বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প

অন্যান্য দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর যে শুল্ক আরোপ করেছে, তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে 'পারস্পরিক শুল্ক' বসানোর ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। হোয়াইট হাউজে ফিরে আসার পর তার এ ধরনের বাণিজ্যনীতির ফলে চলমান বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ আরও তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বুধবার (২ এপ্রিল) হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে এক অনুষ্ঠানে ট্রাম্প কোন দেশের ওপর কত পারস্পরিক শুল্ক [রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ] আরোপ করছেন, তার একটি তালিকা তুলে ধরেছেন।
সেখানে মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ওপর ২০ শতাংশ শুল্ক বসানোর তথ্য উল্লেখ ছিল।
ট্রাম্পের প্রদর্শিত তালিকায় কোন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর কত শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, সে তথ্যও রয়েছে। তালিকার তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর বাংলাদেশের আরোপকৃত শুল্কের হার ৭৪ শতাংশ।
ট্রাম্প আরও জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে সব আমদানির ওপর ১০ শতাংশ বেজলাইন শুল্ক বসাবেন এবং দেশটির বড় বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর ওপর আরও বেশি শুল্ক আরোপ করবেন।
পারস্পরিক শুল্ক কী?
প্রকৃত পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করার নিয়ম মানা হলে অন্য দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর প্রোডাক্ট-বাই-প্রোডাক্ট ভিত্তিতে যে পরিমাণ শুল্ক আরোপ করে, যুক্তরাষ্ট্রেরও একই হারে ওই দেশের পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করার কথা।
অর্থাৎ, যদি কোনো দেশ আমেরিকায় তৈরি জুতার ওপর ছয় শতাংশ শুল্ক ধার্য করে, তাহলে ট্রাম্পও সেই দেশে তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত জুতার ওপর একই হারে শুল্ক বসাবেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও তার বাণিজ্যিক অংশীদারেরা একই পণ্যের ওপর একে অপরের জন্য ভিন্ন হারে শুল্ক নির্ধারণ করে। যেমন, জার্মানি যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত গাড়ির ওপর যে শুল্ক ধার্য করে, তা জার্মানি থেকে আমদানিকৃত গাড়ির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বসানো শুল্কের তুলনায় বেশি।
'পারস্পরিক শুল্কের অর্থ হলো যদি কোনো দেশ নির্দিষ্ট পণ্যের ওপর আমাদের চেয়ে বেশি শুল্ক ধার্য করে, তাহলে আমরাও সেই একই হারে তা বাড়িয়ে দেব,' সিবিএস মানিওয়াচকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন বামঘেঁষা পাবলিক পলিসি থিংকট্যাংক গ্রাউন্ডওয়ার্ক কোলাবোরেটিভ-এর নীতি ও অ্যাডভোকেসি প্রধান অ্যালেক্স জ্যাকেজ।

তবে হাজারো পণ্যের শুল্ক হার নির্ধারণকারী জটিল বিভিন্ন নীতিমালার কারণে এ নীতি বাস্তবায়ন করা খোদ মার্কিন প্রশাসনের জন্যও প্রায় অসম্ভব একটি কাজ বলে উল্লেখ করেন তিনি।
'প্রতিটি পণ্যের জন্য প্রতিটি বাণিজ্য অংশীদারের সঙ্গে পারস্পরিক শুল্ক নির্ধারণ করার প্রশাসনিক সামর্থ্য আমাদের [যুক্তরাষ্ট্রের] নেই,' বলেন জ্যাকেজ।
যেভাবে পারস্পরিক শুল্ক আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র
সম্পূর্ণ পারস্পরিক শুল্ক আরোপের পরিবর্তে হোয়াইট হাউজ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা থাকা দেশগুলোর জন্য নির্দিষ্ট শুল্ক হার ঘোষণা করেছে।
বুধবার ট্রাম্প জানিয়েছেন, তার প্রশাসন অন্যান্য দেশগুলোর আরোপিত শুল্কের আনুমানিক অর্ধেক হারে পারস্পরিক শুল্ক বসাবে।
জানা গেছে, মুদ্রা কারসাজি, শুল্ক এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতাসহ অন্য দেশগুলোর 'অন্যায্য' বাণিজ্য অনুশীলনের মোট হিসাব নির্ধারণ করার জন্য হোয়াইট হাউজ একটি সূত্র ব্যবহার করেছে।
