সেই ‘কিচেন-সিঙ্ক রিয়েলিজম’—শ্রমিকের দেহ ভেজে আমাদেরই ঘামে
"চলো একটা ছোট্ট খেলা খেলি! (খেলাটা হলো এই) চলো ধরে নিই আমরা মানুষ। ধরে নিই আমরা আসলেই জীবিত!"- জন অসবর্ন (লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার)
প্রথম ইন্ধনঃ
তখন স্কুলবালিকা লুকিয়ে বাবার পড়া 'দেশ' পত্রিকা অবেলায় খুলে দ্যাখে—বিজ্ঞাপনগুলো থেকে নতুন বইয়ের নাম টুকে রাখে, বিস্মিত চোখে দ্যাখে সুধীর মৈত্র কিংবা সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়ের অলঙ্করণ। পেছনের পাতায় দ্যাখে সিনেমার আলোচনা- শাবানা আজমীর 'এক পল'-এ গানগুলো কেন বাহুল্য, 'যশুয়া দেন অ্যান্ড নাউ'-এর স্থিরচিত্র। তখনো বিদেশ মানে ইনল্যান্ডের লাল নীল বর্ডার দেয়া খাম, চকিত পোস্টকার্ড, প্রবাসী আত্মীয়র স্যুটকেসে সাবানের দুর্নিবার সুগন্ধ, টিভি-অ্যান্টেনায় এলুমিনিয়ামের সরা লাগিয়ে ঝিরঝিরে দূরদর্শনে রামানন্দ সগরের 'মহাভারত'। বহির্বিশ্ব তখনো আঠা-আঁটা খামের মতো পুরভরা, প্রেরকের কাছ থেকে মেয়েটির ঠিকানা অব্দি এসে পৌঁছায়নি। তেমনি এক দিনে সে পড়ে ফেললো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মধুর কলমে পশ্চিমে-প্রবাসে তাঁর দেখা একটি নাটকের গল্প, নাম 'আ টেস্ট অভ হানি'—শেষদৃশ্যে গর্ভবতী জো (নায়িকা) একা ঘরে মেঝেয় দাঁড়িয়ে অনাগত সন্তানকে নার্সারি রাইমস শোনাচ্ছে। ওরকম অস্পষ্ট, বিবিধার্থক সমাপ্তির কথা মেয়েটি কখনো পড়েনি। বহুবছর পর মেয়েটি নর্থ লন্ডনের একটি পাবলিক লাইব্রেরির কাছে এক কামরার ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। লাইব্রেরি বোঝাই ভিডিও ক্যাসেট আবিষ্কার করে সে, একদিন যেসবের একটির গল্প সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শুনিয়েছিলেন। জানতে পারে- এই ঝঁরার চলচ্চিত্রীয় নাম 'কিচেন-সিঙ্ক ড্রামা/রিয়েলিজম'। জীবনের গাঢ় আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে ছায়া-উতরোল তরঙ্গের ভিড়, সব রাঙা কামনার শিয়রে জেগে থাকা ধূসর দেয়ালে মাথা ঠোকাঠুকি।
ইটস গ্রিম আপ নর্থঃ
ইংরেজিতে একটি বুলি প্রচলিত আছে, 'ইটস গ্রিম আপ নর্থ'- উত্তরে বড় বালাই। গানও আছে এই শিরোনামে, গানের লিরিকে উত্তর ইংল্যান্ডের শহরগুলোর নাম, ট্রেনের হুইসল, মালগাড়ির শব্দ, বাতাসের হাহাকার, আর কাকের ডাক। ঐ হলো উত্তুরে শহরগুলোর সংক্ষিপ্ত নির্যাস। জে বি প্রিস্টলী 'ইংলিশ জার্নি' বইটিতে লিখেছিলেন- উত্তরের শহর নাকি মানবতার শত্রু হিসেবে প্ল্যান করে তৈরি। আকাশ-বাতাস পম্পেইয়ের আকাশের মতো ভস্ম আর সালফারের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। গ্রামের মতো অনুন্নত শহর, দুচারখানা দোকানপাট, একখানা শুঁড়িখানা, অস্বাস্থ্যকরভাবে গায়ে-গায়ে লাগা বাড়ি। ধরা হয়, এই বইটিই নর্থ ইংল্যান্ডের বিদঘুটে চেহারার স্টেরিওটাইপ তৈরির জন্য দায়ী।
এমনিতেও দক্ষিণের শহরগুলোর তুলনায় উত্তরের এলাকাগুলো অনগ্রসর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইংল্যান্ডের কারখানার মজদুর আর খনিশ্রমিকদের বাস। ল্যান্ডস্কেপ সেখানে মুরল্যান্ড তথা বাদাজমিনে ভরা। সুমেরুবায়ুর তাড়নে প্রবল শীত, গরমকালেও ঠান্ডা। ধূসর আকাশে মধুমেহরোগী মেঘ- পেচ্ছাপ করেই চলেছে। হাঁসের ডিম ফুটে চিরদিন ওখানে হাঁস জন্মেছে, গরীবের ডিম ফুটে জন্মেছে তস্য গরীব। জীবন সেখানে কঠোর, নির্মম, ক্রুর; দারিদ্র অপরিসীম, জীবন-বদলের সম্ভাবনা ক্ষীণ, ওয়ার্কিং-ক্লাসের জীবন স্থবির ক্রন্দনে ভরা, ভবিষ্যতের স্বপ্নগুলো অধরা। এই পটভূমিকে আশ্রয় করে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে বৃটিশ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে কিচেন-সিঙ্ক ড্রামার উদ্ভব।
