ট্রাম্পের ট্যারিফ বাংলাদেশের জন্য বড় আঘাত, লাভবান হবে প্রতিযোগী দেশগুলো: আরএমজি নেতারা

নতুন মার্কিন শুল্কের কারণে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (আরএমজি) শিল্পের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন শিল্প নেতারা। তারা একে 'বিনা মেঘে বজ্রপাত' হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যা বাণিজ্য ব্যাহত করতে পারে এবং মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান দুর্বল করে দিতে পারে।
বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সঙ্গে আলাপকালে স্প্যারো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, 'শুল্ক হার ৩৭ শতাংশ বাড়ানো মানে এটি অতিরিক্ত শুল্ক, যার ফলে আরএমজির তুলা-মিশ্রিত পণ্যের মোট শুল্ক ৫৪ শতাংশে (৩৭ শতাংশ + ১৭ শতাংশ) পৌঁছাবে।'
তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই সর্বোচ্চ শুল্কের শিকার দেশগুলোর একটি। এ বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের শুল্কহার চীনের তুলা পণ্যের সমপর্যায়ে পৌঁছাবে।'
ভারতসহ অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোকেও শুল্ক বৃদ্ধির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হার ভারতের তুলনায় আরও বেশি, যা ক্রেতাদের জন্য বাংলাদেশের বাজারকে কম আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে বলে শোভন ইসলাম মনে করেন।
মার্কিন শুল্ক ঘোষণা
এর আগে বুধবার (২ এপ্রিল) মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, অন্যান্য দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর যে শুল্ক আরোপ করছে, তার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রও পারস্পরিক শুল্ক [রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ] আরোপ করছে।
হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প এক পোস্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের ওপর নির্ধারতি পারস্পরিক শুল্কের তালিকা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর আরোপিত ৭৪ শতাংশ শুল্কের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ট্রাম্প আরও ঘোষণা করেন, সকল আমদানির ওপর ১০ শতাংশ বেজলাইন শুল্ক আরোপ করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিছু প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদারের ওপর আরও বেশি হারে শুল্ক বসানো হবে।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জানিয়েছে, এটি বর্তমানে মার্কিন আমদানির ওপর শুল্ক পর্যালোচনা করছে।
'জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দ্রুত শুল্ক হার যুক্তিসঙ্গত করার জন্য সম্ভাব্য বিকল্পগুলো চিহ্নিত করছে, যা সমস্যার সমাধানে সহায়ক হবে,' প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বৃহস্পতিবার সকালে ফেসবুকে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন।
নতুন সোর্সিং বিকল্প
বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক শোভন ইসলাম জানান, ক্রেতারা ইতোমধ্যেেই পণ্য সোর্সিংয়ের বিকল্প গন্তব্য হিসেবে জর্ডান, মিশর ও কেনিয়ার দিকে ঝুঁকছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা মানবসৃষ্ট ফাইবার (এমএমএফ) পণ্য উৎপাদনে দক্ষ, তবে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব আসার পর ক্রেতারা জর্ডানে তুলাভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের অনুরোধ জানাচ্ছেন, কারণ সেখানে শুল্ক হার বাংলাদেশের তুলনায় কম।'
যুক্তরাষ্ট্র জর্ডান থেকে আমদানি করা তুলাপণ্যের ওপর মাত্র ২০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে, যা দেশটিকে বাংলাদেশের তুলনায় আরও আকর্ষণীয় সোর্সিং হাব করে তুলছে।
শোভন ইসলাম সতর্ক করে বলেন, শুল্ক বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক প্রভাবের মধ্যে পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটতে পারে এবং অর্থ পরিশোধে বিলম্ব হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, অর্থপ্রদানে স্থগিতাদেশও আসতে পারে, যেমনটি মহামারির সময় দেখা গিয়েছিল।
বাংলাদেশের করণীয়
শুল্ক বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব কমাতে শিল্প নেতারা পরামর্শ দিচ্ছেন, বাংলাদেশকে দ্বিমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে—প্রথমত, তুলাসহ অন্যান্য মার্কিন কৃষিপণ্যের জন্য শূন্য-শুল্ক সুবিধা প্রদান এবং দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বৃদ্ধি।
তাদের মতে, মার্কিন কৃষিপণ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিলে ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশের পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরাসরি ক্রয় উৎসাহিত হবে, যা বাণিজ্য-উদ্বেগ কমাতে সহায়ক হতে পারে। পাশাপাশি, সামরিক সরঞ্জাম ও গোলাবারুদ আমদানি বাড়ালেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য রক্ষা সম্ভব হতে পারে।
শোভন ইসলাম উল্লেখ করেন, ট্রাম্প প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরেই বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এ ধরনের শুল্ক আরোপের পক্ষে কথা বলে আসছে।
এদিকে, শ্রীলঙ্কা ইতোমধ্যেেই মার্কিন আমদানির ওপর শূন্য শুল্ক প্রস্তাব করেছে, আর ভারতও শুল্ক আরও কমানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।
শোভন বলেন, নতুন শুল্কের ফলে সোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। 'ক্রেতাদের পছন্দের গন্তব্য হতে পারে মিশর, জর্ডান, কেনিয়া ও তুরস্ক।'