যেমন, যুক্তরাষ্ট্র চীনের ৬৭ শতাংশ শুল্কহারের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি করা পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। একই হিসেবে বাংলাদেশের ৭৪ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক দেখিয়েছে হোয়াইট হাউজ।
'তারা সম্ভবত এমন একটি মিশ্র হার নির্ধারণ করবে, যা নির্দিষ্ট পণ্যের ভিত্তিতে পারস্পরিক না হলেও সামগ্রিকভাবে পারস্পরিক বলে বিবেচিত হবে। হোয়াইট হাউজ হয়তো যুক্তি দেখাবে, তাদের [অন্য দেশের] শুল্ক আমাদের তুলনায় গড়ে ১০ শতাংশ বেশি, তাই আমরা সব পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ শুল্ক বসাব,' বলেন এর আগে বাইডেন প্রশাসনে অর্থনৈতিক নীতিবিশ্লেষক হিসেবে কাজ করা জ্যাকেজ।
প্রভাব
এ উচ্চহার-শুল্ক আরোপের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বের বৃহত্তম ভোক্তা অর্থনীতিতে নতুন বাধা সৃষ্টি হবে এবং কয়েক দশক ধরে চলা বিশ্ববাণিজ্যের উদারীকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। ট্রাম্পের এ পদক্ষেপের ফলে আমেরিকার বাণিজ্য অংশীদারেরা পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পারে, যা সাইকেল থেকে শুরু করে ওয়াইন পর্যন্ত বিভিন্ন পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিতে পারে।
'এটি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা,' হোয়াইট হাউসের রোজ গার্ডেনের অনুষ্ঠানে বলেন ট্রাম্প।
তার প্রদর্শিত পোস্টারে দেখা যায়, অন্যান্য এশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ, মিয়ানমারের ওপর ৪৪ শতাংশ, ভিয়েতনামের ওপর ৪৬ শতাংশ, তাইওয়ানের ওপর ৩২ শতাংশ এবং কম্বোডিয়ার ওপর ৪৯ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক বসাবে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে শুল্কের এ নতুন ঘোষণার বিস্তারিত তথ্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ট্রাম্প তার দীর্ঘদিনের অভিযোগ পুনরাবৃত্তি করে বলেছেন, বিশ্ববাণিজ্যের কারণে মার্কিন কর্মী ও কোম্পানিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মার্কিন প্রশাসন জানিয়েছে, ট্রাম্পের ঘোষণার পরই নতুন শুল্ক কার্যকর হবে, তবে আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞপ্তি এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে প্রশাসন জানিয়েছে, ট্রাম্পের ঘোষিত গাড়ি আমদানির ওপর পৃথক একাধিক শুল্কহার ৩ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে।
ট্রাম্প ইতোমধ্যে চীন থেকে আমদানির ওপর ২০ শতাংশ এবং ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন এবং প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যে এ শুল্কহার বাড়িয়েছেন।
তার উপদেষ্টারা বলছেন, এ শুল্কহার যুক্তরাষ্ট্রে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন সক্ষমতা ফিরিয়ে আনবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে দিয়ে বলছেন, এ শুল্ক বিশ্ব অর্থনীতির গতি শ্লথ করতে পারে, মন্দার ঝুঁকি বাড়াতে পারে এবং মার্কিন পরিবারগুলোর গড় ব্যয় হাজার-হাজার ডলার বাড়িয়ে দিতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ট্রাম্পের হুমকিমূলক এসব ঘোষণার কারণে তাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
শুল্ক বিষয়ক উদ্বেগ ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে উৎপাদন কার্যক্রমকে ধীর করে দিয়েছে। পাশাপাশি দাম বাড়ার আশঙ্কায় গ্রাহকেরা আগেভাগে কেনাকাটা করায় গাড়ি ও অন্যান্য আমদানিকৃত পণ্যের বিক্রয় বেড়ে গেছে।
বিনিয়োগকারীরা ট্রাম্পের ঘোষণার অপেক্ষায় থাকায় আর্থিক বাজারও অস্থিতিশীল ছিল। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন শেয়ারবাজারের মূল্য প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার কমেছে।