শুরুর ইতিহাসঃ
জন ব্র্যাটবির এক্সপ্রেশনিস্ট পেন্টিং থেকে 'কিচেন-সিঙ্ক রিয়েলিজম' স্টাইলের উদ্ভব, ব্র্যাটবির বিষয়- সাধারণ মানুষের জীবনধারা, তাদের মরিয়া- হতাশ- কুৎসিত- ব্যগ্র চেহারা। তাদের ছোট্ট ঘর উপচে উঠছে ময়লায়- অপরিচ্ছন্নতায়- এলোমেলো ফেলে রাখা বাসনকোসন-খাবারদাবারে- ছেঁড়া তোশকে- ভাঙা আসবাবে (দ্রষ্টব্য-'ইন্টেরিয়র উইথ ফায়ারপ্লেস অ্যান্ড উইন্ডো অ্যাট গ্রিনিচ', 'জীন অ্যান্ড স্টিললাইফ ইনফ্রন্ট অফ আ উইন্ডো', 'বেবি অ্যাট টেবল উইথ স্টিললাইফ')। মামুলি জীবনের টুকরোটাকরাকে অবিনশ্বর করে তুললেন ব্র্যাটবি, ডেরেক গ্রিভস, এডওয়ার্ড মিডলডিচ এবং জ্যাক স্মিথ। সমালোচক ডেভিড সিলভেস্টার 'এনকাউন্টার' ম্যাগাজিনে (ডিসেম্বর ১৯৫৪) প্রথম এঁদের নাম দিলেন 'কিচেন-সিঙ্ক স্কুল', এ চারজন 'ব্যোও আর্টস' ধারার শিল্পীর আপত্তিসত্ত্বেও এই লেবেল চিরস্থায়ী হয়ে গেল। জ্যাক স্মিথ বলেছিলেন, ১৯৪০-এর ফরাসী ও বিলেতি চিত্রকলায় সৃজনী শক্তির অভাব তাঁকে বিচলিত করেছিল বলে তিনি বিষয়বৈচিত্রের সন্ধানে ফিরেছিলেন তাঁর আপন পারিপার্শ্বিকে, প্রাসাদের বাসিন্দা হলে হয়তো ঝাড়বাতি আঁকতেন… সামান্যতে কোনো অসামান্য সামাজিক বাণী গেঁথে দেননি তিনি।
পঞ্চাশের দশকে তরুণ ওয়ার্কিং ক্লাস নাট্যকাররা এমন সব নাটক লিখতে শুরু করলেন, যার দ্বন্দ্ব-সংঘাত তাঁদের অতিপরিচিত। জন অসবর্ন লিখলেন, 'লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার', আর্নল্ড ওয়েস্কার লিখলেন ট্রিলজি। টেনেসি উইলিয়ামসের 'আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার'-এর স্ট্যানলি কাওয়ালস্কির সঙ্গে 'লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার'-এর জিমি পোর্টারের কোথাও গিয়ে ভারী মিল। শীল্য ডেলানি মাত্র আঠার বছর বয়সে লিখলেন- 'আ টেস্ট অভ হানি'।
ধরা হয় সিনেমায় 'আ ট্রি গ্রোউজ ইন ব্রুকলিন' (১৯৪৫), 'ইট অলওয়েজ রেইনজ অন সানডে' (১৯৪৭), 'ওম্যান ইন আ ড্রেসিং গাউন' (১৯৫৭) দিয়ে সোশ্যাল রিয়েলিজমের এই ধারাটির শুরু। মহাযুদ্ধপরবর্তী বৃটিশ নিউ ওয়েভ সিনেমার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধারা—অস্কারে আলোড়ন তোলে, বক্স অফিসেও সাড়া ফেলে, আর্টহাউজ ফিল্মের সরু ব্যালকনিতে আটকে থাকে না। এ ধারার অন্যতম পরিচালক কেন লোচ কিচেন-সিঙ্ক লেবেলটি পছন্দ করেননি, বিবিসিকে বলেছিলেন- নামটায় কোথাও হ্যাঁটা করার ব্যাপার আছে।
'ইট অলওয়েজ রেইনজ অন সানডে'তে ফেরারী আসামী দশবছর জেল খাটবার পর জেল থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় বেথনাল গ্রীনে (ছোটখাট শহর, সরু রাস্তার ওপর দিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ), বহুকাল আগের প্রেমিকার উঠানের অ্যান্ডারসন শেল্টারে। প্রেমিকা এখন স্ত্রী, মা ও সৎমা, পরনে ঘরোয়া পেটিকোট (এমনিতে নায়িকা হতো অনূঢ়া, পরনে চমৎকার ফ্রক, চুল ফাঁপানো, পর্দায় আসামাত্র সিটি বাজাতো দর্শক)। কিন্তু কোথাও মায়া রহিয়া যায় বলে, অসামান্য ঝুঁকি নিয়ে প্রেমিকা তাকে আশ্রয় দেয়, খাবার দেয়, গায়ের জামা শুকোতে দেয়, নিজের বিবাহশয্যায় তাকে ঘুম পাড়িয়ে তালা মেরে রেখে দেয়। পুরুষ তেমন কোনো প্রেমবশত মেয়েটির কাছে আসেনি, সে কেপটাউন পালাবে, অথচ হাতে পয়সাকড়ি নেই। একদা নিজের ডাকাতির মালসামান থেকে প্রেমিকাকে সে আঙটি উপহার দিয়েছিল, সেই আঙটি বের করে দেয় মেয়েটি, দুঃসময়ের রাহাখরচ। পুরুষ নিজের দেয়া সেই বাগদানের আঙটিটি চিনতে পারে না। শেষ অব্দি মেয়েটি সবদিক রক্ষা করতে পারে না, ধরা পড়ে যায়। হাসপাতালে তার শয্যাপাশে স্বামীটিকে দেখা যায় ঠিক 'ব্রিফ এনকাউন্টার'-এর স্বামীটির মতো- শান্ত বিচক্ষণ মর্যাদামন্ডিত।