তিনি আরও বলেন, 'চীন থেকে বাংলাদেশে অর্ডার স্থানান্তর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। এমনকি, কিছু অর্ডার আবার চীনে ফিরে যেতে পারে, কারণ বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে এখন আর শুল্কের কোনো পার্থক্য নেই। সোয়েটার ও জ্যাকেট উৎপাদন এ শুল্ক বৃদ্ধির বড় শিকার হবে।'
'এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা কঠিন, তবে এ পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও শ্রীলঙ্কার জন্য মারাত্মক হতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক গণনা নিয়ে প্রশ্ন
প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন যে শুল্ক হিসাব বা পরিসংখ্যান ব্যবহার করছে, তা বাংলাদেশের প্রকৃত শুল্ক পরিস্থিতির প্রতিফলন ঘটায় না।
'ট্রাম্প প্রশাসন কেবল বিদ্যমান শুল্ক হার নয়, বরং বাণিজ্য ঘাটতি এবং রপ্তানি মূল্য বিবেচনা করে এ পরিসংখ্যান নির্ধারণ করেছে,' বলেন তানভীর।
ট্রাম্প এটিকে 'পারস্পরিক' বলে অভিহিত করলেও তানভীর বলেন, এটি বাংলাদেশের আরোপিত প্রকৃত শুল্কের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং তার [ট্রাম্প] অর্থনীতিবিদদের তৈরি একটি সূত্রের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছে।
২০২৪ সালে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ১০.৬ বিলিয়ন ডলারের সমতুল্য। এর মধ্যে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি ছিল ২.২ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি হয় ৮.৪ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৬.২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২ শতাংশ বেশি।
ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যবহৃত শুল্ক নির্ধারণের এ সূত্রটি নিয়ে একমত তানভীর এবং শোভন ইসলামও:
বাণিজ্য ঘাটতি ÷ যুক্তরাষ্ট্রে সেই দেশ থেকে আমদানি (বিলিয়ন ডলারে) → অর্ধেক হিসেবে শুল্ক
বাংলাদেশ: ৬.২ ÷ ৮.৪ = -৭৪% → [অর্ধেক হিসেবে] শুল্ক ৩৭% নির্ধারণ
ভারত: ৪৫.৭ ÷ ৮৭.৪ = -৫২.৩% → শুল্ক ২৬% নির্ধারণ
পাকিস্তান: ৩ ÷ ৫.১ = -৫৮.৮% → শুল্ক ২৯% নির্ধারণ
ইন্দোনেশিয়া: ১৭.৯ ÷ ২৮ = -৬৪% → শুল্ক ৩২% নির্ধারণ
ভিয়েতনাম: ১২৩.৫ ÷ ১৩৬.৬ = -৯০% → শুল্ক ৪৬% নির্ধারণ
বাংলাদেশের ওপর নতুন শুল্কের প্রভাব কমাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশকে অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, যুদ্ধবিমান এবং জাহাজ আমদানি বাড়াতে হবে, যাতে বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং ঘাটতি কমানো সম্ভব হয় — এমন মত দেন তানভীর।
'আলোচনা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে, তবে ট্রাম্পের জন্য কিছু না থাকলে তিনি তার অবস্থান থেকে নড়বেন না,' বলেন তানভীর 'তিনি একজন চুক্তিকারী, প্রথাগত রাজনীতিবিদ নন। বিনিময়ে কিছু পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে তাকে কিছু দিতে হবে।'
এলডিসি উত্তরণ ও নতুন শুল্কের প্রভাব
শাশা ডেনিম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, নতুন শুল্ক বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে, বিশেষ করে যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
'বাংলাদেশ এখন আমাদের প্রতিযোগীদের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, চীন থেকে বাংলাদেশে বিদেশি কোম্পানির স্থানান্তর হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও নতুন শুল্ক কাঠামোর কারণে সেটি এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
'আমাদের কর ব্যবস্থা, যা মূলত আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরশীল, এখন নতুন পরিস্থিতির আলোকে পর্যালোচনা করা জরুরি,' বলেন শামস।
তিনি আরও যোগ করেন, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন এ নতুন পরিস্থিতির অর্থ হলো উত্তরণ সহজ হবে না। ফলে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যে, উত্তরণ প্রক্রিয়া পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত কি না।'
তৈরি পোশাক খাতের ওপর প্রভাব
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী।
'যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক বাংলাদেশের আরএমজি খাতের জন্য বড় হুমকি। আমাদের প্রতিযোগী ভারত ও চীন নতুন শুল্ক কাঠামো থেকে উপকৃত হবে, কারণ তাদের হার বাংলাদেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে কম,' বলেন তিনি।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, শুল্কের খরচ সাধারণত ক্রেতাদের ওপর বর্তায়। যদি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা দেখেন যে, নতুন শুল্কের কারণে পণ্যের দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে, তাহলে তারা বিকল্প উৎস খুঁজতে বাধ্য হবেন।
রাকিবুল আরও বলেন, 'উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যেই বাড়ছে, কারণ মজুরি বৃদ্ধি এবং ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ছে।'
'আমরা পাইপলাইনে থাকা অর্ডার বজায় রাখতে ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। তারাও পরিস্থিতি মূল্যায়ন করছে এবং একটি কার্যকর সমাধান খুঁজছে,' বলেন তিনি।
মার্কিন পণ্যের ওপর বাংলাদেশ কর্তৃক আরোপিত ৭৪ শতাংশ শুল্কের বিষয়ে রাকিবুল উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খুব কম আমদানি করে।
'এত বেশি শুল্ক আরোপ করা অবাস্তব, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্র এ নতুন শুল্ক কাঠামো চালু করতে বাধ্য হয়েছে,' মন্তব্য করেন তিনি।
রাকিবুল সরকারকে শুল্ক নীতি পুনর্মূল্যায়ন করার এবং নতুন শুল্ক প্রত্যাহারে যুক্তরাষ্ট্রকে রাজি করানোর জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জোর দেওয়ার আহ্বান জানান।
'অন্যথায়, আমাদের তৈরি পোশাক খাত গুরুতর সংকটে পড়বে,' তিনি সতর্ক করেন।