এফডিআই বাড়াতে উদ্যোগ: ইক্যুইটিতে বিদেশি বিনিয়োগ আনলেই প্রণোদনা

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করে, ইক্যুইটির (শেয়ার) মাধ্যমে বাংলাদেশে নতুন প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আনতে পারলে – ১.৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার একটি উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। দেশে কিংবা প্রবাসে বসবাসরত যেকোনো বাংলাদেশি এই প্রণোদনা পেতে পারেন।
এই লক্ষ্যে 'বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রণোদনা স্কিম' নামে একটি নীতিমালার খসড়া প্রণয়ন করছে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)।
এই প্রণোদনা দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে ৭৫ লাখ ডলারের একটি তহবিল গঠন করবে সরকার। এটি গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে আসা মোট ইক্যুইটি বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহের ১.২৫ শতাংশ। ওই অর্থবছর মোট ইক্যুইটি এফডিআই প্রবাহের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০ কোটি ডলার।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, এই প্রণোদনা পেতে কমপক্ষে ১০ লাখ ডলারের নতুন ইক্যুইটি বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রণোদনাযোগ্য সব বিনিয়োগে ১ শতাংশ হার নির্ধারণের পক্ষে মতামত দিয়েছে।
বিডা খসড়াটি চূড়ান্ত করছে বলে নিশ্চিত করেছে। সংস্থাটির মতে, এ পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য দেশে নতুন ইক্যুইটি পুঁজির প্রবাহ বাড়ানো।
রেমিট্যান্স ও রপ্তানিখাত থেকে অনুপ্রেরণা
বিডা'র নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন টিবিএসকে বলেন, রেমিটেন্স ও রপ্তানির কিছুখাতে প্রণোদনা দেওয়ার ধারণা থেকে আমরা এফডিআই আনার ক্ষেত্রে যারা সহযোগিতা করবেন, তাদেরকে প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি, এতে বাংলাদেশে ফ্রেশ ইক্যুইটিতে এফডিআই প্রবাহ বাড়বে।"
তিনি আরও বলেন, এ উদ্যোগ বাংলাদেশিদের বিদেশি বিনিয়োগ আনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতে উৎসাহ দেবে।
বিডার ব্যবসা উন্নয়ন বিভাগের প্রধান নাহিয়ান রহমান রোচি জানান, চূড়ান্ত নীতিমালায় প্রণোদনার হার সর্বোচ্চ ১.৫% পর্যন্ত হতে পারে। তিনি পরিষ্কার করে বলেন, এ স্কিম কেবল নতুন ইকুইটি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে। বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের অতিরিক্ত শেয়ার কেনা বা সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগ এখানে অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীরা যদি সম্পূর্ণ নতুন খাতে বিনিয়োগ করেন, তাহলে তারা এ প্রণোদনার আওতায় আসবেন।
বিডার বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্রধান নাহিয়ান রহমান জানান, নীতিমালার চূড়ান্ত খসড়ায় প্রণোদনার হার সর্বোচ্চ ১.৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। তবে এ প্রণোদনা কেবলমাত্র নতুন ইক্যুইটি বিনিয়োগের জন্য প্রযোজ্য হবে। বিদ্যমান শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার কেনা বা একইখাতে সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বাড়তি বিনিয়োগ এখানে অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে সম্পূর্ণ নতুন খাতে বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ এ সুবিধার আওতায় আসবে।
২০২৪ সালের জুন মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বিডা গভর্নিং বোর্ডের বৈঠকে এফডিআই বৃদ্ধির বিষয়ে মতামত দেওয়ার জন্য কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে গত ২৫ জুন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে এই কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। তার ভিত্তিতে খসড়া নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
নাহিয়ান রহমান নিশ্চিত করেন যে, খসড়া নীতিমালার উপর বিডা— বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার মতামত চেয়েছে। মতামত পাওয়ার পর এটি চূড়ান্ত করে চলতি অর্থবছরই কার্যকর করার আশা করছে বিডা।
এই উদ্যোগের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, "বিভিন্ন দেশে এফডিআই আকৃষ্ট করার জন্য এ ধরণের ইনসেনটিভ (প্রণোদনা) রয়েছে। অনেক বাংলাদেশি বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে। বাংলাদেশে এফডিআই আনার ক্ষেত্রে তারা যাতে প্রমোশনাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে বিনিয়োগ আনতে উৎসাহিত হন, সেজন্যই এ ধরণের আর্থিক প্রণোদনার বিধান করা হচ্ছে।"
বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশে গুরুত্ব
এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিশেষজ্ঞরা এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে বাস্তবসম্মত মূল্যায়নের তাগিদ দিয়েছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, প্রণোদনার নামে সরকারি অর্থের ব্যবহার অবশ্যই প্রত্যাশিত রিটার্নের যৌক্তিক হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে হতে হবে।