কিচেন-সিঙ্ক চরিতঃ
পঞ্চাশ-ষাটের দশকের সেই সময়টাতে বৃটেনের তরুণরা সামাজিক প্রচলনকে অগ্রাহ্য করছে, নোয়েল কাওয়ার্ডের পরিপাটি বসার ঘরে মঞ্চস্থ জীবননাটক তাদের জীবনকে ধারণে অপারগ। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবাহ ধ্বসে পড়ছে, গ্রাম মরছে- 'হাউ গ্রীন ওয়াজ মাই ভ্যালি'র মনোরম গ্রামজীবন আর নেই, শহর বিক্ষুব্ধ, বৃটিশ সীসাইড তার আকর্ষণ হারাচ্ছে, পিংক ফ্লয়েডের সাইকেডেলিক সুর ভাসছে বাতাসে। কিচেন-সিঙ্ক ড্রামা সেই সময়ের সন্তান। এতে কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে- যেমন, ক্ষুব্ধ পুরুষ, মানুষের উচ্চাকাঙ্ক্ষা, চপলচিত্তের হঠকারিতা, মফস্বলে দিনযাপনের ক্লান্তি, বেকারত্ব, সম্পর্কের অসঙ্গতি, স্বপ্নভঙ্গ। তবে এর মূলনায়ক দারিদ্র। মানুষ পড়ে আছে নালা-নর্দমায়, অথচ তাকিয়ে রয়েছে আকাশের অপ্রাপনীয় তারার দিকে…এইই কিচেন সিঙ্কের সংঘাতময় মূলসুর।
সিনেমাগুলো শাদাকালোয় ধারণকৃত, চরিত্রগুলোর অভিনয় অত্যন্ত টানটান। নাটক বা উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে তৈরি বলে সংলাপ চাবুকের মতো সপাট এবং আঞ্চলিকভাষায় রচিত। গভীর দুঃখে মানুষ যেমন অনেকসময় হেসে ফেলে, ট্র্যাজেডিকে খানিকটা কমেডি বলে মনে হয়, সেরকম তুখোড় হিউমার রয়েছে এসব সিনেমায়, মনে করে দেখুন আলুভাজাকে চুরুটের ভঙ্গিতে ফোঁকা 'বিলি লায়ার'কে। ঘ্যানঘ্যানে জীবন নিয়ে রচিত হলেও কিচেন-সিঙ্ক ধারার মুভিগুলো অত্যন্ত স্মার্ট, চৌম্বক ও ক্যারিশ্ম্যাটিক। স্পর্শবোধ্য (ট্যাকটাইল)- রাস্টিক তার সুষমা। বড়পর্দার বিনোদনধর্মী সিনেমার সৎভাই এই কিচেন-সিঙ্ক, অস্বস্তিকর থিম, শহরের চাকচিক্যহীন লোকেশন। সদাবিদ্যমান হতাশা তো আছেই, সাংঘর্ষিকভাবে আছে এনার্জি—তীব্র সংলাপের এবং শরীরী ভয়াবহতার। সহসা সমাপ্তি এসব সিনেমার বৈশিষ্ট্য, আসল জীবনে যেমন কখনো নটে গাছ মুড়োয় না, গল্প ফুরায় না তেমন।
পুরুষ চরিত্রঃ
কিচেন সিঙ্ক রিয়েলিজমের কেন্দ্রে আছে পুরুষ।'ইট অলওয়েজ রেইনজ অন সানডে', 'আ টেস্ট অভ হানি', 'জর্জি গার্ল', 'পুওর কাউ' অবশ্য নারীকেন্দ্রিক। এ পুরুষ 'অ্যাঙরি ইয়াং ম্যান', সংক্ষুব্ধ তরুণ- স্বার্থপর, মিথ্যেবাদী, স্বপ্নবাজ, পলায়নপর; নিজেরই ভাষ্যমতে যার সবচেয়ে বড় পারঙ্গমতা- বিবাদ করা ('অ্যালফি'তে অবশ্য ব্যতিক্রম)। তারা কেউ কারখানার শ্রমিক, কেউ বরস্টালের উচ্ছন্নে যাওয়া কিশোর, কেউ খনিশ্রমিক থেকে রাগবী খেলোয়াড়, কেউ ফিউনারেল পার্লারের কেরাণী। চরিত্রগুলো মূলত ভাড়াটে, চিলেকোটার বাসিন্দা ('লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার'), এক কামরার বাসিন্দা ('দ্য এল-শেপড রুম'), টেরাসড হাউজের বাসিন্দা ('আ প্লেস টু গো'), কেউ লিভ-ইন ল্যান্ডলেডির সঙ্গে একই বাড়িতে থাকে ('দিস স্পোর্টিং লাইফ')। অবসরে এরা পাড়ার ঘিঞ্জি শুঁড়িখানায় বা পাবলিক হাউজে (পাবে) গিয়ে সস্তায় আকন্ঠ মদ গেলে। ভিক্টোরিয়ান কারখানায়/ খনিতে/ অফিসে/ খোলাবাজারে কানাগলির মতো সম্ভাবনাহীন 'ডেড-এন্ড জব' করে। এরা যেন ম্যাক্সিম গোর্কির সেই পাভেল ভ্লাসভের ('মা' উপন্যাসের নায়ক) বিলাইতি ভাই।
কর্তৃপক্ষের প্রতি এদের বেজায় রাগ আর ঘৃণা, বিপাকে পড়লে কল্পনায় স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে প্রতিপক্ষকে- নিজেকে ভাবে সর্বক্ষমতাশীল জেনারেল/প্রধানমন্ত্রী/ফুরার ('বিলি লায়ার')। এদের চোখে- "সমাজে নিখুঁত অন্যায্যের প্রচলন রয়েছে, ভুল মানুষরা ক্ষুধায় কাতর, ভুল মানুষরা একে অপরকে ভালোবাসছে, ভুল মানুষরা মরছে!" গ্রামার স্কুলে পড়ে বা গ্র্যাজুয়েট হবার পরও এরা চাকরি পায় না, তাই সপ্তাহের হাটবারে বেচাকেনা করে, আর্থসামাজিক উত্থানের সিঁড়িটাকে খুঁজে পায় না বলে হাতড়ে বেড়ায় রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্বের খোঁজ।
