ভারতের রপ্তানিতে বুধবার থেকে কার্যকর হচ্ছে চড়া মার্কিন শুল্ক

বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র থেকে রপ্তানির কার্যাদেশ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ভারতীয় রপ্তানিকারকরা। এছাড়া উপায়ও নেই। কারণ দীর্ঘ আলোচনার পরও দিল্লি-ওয়াশিংটনের মধ্যে শুল্ক নিয়ে কোনো সমঝোতা না হওয়ায়—আগামীকাল বুধবার (২৮ আগস্ট) থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির পণ্যে চড়া হারের শুল্ক আদায় করবে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতীয় পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্টের এক বিজ্ঞপ্তিতে নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলে দেশটির ওপর মোট শুল্ক হার দাঁড়াচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ। এপর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের ওপর যেসব শুল্ক হার আরোপ করেছে— এটি তারমধ্যে সর্বোচ্চ হারের একটি। রাশিয়া থেকে ভারতের বিপুল জ্বালানি তেল ক্রয়কে কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সর্বশেষ অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়। ট্রাম্প প্রশাসন বলেছে, নয়াদিল্লির তেল ক্রয় রাশিয়াকে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য অর্থের জোগান দিচ্ছে।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে বলেন, "আমরা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক সিদ্ধান্তে কোনো তাৎক্ষণিক ছাড় বা বিলম্বের আশা করছি না।" তিনি আরও জানান, শুল্কে ক্ষতিগ্রস্ত রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং তাদের চীন, লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো বিকল্প বাজারে রপ্তানি বাড়াতে উৎসাহিত করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে মন্তব্য চেয়ে ই-মেইল করে রয়টার্স, তবে তারা এর কোনো জবাব দেয়নি।
ভারতের ওপর নতুন এই শুল্ক হার কার্যকর হবে বুধবার যুক্তরাষ্ট্র সময় রাত ১২টা ১ মিনিটে (ভারতীয় সময় সকাল ৯টা ৩১ মিনিটে)। তবে চলমান পরিবহনকৃত পণ্য, মানবিক সহায়তা ও পারস্পরিক বাণিজ্য চুক্তির আওতাভুক্ত পণ্য এ নিয়মের বাইরে থাকবে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ ঘোষণার পর মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির দর কমে ৮৭ দশমিক ৬৮ রুপিতে নেমে এসেছে, যা তিন সপ্তাহের মধ্যে সর্বনিম্ন। যদিও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপের কারণে রুপি পতনের মুখ থেকে সামান্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। দেশটির পুঁজিবাজারেও প্রভাব পড়েছে—বিএসই সেনসেক্স এবং নিফটি-৫০ সূচক উভয়েই ১ শতাংশ কমে তিন মাসের সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে।
ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত আসে— পাঁচ দফা ব্যর্থ বাণিজ্য আলোচনার পর, যেখানে ভারতীয় কর্মকর্তারা আশা করেছিলেন শুল্ক সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশে সীমিত রাখা যাবে। এই ব্যর্থতার জন্য উভয় পক্ষের কর্মকর্তারাই রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভুল সিদ্ধান্তকে দায়ী করেছেন।
ফলে এক ভাঙ্গনের মুখেই পড়তে চলেছে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ও পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির বাণিজ্য সম্পর্ক। যেখানে সামষ্টিক বাণিজ্যের আকার প্রায় ১৯০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা পিটার নাভারো ও মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট অভিযোগ করেছেন, রাশিয়ার তেল আমদানি ব্যাপক বাড়িয়ে ভারত ইউক্রেন যুদ্ধে মস্কোকে পরোক্ষভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
বেসেন্ট এ মাসে বলেন, যুদ্ধের আগে যেখানে ভারতের মোট জ্বালানি তেল ক্রয়ের মধ্যে রাশিয়ান তেলের হিস্যা ছিল ১ শতাংশেরও কম, যুদ্ধ শুরুর পর তা বাড়তে বাড়তে এখন ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ওয়াশিংটনের কাছে অগ্রহণযোগ্য।