"এক্ষেত্রে প্রণোদনা কারা পাবে এবং এফডিআই আনার ক্ষেত্রে ইন্টারমিডিয়ারি (মধ্যস্ততাকারী) হিসেবে কাজ করতে গিয়ে বিদেশিদের বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে এসব ব্যক্তির খরচ কেমন হবে, সে বিষয়েও অ্যাসেসমেন্ট করা প্রয়োজন"- টিবিএসকে বলেন তিনি।
সতর্ক করে তিনি বলেন, "রেমিট্যান্সে প্রণোদনা দেওয়ার পর যেসব সিরিয়াস স্টাডি (গবেষণা) হয়েছে, তার কোনটির ফলাফলেই প্রমাণিত হয়নি যে প্রণোদনার কারণে রেমিটেন্স বেড়েছে। তা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়, তা দেশের গরীব পরিবারগুলো পায়। কিন্তু এফডিআই আনার ক্ষেত্রে জনগণের করের টাকা প্রণোদনা হিসেবে কারা পাবে, সেটিও বিবেচনা করতে হবে।"
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, "এফডিআই আকৃষ্ট করার মূল শর্ত হলো দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি অনুকূল ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করা। এটি অর্জনের জন্য ব্যবসার নিয়মকানুন সহজ করা অত্যন্ত জরুরি।"
তার মতে, শুধু প্রণোদনা দিয়েই কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে বিডার ওয়ান-স্টপ সার্ভিস সেন্টার কিংবা রাজস্ব বোর্ডের সিঙ্গেল উইন্ডোর মাধ্যমে—কার্যকর লাইসেন্স ও অনুমোদন প্রক্রিয়া চালু করা প্রয়োজন। একইসঙ্গে, লজিস্টিকস খাতে বিনিয়োগ এবং বন্দর ব্যবস্থাপনা সহজীকরণের মাধ্যমে ব্যবসার খরচ কমানোও অপরিহার্য পদক্ষেপ।
হাতেম ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জগুলোর কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, "বর্তমানে ব্যবসার সবচেয়ে বড় অন্তরায় হলো ব্যাংকিং খাত। তারা একের পর এক নতুন নীতি জারি করছে।"
তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মকানুন হয়তো বৈশ্বিক সর্বোত্তম চর্চার প্রতিফলন হতে পারে, তবে সরকারকে দেখতে হবে বেসরকারি খাত সেগুলো বাস্তবে কতটা কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারছে। তা না হলে কেবল প্রণোদনার মাধ্যমে এফডিআই আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
যোগ্যতা ও যাচাই প্রক্রিয়া
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে, এই প্রণোদনা শুধু ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য হবে না। বাংলাদেশের বৈধ এনআইডি বা পাসপোর্ট এবং ই-টিআইএনধারী প্রবাসী বাংলাদেশিসহ সকল বাংলাদেশি নাগরিক এই প্রণোদনা পাওয়ার যোগ্য হবেন। তবে প্রণোদনা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রাথমিক পর্যায়ে বিদেশি বিনিয়োগ উন্নয়নে তথা লিড জেনারেশনে সহায়ক এমন কার্যকর ও স্বতন্ত্রভাবে যাচাইযোগ্য অবদান রাখতে হবে এবং বিনিয়োগের পূর্বেই বিডা পোর্টালে নিবন্ধন করতে হবে।
কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত এড়াতে, খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছে যে, লিড জেনারেশনের সময় আবেদনকারীর বিনিয়োগকারী বা বিনিয়োগ গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোনও সংযুক্তি থাকতে পারবে না, এবং বিনিয়োগ হবার দুই বছর পূর্ব বা পর পর্যন্ত কোনো ধরণের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক থাকা যাবে না। এই সম্পর্ক ডিজিটাল ব্যাকগ্রাউন্ড চেক এবং হলফনামার মাধ্যমে যাচাই করা হবে। পরবর্তীতে কোনো ব্যত্যয় প্রমাণিত প্রমাণিত হলে, বিনিয়োগকারী ও গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ রেমিট্যান্স হওয়ার পর বা বাংলাদেশে আসার পর— ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে একই পোর্টালের মাধ্যমে আবেদনকারীকে প্রণোদনার জন্য আবেদন জমা দিতে হবে।
এসব আবেদন যাচাই করতে বিডা, অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কমিটি কাজ করবে। কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে, বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট তহবিল থেকে আবেদনকারীর ব্যাংক একাউন্টে স্থানীয় মুদ্রায় প্রণোদনার অর্থ পরিশোধ করবে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই প্রণোদনার অর্থ দেশের বাইরে স্থানান্তর করতে পারবে।
উল্লেখ্য, নতুন ইক্যুইটি এফডিআই বলতে বোঝায়—যখন কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের নতুন শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে সরাসরি মূলধন যোগ করে। এটি বিদ্যমান শেয়ার কেনার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে মোট নিট এফডিআই এসেছে ১২৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ১৩.২৫ শতাংশ কম। ২০২৩ সালে এই অঙ্ক ছিল ১৪৬ কোটি ডলার। একইভাবে ইক্যুইটি এফডিআই কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫৪ কোটি ডলারে, যা ২০২৩ সালে ছিল প্রায় ৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।