নারী যদি তাকে একান্তে অস্বীকার করে, রুচিহীন বা পংক্তিহীন মনে করে, সে তাকে আঘাত করতে দ্বিধা করে না—'দিস স্পোর্টিং লাইফ'-এর নায়ক বাড়িউলি নায়িকাকে নিয়মিত শারীরিক আঘাত ও ধর্ষণ করে, 'লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার'-এ স্বামী স্ত্রীকে অভিশাপ দিয়ে বসে- সে যেন গর্ভের শিশুকে হারায়! 'আ কাইন্ড অভ লাভিং'-এ মেয়েটির মা অসভ্য জামাইটিকে সইতে পারে না- এই সহনশীলতার অভাব আর রুচির দ্বন্দ্ব বিয়েতে চিড় ধরায়। বিরাট পশুসুলভ পুরুষত্বের প্রতীক এমন নায়কদের আমরা খুঁজে পাই এসব মুভিতে- যেমন, রিচার্ড হ্যারিস কিংবা রিচার্ড বার্টন। নারীর প্রতি কেন তার এই সহিংসতা? কারণ নারীও তার জীবনে একটি বিপুল প্রশ্নবোধক চিহ্ন, অধরা স্বপ্ন, অসহায়তার কানাগলি, কখনো স্বপ্নহীন আপোষ, কখনো উপরে উঠবার সিঁড়ি। ভয়ানক বাস্তবতার ঠিক পাশটিতেই জেগে থাকে পুরুষের একরকম দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ('দিস স্পোর্টিং লাইফ', 'রুম অ্যাট দ্য টপ', 'স্যাটারডে নাইট সানডে মর্নিং'), হঠকারী অস্থিরতা ('আ কাইন্ড অভ লাভিং') আর পলায়নপর মনোবৃত্তি ('বিলি লায়ার'); "দূর আকাশের তরে বুকে তোর তুলে যায় নেশাখোর মক্ষিকার তৃষা!", অসহনীয় দারিদ্রের ভিতর ঐ স্বপ্নই তাদের জীবনে ফাগুয়ার বর্ণিল উৎসব জাগিয়ে তোলে।
কিচেন-সিঙ্ক ড্রামার সবকয়টি দেখবার পর আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, ষাট-সত্তুরের দশকে যেসব বৃটিশ সিরিয়াল কিলারের উত্থান ঘটেছে (মুর মার্ডারার, ইয়র্কশায়ার রিপার, জন ক্রিস্টি, ফ্রেড ও রোজ ওয়েস্ট দম্পতি), তাদের জীবন ঐরকম কিচেন-সিঙ্ক ড্রামার মতো পটভূমিতে উৎপন্ন হয়েছে। বাস্তবে একদিন সেই ক্রমবিকাশ (!) ড্রামার ভয়াবহতাকে অনায়াসে ছাড়িয়ে গেছে, 'স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন' হয়ে উঠেছে।
নারী চরিত্রঃ
এবার আসুন দেখি কিচেন-সিঙ্ক ড্রামার নারীচরিত্রদের, 'লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার'-এর নায়ক যাদেরকে 'পরিশীলিত কসাই' মনে করতো। জেবি প্রিস্টলি তাঁর 'ইংলিশ জার্নি' পুস্তকে যাঁদের ছবি এঁকেছিলেন- অবিন্যস্ত নোংরা কাপড়চোপড় পরে তেমনি আরেকটি নমুনার সঙ্গে নিজের দোরগোড়ায় কোন্দলরত, কাদামাটিতে খেলতে থাকা বাচ্চাদের ক্রমাগত গালাগালিরত। প্রেমিকার কয়েকটি রূপ। স্বভাব-দ্বিচারী পুরুষের জীবনে যুগপতভাবে দুজন অন্তত নারী, একজন তার স্বপ্নের আর সাংসারিক সার্থকতার স্বরূপ- সাধারণত সলজ্জ কুমারী ও অর্থবিত্তশালী পরিবারের সন্তান; আরেকজন শরীরের সঙ্গিনী- বিধবা-বেওয়া- বিবাহিত জীবনে অসন্তুষ্ট আর বয়সের পার্থক্যের টানাপোড়েনে ক্লান্ত-উদ্বিগ্ন ('স্যাটারডে নাইট সানডে মর্নিং', 'রুম অ্যাট দ্য টপ', 'দিস স্পোর্টিং লাইফ')। 'বিলি লায়ার'-এ তৃতীয় নারীও আছে, যে স্বপ্নের মতো ছনছনে হাতছানি দেয়, বড় সম্ভাবনা ও ঝক্কির দিকে পুরুষকে আকর্ষণ করে। নারী কখনো আবেগহীন, নিরুচ্চার, অধরা ('দিস স্পোর্টিং লাইফ', 'লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার')। 