিয়ম-নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা বজায় থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে, তখন বিনিয়োগকারীরা বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হন," যোগ করেন তিনি।