নেই অর্ডার, অফিস ফাঁকা: মার্কিন শুল্কের জেরে সংকটে ভারতের হীরা শিল্প

বিশ্বের বৃহত্তম অফিস কমপ্লেক্স হিসেবে পরিচিত সুরাট ডায়মন্ড বোরস। আয়তনে পেন্টাগনের থেকেও বড় এবং ভারতের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক এই অফিসটি বর্তমানে প্রায় ফাঁকা। হাতে গোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ নেই। কারণ, হীরার ব্যবসা এখন মন্দার মধ্যে এবং ভবিষ্যত আরও অনিশ্চিত।
চীনে চাহিদা কমে যাওয়ায় ভারতের হীরা শিল্পের রপ্তানি দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমেছে। এর ওপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের নতুন শুল্ক নীতি ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় বাজারে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের রপ্তানি করা মোট ২৮.৫ বিলিয়ন ডলারের রত্ন ও অলঙ্কারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আমদানি করে থাকে।
গুজরাটের সুরাটে বিশ্বের ৮০ শতাংশেরও বেশি অপরিশোধিত হীরা কেটে পলিশ করা হয়। কিন্তু মার্কিন শুল্ক বৃদ্ধির আশঙ্কায় ক্রেতারা পিছিয়ে আসায় অর্ডার কমতে শুরু করেছে।
ছোট রপ্তানিকারকদের সামনে বিকল্প খুব কম থাকলেও, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো কিছু কার্যক্রম বতসোয়ানার মতো দেশে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করছে, যেখানে শুল্কের হার ১৫ শতাংশ। উল্লেখ্য, ভারতের বর্তমান ২৫ শতাংশ শুল্ক আগামী ২৭ আগস্ট থেকে দ্বিগুণ হওয়ার কথা রয়েছে।
ধর্মানন্দন ডায়মন্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিতেশ প্যাটেল বলেন, 'আমরা আগস্টের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই চলতে থাকলে বতসোয়ানায় উৎপাদন বাড়াতে হতে পারে।'
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, 'শুল্ক বৃদ্ধিতে আমাদের বার্ষিক আয় ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাবে।'
রপ্তানি প্রবণতা নিয়ে জেম অ্যান্ড জুয়েলারি এক্সপোর্ট প্রমোশন কাউন্সিলের (জিজেপিসি) সহ-সভাপতি শৌনক পারিখ বলেন, 'শিল্পে চাহিদা কমায় কর্মদিবস ও কর্মঘণ্টা কমানো হয়েছে।'

সুরাট ডায়মন্ড বোরসের এক কর্মকর্তা জানান, এখানকার ৪ হাজার ৭০০টির বেশি অফিস বিক্রি হলেও, বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে ২৫০টিরও কম। অনেক কোম্পানি এখানে স্থানান্তরিত হওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করছে।
মুম্বাইয়ের এক হীরা ব্যবসায়ী গত বছর বোরসে অফিস কিনেছিলেন। তিনি বলেন, 'মার্কিন শুল্ক ইতিমধ্যেই আমাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাই মুম্বাই থেকে সুরাটে স্থানান্তরের ঝামেলায় যেতে চাই না।'
২০২৩ সালের ডিসেম্বর ৬.৭ মিলিয়ন বর্গফুট জায়গাজুড়ে নির্মিত সুরাট ডায়মন্ড বোরস উদ্বোধনকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একে 'নতুন ভারতের শক্তি ও দৃঢ়তার প্রতীক' হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। নয়টি আন্তঃসংযুক্ত টাওয়ার নিয়ে গড়া ভবনটিতে ব্যাংক, কাস্টমস অফিস, সুরক্ষিত ভল্ট ও জুয়েলারি মল রয়েছে, যা বিশ্ব হীরা শিল্পের জন্য এককেন্দ্রিক হাব হিসেবে নকশা করা হয়েছে।
উৎসব মৌসুমেও নেই উজ্জ্বলতা
এই সময়ে সাধারণত সুরাটে ক্রিসমাস ও নববর্ষের আগে যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডারের চাপ সামলাতে উৎপাদন বাড়ানো হয়। তবে, এই বছর অনেক কারিগর জানেন না তাদের কাজ থাকবে কিনা।
সুরাটের হীরা কাটিং ও পলিশ কারখানার মালিক শৈলেশ মাঙ্গুকিয়া বলেন, 'চাহিদা এতটাই কমে গেছে যে, গত বছর যেসব প্যাকেট ২৫ হাজার রুপিতে বিক্রি করেছি, এখন তা ১৮ হাজার রুপিতেও বিক্রি হচ্ছে না।'
জিজেপিসির পারিখ জানান, ভারত-আমেরিকার মধ্যে শুল্ক কমাতে বাণিজ্য চুক্তি না হলে ১.৫ থেকে ২ লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, 'শুল্কের ধাক্কায় মার্কিন ক্রেতারা ইসরায়েল, বেলজিয়াম ও বতসোয়ানার মতো দেশ থেকে হীরা কিনবে। ভারতের রপ্তানিকারকরা এশিয়া, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বিক্রি বাড়ানোর চেষ্টা করছে, তবে নতুন ক্রেতা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।'
চলমান সংকটে টিকে থাকতে শিল্পে অপরিশোধিত হীরা কেনা কমানো হচ্ছে এবং নগদ প্রবাহ বজায় রাখতে ন্যূনতম মজুত রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে, ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড় দিয়ে কম দামে হীরা বিক্রি করছে।
এই কঠিন পরিস্থিতির মাঝে একমাত্র ভালো খবর হলো ভারতে অভ্যন্তরীণ বাজারে হীরার চাহিদা বৃদ্ধি।
ভেনাস জুয়েলের অংশীদার হিতেশ শাহ বলেন, 'আমেরিকান চাহিদার ঘাটতি কিছুটা পূরণ হচ্ছে ভারতীয় বাজারে ভালো চাহিদার কারণে। গত ১০-১৫ দিনে বিক্রি কিছুটা কমেছে, তবে ততটা নয়।'