'দিস স্পোর্টিং লাইফ'-এর বাড়িউলি নায়িকা অগ্রসর পুরুষকে ক্রমাগত উপেক্ষা ও অস্বীকার করে, প্রকাশ্যে ঘৃণাও করে। পুরুষের রুচিহীনতা- স্বাস্থ্য- সক্ষমতা সবই নারীর চোখে কাঁটার মতো ঠেকে। পুরুষ তত তার দিকে ধাবিত হয়, উপহার কিনে দেয়, তার বাচ্চাদের আদর করে, ভালোবাসা- যৌনতা আর জবরদখলের এক জটিল খেলা চলে। এই জেদ সমারসেট মমের পাঠকদের পরিচিত, 'অফ হিউম্যান বন্ডেজ'-এ তিনি এমন একটি নায়ককে দেখিয়েছিলেন, সেখানে অবশ্য নায়িকা সহিংস আচরণ করতো, নায়ক নয়। বিত্তশালী নয়, তবু অর্থবহ- রুচিশীল- সম্মানিত একটি জীবনের তৃষ্ণা আছে, এমন নারীকে প্রায়ই কিচেন-সিঙ্ক মুভিতে আঘাত পেতে দেখি। পুরুষ যদি টের পায়, প্রিয় নারী কোথাও গিয়ে তার চেয়ে উন্নত, উচ্চপংক্তির, মার্জিত, আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন, তখন তার সহিংসতা এক ভয়ানক মাত্রা পায়, গরিমা দেখলেই অধমর্ণ পুরুষ তা ভাঙতে উদ্গ্রীব। 'ইট অলওয়েজ রেইনড অন সানডে'তে অতিষ্ট যুবতীরা সৎমায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে বড় বিরক্তিতে ঘর ছেড়ে যায়, কিন্তু বাইরে বৈরী প্রকৃতি, কোনো যাত্রীছাউনি অব্দি নেই যার ছাদকে আশ্রয় ভাবা যায়, কোনো প্রেমিক নেই যে আপন স্ত্রী-পুত্র-কন্যার আশ্রয় ছেড়ে তার সঙ্গে ভেসে যাবে, এমন কোথাও সে ঘর ভাড়া করে চলে যেতে পারে না যেখানে সে স্বাধীনা, ফলে তাকে ফিরতে হয় ঘরে। গৃহহীনতার প্রসঙ্গ আছে 'ক্যাথি কাম হোম'-এও। কখনো নারী চপলা, এক সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কে সে ভেসে চলে ('পুওর কাউ')। শূন্যগর্ভ সংসারজীবন, আশাহীন গন্তব্যহীন জীবনযাত্রা, পুরুষত্বহীন সঙ্গী, প্রখর দারিদ্র- এতসবের পরেও নারীর জীবনে সুন্দর আর শুভ চলিষ্ণু, তার ভালোবাসার জেদ দুর্মর ('দ্য ফ্যামিলি ওয়ে', 'দ্য এল শেপড রুম')।
মা তখনো একান্নবর্তী পরিবারের মেরুদন্ড, অবিরাম রুটি-মাখন সানডে-রোস্টের যোগানদাতা, সন্তানদের ন্যায়পরায়ণতার কাণ্ডারি। সন্তান পলায়নপর, পরিবর্তনে উদ্গ্রীব; কিন্তু মা তখনো নিজগৃহের মতোই শেষ স্যাংচুয়ারি। ঘর-সংসারের কনসেপ্ট ভেঙে যাবার পরেও যে ভাগশেষ রয়ে যায়। পুত্রের বড়লোকের মেয়েকে ফাঁসিয়ে সামাজিক উত্তরণের ইচ্ছায় মা বাধ সাধছে বা প্রশ্ন করছে ('রুম অ্যাট দ্য টপ', 'লুক ব্যাক ইন অ্যাঙ্গার'), ফলে পুরুষ তাকে মনে করছে "ধড়ের ওপর থেকে বাকিটা মৃত" ('স্যাটারডে নাইট সানডে মর্নিং')। এসময়ের জগতবিচ্ছিন্না স্ত্রী ও বৃদ্ধা মায়ের জীবনের বেদনা নিয়ে অনবদ্য মুভি 'দ্য হুইসপারারস'।
শিশুঃ
১৯৬৭-এর অ্যাবর্শন অ্যাক্ট হবার আগের ইংল্যান্ড, অবিবাহিত মায়ের গর্ভে জেগে উঠছে সন্তান ('আপ দ্য জংশন'), সে কি বাঞ্ছিত আদরের পুত্তলি নাকি দ্রুত বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার কারাদন্ড? বিলেতি শিশুরা তখনো পথের পাশে অবেলায় দিব্যি বসে থেকে দুনিয়ার তামাশা দ্যাখে, ভারী মনোযোগে দাঁতে কুরে আপেল খায়, পকেট মারে, মার্বেল খেলে, বোমার আঘাতে ছাতু হওয়া ভিটেগুলোর ধ্বংসস্তূপে চোর-পলান্তি খেলে, স্কুল পালায় অথবা স্কুলমাস্টারের বেত খেয়ে এসে ঘরে হাতে হাতে চড়চাপড় খায় ('কেস'), কেউ পড়শির বাসা থেকে ফিরে অবোধ বিস্ময়ে বলে- "দারুণ একটা খেলা শিখেছি দামড়া রনের কাছে, ও নিজেই খেলাটা আবিষ্কার করেছে, খেলাটার নাম সেক্স ম্যানিয়্যাক!" ('দ্য অ্যাংরি সাইলেন্স') তাদের ধুলোমাখা সিকনি-মোছা মুখ, চুলে বৌল-হেয়ারকাট (বাটি-ছাঁট)। তখন কেবল মুর মার্ডারারদের শিশু-খুনের ঘটনায় জেগে উঠেছে ব্যথিত ইংল্যান্ড, আবিষ্কার করেছে শিশুদের কেউ অত সহজে মেরে ফেলতে পারে।
কিচেন-সিঙ্কের শিশুরা শৈশব থেকে নির্ভুলভাবে জানে দুটি শব্দ—রাগ আর অসহায়ত্ব, দশ বছর বয়স না হতেই ভালোবাসা, হঠকারিতা আর মৃত্যুর যে স্বরূপ সে দেখে ফেলেছে, তা উঁচুতলার মানুষ সমগ্র-জীবনে আবিষ্কার করতে পারে না। টিন এজে এসে তারা পাড়ার বেকারিতে বা ক্যাফেতে চুরি করে ('ব্রঙ্কো বুলফ্রগ'), চুরির দায়ে চলে যায় বরস্টালে (কিশোর শোধনাগার)- যেখানে কোনো গোপনীয়তা নেই। সে দৌড়োয় কারণ দৌড় তাকে জীবনের আপদবিপদ মোকাবিলা করতে শিখিয়েছে, শিখিয়েছে জীবন দৌড়বিদের মতো একাই সামনা করতে হয় ('দ্য লোনলিনেস অভ দ্য লং ডিস্ট্যান্স রানার')। 'কেস'-এর বিলিকে ভোলা অসম্ভব, পোষা বাজপাখিটা আর সে যেন একে অন্যের মেটাফর, দুজনেই অবস্থাক্রমে বন্দী, দুজনেরই ভিতর শিখবার অগাধ সম্ভাবনা, শেষ অব্দি দুজনেই চিরতরে জখমী।
