এফডিআই বাড়াতে করছাড় ও সহজে সেবা দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার

প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহে স্থবিরতা কাটাতে সরকার একগুচ্ছ নীতি সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে—যার মধ্যে রয়েছে সহজে সেবা দেওয়া, করছাড় ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সহজ করা। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা এ তথ্য গেছে।
এজন্য অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২৯ মে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এ কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
এ কমিটিকে আগামী ৩০ জুন জাতীয় বাজেট পাশ হওয়ার আগেই এফডিআই বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রণোদনার বিষয়ে সুপারিশ জমা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কমিটির পরামর্শ চূড়ান্ত বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান (এনবিআর) মো. আবদুর রহমান খান ও অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার।
এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুনকে কমিটিতে সদস্যসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিদেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সরকার যেসব নীতি সুবিধা দেয়, সেগুলো উদ্যোক্তারা পেতে হয়রানিতে পড়েন। আবার নীতির ধারাবাহিকতা থাকে না। কিছু সুবিধা রয়েছে যেগুলো বেশ জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পেতে হয়।
এছাড়া গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট, বন্দর ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ঘাটতি, দক্ষ শ্রমিকের অভাব রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা। ব্যাংকঋণের চড়া সুদ, দুর্বল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে দুর্নীতির সমস্যাও আছে।
ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি-র (ফিকি) সাবেক সভাপতি ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী হক চৌধুরী টিবিএসকে, 'শুঢুঁ কর্পোরেট কর কমিয়ে আর সস্তা শ্রমের কথা বলে এফডিআই আকৃষ্ট করা সম্ভব না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশই বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার উদ্যোগ নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশকেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের নীতির সাথে তুলনা করে একটা বেঞ্চমার্ক ঠিক করতে হবে।'
'অর্থনৈতিক অঞ্চল দেওয়ার সময় অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীরা কী সুবিধা পাচ্ছে, সেটা দেখতে হবে। আইন ও নীতির ধারাবাহিকতা দরকার,' বলেন তিনি।
নীতি সহায়তা প্রাপ্তি সহজ করা এফডিআইয়ের মূল চাবিকাঠি
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, নতুন নীতি সহায়তা দেওয়ার চেয়ে ইতিমধ্যে যেসব নীতি সহায়তা দেওয়া আছে, সেগুলো প্রাপ্তির জটিলতা কমানো জরুরি।
'এর আগে কর অবকাশ ও অর্থনৈতিক অঞ্চল সুবিধা দিয়েও দেখা গেছে বিদেশি বিনিয়োগ—এমনকি স্থানীয় বিনিয়োগও—আকর্ষণ করা যায়নি। এর কারণ হচ্ছে, যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সরকারের দেওয়া নীতি সুবিধা পেতে হয়, তাতে প্রচুর সময় ও খরচ লেগে যায়,' বলেন তিনি।
উদাহরণ দিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভিসা দেওয়া হয়, কিন্তু তার মেয়াদ পর্যাপ্ত নয়। আবার সিঙ্গেল এন্ট্রি ভিসা দেওয়া হয়ে থাকে বেশি। বিনিয়োগকারী যদি অবাধে যাতায়াত করার সুযোগ না পান, সেটা তার জন্য এক ধরনের প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া ট্রেড লাইসেন্স দেওয়া হয়, কিন্তু প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। একইভাবে, করমুক্ত আমদানি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু শর্ত জুড়ে দেওয়া হচ্ছে। একই ডকুমেন্ট অনলাইনে দিতে বলার পাশাপাশি হার্ডকপিও জমা দিতে বলা হচ্ছে।
'এতে সরকারের দেওয়া সুবিধার উৎকর্ষতা কমে যায়। তাই বিনিয়োগ আকর্ষণে সুবিধা দেওয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে,' বলেন তিনি।
গত ২৫ মে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এক পরিপত্রে জানিয়েছে, দ্রুত ও স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ খাতের সেবা নিশ্চিত করতে আগামী ১ জুলাই থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসহ ৪৪টি প্রতিষ্ঠানের ১৩৪ ধরনের সেবা আর ম্যানুয়ালি দেওয়া হবে না। এসব সেবা অনলাইনে দেওয়া হবে। এছাড়া ৩১ আগস্ট থেকে আরও ২৭টি প্রতিষ্ঠানের ৫৬ ধরনের সেবা অনলাইনে দেওয়া শুরু হবে।
অনেক বছর ধরেই এফডিআই প্রবাহে স্থবিরতা
২০২৩-২৪ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের হার ২৩.৫১ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ২৪.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ গত অর্থবছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমেছে।
বেসরকারি বিনিয়োগের মধ্যে এফডিআই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক বছর ধরেই এফডিআইয়ে গতি নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ (জুলাই-মার্চ) মাসে ৮৬০ মিলিয়ন ডলারের নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১.১৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ২৬ শতাং ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে মোট এফডিআই এসেছে ৪.২৭ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলারই ফেরত নিয়ে গেছে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। সেই হিসাবে গত বছর দেশে নিট এফডিআই প্রবাহ ছিল ১.২৭ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালে ছিল ১.৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দেশে ডলার সংকটের কারণে অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী তাদের মুনাফার অর্থ মূল কোম্পানিতে নিতে না পেরে পুনঃবিনিয়োগ করেছে। তা নাহলে নিট এফডিআই আরও কম হতো বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।