ভারতের পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনে এবারও কি বিজেপি?

ভারতের পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচন সমাপ্ত হয়ে গেল। এর মধ্যে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশের সাত ধাপের নির্বাচন গতকাল শেষ হলো। এর পরেরটি পাঞ্জাব। বাকি তিনটি ছোট রাজ্য গোয়া, উত্তরাখন্ড এবং মণিপুর। পাঞ্জাব, গোয়া এবং উত্তরাখন্ডে নির্বাচন হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি। মণিপুরে দুই ধাপে ২৭ ফেব্রুয়ারি এবং ৩ মার্চ। ৫টি রাজ্যের মোট ১৮ কোটি ৩০ লাখ। ১০ মার্চ ভোট গণনা শুরু হবে। দিল্লির 'মসনদ' কার জন্য 'কত দূর' সেটা এই নির্বাচন থেকে স্পষ্ট হবে বলেই সেখানকার রাজনৈতিক মহল ধারণা দিয়ে থাকে। ৫৪৫ আসনের ভারতীয় লোকসভায় সর্বাধিক ৮০ জন প্রতিনিধিত্ব করেন উত্তরপ্রদেশ থেকে। পাঞ্জাব ১৩, উত্তরাখন্ড ৫, মণিপুর ও গোয়ায় ২ জন করে লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব করেন।
সদ্যসমাপ্ত ৫ রাজ্যের নির্বাচনে পাঞ্জাব (কংগ্রেস) বাদে ৪টিতেই বিজেপি ক্ষমতায়। এই ৫ রাজ্যে এমন সময় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো যখন এক বছরের অধিককাল জুড়ে চলা তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে লক্ষাধিক কৃষকের দিল্লি অবরোধ আন্দোলনে যোগ দেওয়া। এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা কোনো কৃষক আন্দোলন এর আগে সংঘঠিত হয়নি। হাজার হাজার নারী এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। দিল্লির প্রচণ্ড শীত, গরম ও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ উপেক্ষা করে লক্ষাধিক কৃষক আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। আন্দোলন চলাকালীন প্রায় ৭০০ কৃষক মারা গিয়েছেন। অবশেষে গুরু নানকের জন্মদিনে সরকার বিতর্কিত আইন তিনটি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এই আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহণ ছিল পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশের কৃষকদের। এই অঞ্চলের আসন্ন নির্বাচন ও কৃষকদের অনমনীয় মনোভাব সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
উত্তরপ্রদেশের যোগি সরকার প্রথম থেকেই চাপে ছিল। রাজ্যটিতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিকাশ, মুসলিম নিধন, সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ ভারতের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা, করোনা রোগী ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা এবং করোনা মৃতদেহ সৎকারে নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণে যোগি সরকারের জনপ্রিয়তায় ধস নেমে আসে। সর্বশেষ কৃষক আন্দোলন প্রতিহত করতে যেয়ে এক মন্ত্রীপুত্রের গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষক হত্যার ঘটনা সরকারকে আরও বেকাদায় ফেলে। এই সবকিছু যোগি আদিত্যনাথ কতটা সামাল দিতে পেরেছেন, তা এখন দেখার বিষয়।
ভারতের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান যারা নির্বাচনের উপর নজর রাখে তারা ভোটারদের প্রবণতা নজরে এনে একটা জরিপ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা যায়, ভোটের পরিমাণ ও বিধানসভার আসন সংখ্যা কমলেও যোগি সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাচ্ছে না। দলিত সম্প্রদায়ের ত্রাতা হিসেবে রাজনীতিতে আবির্ভাব হয়েছিল, কিন্তু মায়াবতী ২০০৭ সালের সেই অবস্থান আর ধরে রাখতে পারেনি। নির্বাচনের আগের অবস্থাটা মোলায়েম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি কতটা কাজে লাগাতে পেরেছে, তা দেখতে হবে। বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অজর্নে ব্যর্থ হলে সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস ঐক্য হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বুথফেরত জরিপ বলছে, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ২২০ থেকে ২২৫টি আসন পেতে পারে। তার মানে বিজেপি প্রায় ১০০টি আসন হারাতে যাচ্ছে। এই ১০০টির সাথে আরও ২০ থেকে ২৫টি যুক্ত হলে ক্ষমতাসীনদের পতন ঘটবে। পাঞ্জাবে কংগ্রেসই থাকছে। পরিবর্তন ঘটতে পারে উত্তরাখন্ড, গোয়া ও মণিপুরে। এই তিনটি রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায়।
এই ধরনের জরিপ এক ধরনের অনুমান তৈরি করায়। ফলে এই অনুমানের কিয়দংশ সত্য হলেও ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য খারাপ বার্তা। ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ভারতের কেন্দ্রীয় রাজনীতির ভাগ্যলিপি লিখে থাকে। এই নির্বাচনের আগে বিজেপি সরকার সবচেয়ে বড় বিপর্য়য়ের সম্মুখীন হয়েছে পাশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে। ২০২৪ খুব বেশি দুরে নয়। মোদিকে তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় আসতে হলে নতুন করে মাঠে নামতে হবে। বিজেপির জন্য কোথাও তেমন মাঠ প্রস্তুত হয়ে আছে, তা দেখা যাচ্ছে না।
ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের গেরুয়া রং ফিকে হতে শুরু করেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ মানুষকে কেবল বিভক্ত করে, এটা গত দশ বছরের গেরুয়া শাসনের উপলব্ধি। মানুষের এই উপলদ্ধি ভারতের অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারেনি। সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেস চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলতে পারেনি। ভারতের সবচেয়ে পুরাতন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানটির ঐতিহ্যগত বিশালতা তার বাধা কি না, তা ভাই-বোন নেতৃত্বকে ভাবতে হবে। সর্বভারতীয় রূপে কংগ্রেসের সংগঠিত হতে না পারা এবং আঞ্চলিক ও ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনেও দীর্ঘমেয়াদি ঐক্য সৃষ্টি করতে না পারা ক্ষমতাসীনদের স্বস্তি দিয়েছে একের পর এক। পেগাসাস কাণ্ডে ১ মাসের অধিককাল সংসদ অচল রেখেছিল সম্মিলিত বিরোধীরা। শীতকালীন অধিবেশনের পুরোটা বন্ধ ছিল। বিরোধী একটা জোট গঠনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েও আলোর মুখ দেখেনি।
তবে ক্ষমতাসীনদের কিছুটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল, চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাত, চীনবিরোধী ইঙ্গ-মার্কিন তৎপরতায় ভারত নিজেকে যুক্ত করতে পারায় ক্ষমতাসীনরা নিজ দেশে বিরোধীদের সমালোচনা থাকলেও একটা সাধারণ সহানুভূতিও লক্ষ্য করা যায়। কোয়াডে যোগ দেওয়াকে ক্ষমতাসীনরা বিশ্বরাজনীতিতে সাফল্য হিসেবে সামনে নিয়ে আসে। ইউক্রেন-রাশিয়ার চলমান সংঘাতের প্রেক্ষিতে বিশ্বরাজনীতির নয়া মেরুকরণে ভারতের ভূমিকা নিজ দেশে প্রশংসিত হবে বলে ধারণা করা যায়।