ট্যাবুঃ
'আ টেস্ট অভ হানি'তে নায়িকা অবিবাহিতা মা- শিশুর পিতা তথা প্রেমিক কৃষ্ণাঙ্গ ("বাচ্চাটা বোধহয় কালো হবে!"), নায়িকার প্রিয় বন্ধুটি সমকামী। 'দ্য লেদার বয়েজ'-এ সমকামিতা এলো, 'দ্য এল শেপড রুম'-এ নিচতলার বেড়ালপালিকা বুড়ি চিরকুমারী- ইঙ্গিতে বোঝানো হলো সে আরেক নারীকে ভালোবাসতো ("প্রেমিক বহুরকমের হয়"।), কৃষ্ণাঙ্গ প্রেমিক এ-মুভিতেও উপস্থিত। ব্যভিচার, বিবাহবহির্ভুত সঙ্গম, গর্ভপাত (তখনো বৃটেনে বেআইনী) এবং কুমারী মায়ের গর্ভাধানের মতো বিষয় বারবার এসেছে কিচেন-সিঙ্ক ড্রামায় ('দ্য এল-শেপড রুম', 'রুম অ্যাট দ্য টপ', 'আ টেস্ট অভ হানি', 'স্যাটারডে নাইট সানডে মর্নিং', 'আ কাইন্ড অভ লাভিং', 'ক্যাথি কাম হোম', 'অ্যালফি')। মনে রাখতে হবে এসব এমন বিষয় যা সেকালে বিতর্কিত এবং ট্যাবু, সিনেমায় অভিনব। কিচেন-সিঙ্ক ড্রামার একটি প্যারোডিতে একবার দেখেছিলাম- মা রুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে জিজ্ঞেস করছে- "এবারেরটার বাপ কে?" গর্ভবতী কন্যা কোলেরটিকে সামলাতে সামলাতে বলছে- "জানি না, আলুভাজার দোকানের পেছনটায় এমন অন্ধকার না! দেখতে পাইনি কে।"
মেটাফর, সিম্বল, লাইটমটিফঃ
'রুম অ্যাট দ্য টপ'-এ মায়ের দেয়ালে সেই ক্রসস্টিচের কাজ করা আপ্তবাণী মনে পড়ছে আমার- "গড লুকস আফটার হিজ গুড লিটল চিলড্রেন", 'আ কাইন্ড অভ লাভিং'-এর মাঠের ওপর নিরালা ভাঙা কুটিরে চুম্বনরত যুগলের মাথার ওপরে দেয়ালে অন্য কারো লিখে যাওয়া 'আই লাভ অ্যাডাম'—দুঃসহ দারিদ্র ও বেকারত্বের জীবনের ওপর স্ত্রী মা প্রেমিকার ঈশ্বরের ভালোবাসা-আশা-ভরসার রক্তিম ব্যঞ্জনা। 'দিস স্পোর্টিং লাইফ'-এ একপর্যায়ে নায়ক রিচার্ড হ্যারিস দীর্ঘক্ষণ কাদায় ধস্তাধস্তি করে রাগবী খেলে। শুধু একদল খেলোয়াড়, মাটি, আকাশ, আকাশের পটে অতিকায় ফুলদানির গ্রীবার মতো নিউক্লিয়ার রিয়্যাক্টর, আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মিলে সেই শাদাকালোয় রচিত খেলার দৃশ্যকে একসময় জীবনের মেটাফরের মতো দেখায়। সিনেমাগুলোতে পৌনঃপুনিকভাবে ফেরত আসে রেলওয়ে, কয়লার ইঞ্জিন আর ট্রেন। শাদাকালোয় জংশনগুলোর রেললাইনগুলোকে অন্ত্রের মতো কুশ্রী দেখায়। বারবার নায়ক-নায়িকা অবিন্যস্ত সবুজ টিলার ওপর থেকে তাকিয়ে দ্যাখে হুমকিস্বরূপ এক ভয়াল সিটিস্কেপ—শিল্পকারখানার চিমনিতে ভরা উত্তর ইংল্যান্ডের শহর।
ভালোবাসা তার উপবৃত্তাকার পথে জ্বলন্ত বুধগ্রহের মতো ফটাফট আবর্তন করে যায় অখ্যাত জীবনগুলোকে, ধাঁধার চেয়ে জটিল সে, অভেদ্য তার কেন্দ্রমন্ডল। আমার খুব প্রিয় কিচেন-সিঙ্ক মুভি 'দ্য এল-শেপড রুম'এ সদ্যপ্রসূতি মেয়েটি বলে—"মানুষের জীবনে ভালোবাসা থাকতেই হবে, যদি তা সরিয়ে নেয়া হয় তাহলে তো সব গেল!" মাথার কাছে জ্বলছে আলো, সেই আলোয় লেসলি ক্যারনের প্রগাঢ় দীপ্তিময়ী চেহারার দিকে ক্যামেরা হাঁ করে চেয়ে আছে, লেসলি ক্যারন যখন সেই প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন তখন কি এক বিষন্ন বিচিত্র মোহমায়া রচিত হলো! ক্রিসমাসের শুভলগ্নে যখন বাইরে 'সাইলেন্ট নাইট হোলি নাইট' ক্যারল গাইছে লোকে, তখন বিবাহবহির্ভুত শিশুটির আবির্ভাব- ডাক্তার তাকে সানন্দে উল্টেপাল্টে দ্যাখে সে মেয়েশিশু- লিঙ্গনির্বিশেষে সব অনাগত শিশুকেই এই ডাক্তার ডাকে 'জর্জ'। শিশুর মা একটি চিলেকোঠার ঘরের ভাড়াটে, ভাড়াকামরার প্রতিটিতে রান্নার সামান্য ব্যবস্থা, ছারপোকাময় বেডিং, অপরিসর ঘর, অন্তহীন সিঁড়ি, তাতেই একেক কামরায় কেউ লেখক, কেউ ক্লাবের বাদক, কেউ গান গায়, কেউ শখের জ্যোতিষী, কেউ বেশ্যা। জীবনের নির্বিকার ভাঙাগড়া বাড়ি জুড়ে। দারিদ্রের পটভূমিতে যে ভালোবাসা জন্মে, তা জীবনকে আরো জটিল, আরো বাত্যাবিক্ষুব্ধ করে তোলে। প্রেমিক-প্রেমিকার জীবনদর্শন সাধারণ- তারাও কেমন শল্যচিকিৎসকের মতো বিশ্লিষ্ট করে দ্যাখে পরস্পরের অনুভূতিমালা, শেলবিদ্ধ হয় ও করে।