তবে দিল্লি এখনো পর্যন্ত রাশিয়ান তেল আমদানির বিষয়ে কোনো সরকারি নির্দেশ জারি করেনি। দেশটির তিনটি তেল পরিশোধনাগারের সূত্র জানিয়েছে, অর্থনৈতিক সুবিধার ভিত্তিতেই কোম্পানিগুলো রাশিয়া থেকে ক্রয় অব্যাহত রাখবে।
সরকারি সহায়তা চান রপ্তানিকারকরা
ভারতীয় রপ্তানিকারকদের সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, নতুন শুল্কে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার পরিমাণ ৮৭ বিলিয়ন ডলার। এতে বাংলাদেশ, চীন ও ভিয়েতনামের মতো প্রতিযোগী দেশগুলো লাভবান হবে।
ইঞ্জিনিয়ারিং এক্সপোর্টস প্রোমোশন কাউন্সিলের সভাপতি পঙ্কজ চাড্ডা বলেন, "মার্কিন ক্রেতারা ইতিমধ্যেই নতুন অর্ডার দেয়া বন্ধ করেছেন। এই অতিরিক্ত শুল্কের কারণে সেপ্টেম্বর থেকে রপ্তানি ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।"
তিনি জানান, সরকার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের ব্যাংক ঋণে বাড়তি ভর্তুকি ও বাজার বহুমুখীকরণে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। তবে বিকল্প বাজারে প্রবেশ বা স্থানীয় বাজারে বিক্রির মাধ্যমে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সুযোগ কম বলেও জানান তিনি।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৫০টি দেশ চিহ্নিত করা হয়েছে যেখানে টেক্সটাইল, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, চামড়াজাত পণ্য ও সামুদ্রিক পণ্য রপ্তানি বাড়ানো যেতে পারে।
এদিকে চীনে চাহিদা দুর্বল থাকায় ভারতের হীরা শিল্পের রপ্তানি দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। মার্কিন শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও হীরা রপ্তানি বন্ধ হতে পারে, যা এ রত্নের সর্ববৃহৎ বাজারও। ফলে বার্ষিক ২৮.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জুয়েলারি রপ্তানিতে ঝুলতে পারে তালা।
সামষ্টিক অর্থনীতিতে প্রভাব
বেসরকারি খাতের বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, দীর্ঘমেয়াদি ৫০ শতাংশ শুল্ক ভারতের অর্থনীতি ও করপোরেট মুনাফায় বড় প্রভাব ফেলতে পারে। এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয়ের পূর্বাভাস হ্রাসের ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। তবে সরকারের প্রস্তাবিত কর ছাড় সুবিধা ব্যবসায়ীদের এই ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে দিতে পারবে।
গত সপ্তাহে বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনীতির বিশ্লেষক সংস্থা—ক্যাপিটাল ইকনমিকস জানায়, পূর্ণাঙ্গ মার্কিন শুল্ক ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এ বছর ও আগামী বছর উভয় ক্ষেত্রেই ০.৮ শতাংশ পয়েন্ট কমিয়ে দিতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা চলমান রয়েছে, এবং রাশিয়ার তেলের চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বড় ক্রেতাদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র একই ধরনের কঠোরতা দেখাচ্ছে না। ওয়াশিংটনের উদ্বেগ কেবল ভারতের তেল কেনা নিয়ে।
নয়াদিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তা আজ মঙ্গলবার বলেছেন, ভারতের জন্য বড় জ্বালানি সরবরাহকারী হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের জ্বালানি নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চমানের পণ্য ও সেবা রপ্তানি নিয়ে ভারতের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
যদিও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন, ভারতীয় কৃষকদের স্বার্থ রক্ষায় তিনি কোনো আপস করবেন না, তার জন্য যদি বড় মূল্যও দিতে হয় তবুও না। একইসঙ্গে, সাত বছর পর এই মাসের শেষে চীন সফরে যাচ্ছেন তিনি, যা দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে নয়াদিল্লির চেষ্টার ইঙ্গিত দিচ্ছে।