পারিপার্শ্বিকঃ
প্রতিবেশীদের ঘরবাড়ি-বাগান সবই এমন খোলামেলা, এমন দৃষ্টিকটুভাবে নাগালের ভিতর, যে উঁকি দিলেই আরেক সেট মুখর জীবন চোখে পড়ে, সেই পড়শির জীবনে প্রত্যেকে নির্বিবাদে নাক গলায় ('দ্য ফ্যামিলি ওয়ে'), "গোপনীয়তার নেই মালিকানা"। পরনিন্দা ও পরচর্চা কিচেন-সিঙ্কের চরিত্রদের দিনযাপনের গ্লানির মতো সদাবহাল। বাড়িগুলো দেখতে একই রকম- ভঙ্গুর, স্যাঁতস্যাঁতে, দেয়ালের পলেস্তারা বা ওয়ালপেপার খসে গেছে। সরকার পুরনো বাড়ি ভেঙে কাউন্সিল-ফ্ল্যাট তৈরি করছে। বাড়ির গায়ে বাড়ি- রো হাউজ, পালোয়ানের মতো দাঁড়িয়ে থাকা টাওয়ার ব্লক, ইতিউতি কানাগলি, শাদাকালোর তীক্ষ্ণতায় সব কেমন বৃষ্টিভেজা, কালো আর হিম। মেয়েদের পরনে আটপৌরে পেটিকোট বা স্কার্ট, উঠানে তারে মেলে দেয়া ভেজা কাপড়, ঘরের ফায়ারপ্লেসের সামনে ধাতব বাথটাবে সামান্য জলে স্পঞ্জ ভিজিয়ে সিনান, খাবার টেবিলে অনন্ত পাউরুটি আর চা। বাইরে একটা গাছ চোখে পড়ে না, শুধু জান্তব দালানকোঠা, খনি, কটনোপলিসের কারখানা—এল এস লাওরির পেন্টিং যেন।
রঙহীন ক্যামেরায় যাঁদের চোখেমুখে সংবেদের ব্যঞ্জনা অবিশ্বাস্যভাবে ধরা পড়ে এমন শিল্পীদের ব্যবহার করেছে এই ধারা- যেমন লরেন্স হার্ভি, অ্যালবার্ট ফিনি, মাইকেল কেইন, টম কুর্টনি ও বেল, রিটা টুশিংহাম। অত্যন্ত সুমুখ-সুদেহী-সুঠাম অভিনেতা/অভিনেত্রীরা শাদাকালো কিচেন-সিঙ্কে অভিনয় করেছেন, রিচার্ড বার্টন ও হ্যারিস, অ্যালান বেটস, টেরেন্স স্ট্যাম্প, জুলি ক্রিস্টি, লেসলি ক্যারন।
তুখোড় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক এ ড্রামাস্টাইলের আরেকটি চারিত্র। 'আপ দ্য জংশন'-এর সুর করেছিলেন ম্যানফ্রেড ম্যান, 'দ্য ফ্যামিলি ওয়ে'র মিউজিক স্কোর করেছিলেন পল ম্যাকার্টনি, সোনালি তন্তুর মশারি হয়ে জড়িয়ে আছে সুর। 'পুওর কাউ'য়ের সাউন্ডট্র্যাকে ছিল ডনাভানের চমৎকার কিছু দেহাতি গান।
কিচেন-সিঙ্কের প্রভাবঃ
কিছুদিন আগে 'বেলফাস্ট' (২০২১) দেখেছিলাম, শাদাকালোয় নির্মিত সুন্দর স্মৃতি-আলেখ্য। নেটফ্লিক্সে এখনো একটি শাদাকালো সুইডিশ মুভি আছে- 'ডিয়ার জন' (১৯৬৪), যেমন নির্মিতি, তেমন যর্ল কুলের অভিনয়। দুটো মুভি দেখেই আমার মনে হয়েছে কিচেন-সিঙ্কের যোগ্য উত্তরসুরী। নারীকেন্দ্রিক মুভি 'ডার্লিং' এ জুলি ক্রিস্টি আর ডার্ক বোগার্ডের আগ্নেয় টানাপোড়েন কে ভুলতে পারে? সরাসরি কিচেন-সিঙ্ক বলা যাবে না একে। ভোলা যায় 'এডুকেটিং রিটা'র সেই সাহিত্যপ্রেমী হেয়ারড্রেসার জুলি ওয়াল্টার্সকে? কিংবা 'শার্লি ভ্যালেন্টাইন'-এর সেই গৃহবধুটিকে যে বৃহস্পতিবার রাতের ডিনারে স্টেকের বদলে ডিম-আলুভাজা পরিবেশনের মাধ্যমে খুঁজে পায় আত্ম-অন্বেষণের প্রথম বহ্নি? আশির দশকে 'লুকস অ্যান্ড স্মাইলস', 'গ্রেগরিজ গার্ল' বা 'রিটা,স্যু অ্যান্ড বব টু', নব্বইয়ে 'লাইফ ইজ সুইট' বা 'নেকেড', শূন্য দশকে 'অল অর নাথিং', এমন আরো কিছু কিচেন-সিঙ্ক প্রভাবিত মুভি তৈরি হয়। 'ভেরা ড্রেইক' দেখে অশ্রু-সম্বরণ করা অসম্ভব—
"শেষ আলো নিভে গেল পলাতক নীলিমার পারে,
সদ্য-প্রসূতির মতো অন্ধকার বসুন্ধরা আবরি আমারে।"
ষাটের দশকের 'করোনেশন স্ট্রিট' কিংবা আশির দশকের 'ইস্ট এন্ডারস'-এর মতো টিভি সোপ-অপেরার সম্ভাবনা রচিত হয়েছে কিচেন-সিঙ্ক ড্রামার পথ ধরে। বিশেষত্বহীন সাধারণ মানুষের জীবনের ওঠাপড়া কত প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারে, এসব সোপ-অপেরার দীর্ঘ মেয়াদ আর জনপ্রিয়তাই তার প্রমাণ। হিন্দি সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়কের উত্থান 'অ্যাঙরি ইয়াংম্যান' হিসেবে, যদিও 'দিওয়ার' ইত্যাদি কিচেন-সিঙ্ক স্টাইলের নয়।
গুলজারের বিখ্যাত গানের লাইন মনে পড়ছে আমার—
"দিন খালি খালি বর্তন হ্যাঁয়, অওর রাত হ্যাঁয় য্যায়সে আন্ধা কুয়াঁ।/ ইন সুনি আন্ধেরি আখোঁ সে আঁসু কি জাগা আতা হ্যাঁয় ধুয়াঁ।" একেবারে কিচেন-সিঙ্কের আত্মা বিধৃত আছে এখানে। এ গানে আরেকটি অসামান্য উপমা ব্যবহার করেছিলেন তিনি, আয়ুর চেয়ে দীর্ঘ সড়ক। অনায়াসে যা উত্তরের কোনো দরিদ্র শহরে র্যালি বাইসাইকেলের কারখানার শ্রমিককে মনে করিয়ে দেয়। 'দ্য রুম অ্যাট দ্য টপ'-এর ধোপদুরস্ত শার্ট আর ক্রোমিয়াম কাফলিংক পরা চটপটে ধুর্ত যুবকের জীবন পাল্টাবার দুর্বহ অপেক্ষা আর প্রেমিকার সচ্ছলসমাজে অপাংক্তেয় হবার যাতনার সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চৌধুরীদের রাস-উৎসবে অবিরল রঙের ধারার মধ্যে আমোদহাসিনী সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীদের শুধু চেয়ে চেয়ে দ্যাখা কিশোরের বড় মিল। সত্যজিত রায়ের 'মহানগর'-এর মাধবী মুখার্জিকে মনে পড়ে, 'অ্যালবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিউ আতা হ্যাঁয়'-এর নাসিরুদ্দিন শাহ। 'দ্য ফ্যামিলি ওয়ে'-র সঙ্গে বাসু চ্যাটার্জির 'পিয়া কা ঘর'-এর, 'দ্য রুম অ্যাট দ্য টপ'-এর সঙ্গে সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকীর 'ঘুড্ডি'র কি ভীষণ মিল। বাসু চ্যাটার্জির 'রজনীগন্ধা', 'ছোটি সি বাত', 'বাতোঁ বাতোঁ মে' এসবেও হালকাচালের কিচেন-সিঙ্কের মিষ্টি-ঘরোয়া প্রভাব রয়েছে। একটি কথা না লিখলেই নয়। আমাদের নাটকের ইতিহাসে কিচেন-সিঙ্কের আনন্দ দিয়ে ভরিয়ে রেখেছিলেন হুমায়ুন আহমেদ, তাঁর 'এইসব দিনরাত্রি' অত্যুৎকৃষ্ট কিচেন-সিঙ্কের নমুনা।
নটেগাছটিঃ
একটি আলোচনায় কিচেন-সিঙ্ক চরিত্রগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ পড়েছিলাম। এই যে 'আ টেস্ট অভ হানি'র জো, 'স্যাটারডে নাইট সানডে মর্নিং'-এর আর্থার, 'কেস' বা 'বিলি লায়ার'-এর বিলি, 'দ্য লোনলিনেস অভ আ লং ডিসট্যান্স রানার'-এর কলিন…এরা সবাই জীবনের ঈপ্সিত মধু থেকে বঞ্চিত, বিতাড়িত, মধুর স্বাদ পাবার মুহূর্তও বড্ড ক্ষণস্থায়ী- আর তার উচ্চ শুল্ক শুধতে হয় জীবনভর। বিলি লায়ারের কল্পনার দেশের নাম 'এম্ব্রোজিয়া', পরমান্ন; সেখানে সে জেনারেল, সে চার্চিল, সে একনায়ক। অসহায়ের স্বপ্নকে ভেঙচি কেটে আছে তার জন্মপংক্তি, সে তাই চেনা শহর আর নাগরিকের কাছ থেকে শুধু পালাতে নয়, অদৃশ্য হয়ে যেতে চায়। পুরনো খাতার মতো অদ্যাবধি যাপিত জীবন ছিঁড়ে ফেলে আবার নতুন খাতা খুলে শুরু করতে চায়। প্রতিদিন এই আশা নিয়ে বিলি জীবনখাতার পাতা ওল্টায়, দ্যাখে আগের পাতায় লেখার কালি কখন চুঁইয়ে এসেছে নতুন পাতায়।
অত নির্বেদের পরেও কিচেন-সিঙ্কে শিশুরা কলস্বরে খেলা করে, হাটবাজার ভরে ওঠে মানুষের কোলাহলে, মানুষ একে অন্যের দিকে চেয়ে হাসে, যুগল একে অপরকে চুমু খায়। অত পালাতে চেয়েও পালাতে পারে না কেউ, যে শহরের পথে সে এক প্লাটুন অদৃশ্য সৈন্যকে পেছনে রেখে কাল্পনিক কুচকাওয়াজ করেছে সেখান থেকে পালানো যায় নাকি? আশা সর্বত্র। কবীর সুমনের গানের লাইন মনে পড়ছে—"আমাদের জন্যেই মিষ্টি সকাল, নীলের গভীরে হাসে একা মহাকাল। আমাদেরই জন্যে বৃষ্টি এসেছে, দারুণ প্রাণের টানে দুকূল ভেসেছে। মৌমাছি খুঁজে মরে আমাদেরই মধু, আকাশ ডাকছে আজ আমাদেরই শুধু।"