‘আমাদের মা দিন দিন ছোট হতে থাকে’

পরিবারের কয়জন আমরা লক্ষ্য করেছি যে, আমাদের মায়েরা সারাদিনে কী খাচ্ছেন, কতটা খাচ্ছেন? পরিবারের সবার পাতে খাবার তুলে দেওয়ার পর মায়ের জন্য ডেকচিতে কতটা খাবার পড়ে আছে? মায়েরা কি কখনো মুরগির রান বা মাংসের ভাল টুকরা, মাছের মুড়ো বা পেটি ভাগে পেয়েছেন? গরম খাস্তা পরোটা, একটা আস্ত ডিম ভাজি কি তাদের খাবারের তালিকায় ছিল বা আছে?
খাবারের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম; এছাড়াও ডাক্তার, ওষুধ, বিনোদন, অবসরসহ অন্যান্য চাহিদা পূরণ হচ্ছে কি না এই কথাও তো জানতে চাইনি। অপ্রিয় বাস্তবতা হচ্ছে, মায়ের খাবারের প্লেট দেখবার মতো সময় বা সুযোগ কোনোটাই পরিবারের অন্য সদস্যদের হয় না। এই চিত্র এখন আরো প্রকট হয়েছে। শুধু মা নয়, মা-বাবার প্রতি যে নূন্যতম কিছু দায়িত্ব আছে, তাইতো ভুলে যাচ্ছেন এই প্রজন্মের অনেকে।
আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে নির্ধারিত আয়ে সংসার চালাতে গিয়ে মায়েদের কম খাওয়ার যে অভ্যাস দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছে, পরবর্তীতে স্বচ্ছলতা এলেও তারা সেই অভ্যাস পরিবর্তন করতে পারেন না। আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও মায়েরা মাছ বা মাংস দুটো একসাথে খেতে চাননা। ভাত খাওয়ার সময় কোনোরকমে একটা, দুটো ভর্তা বা ভাজি দিয়ে খেয়ে নেওয়াটা তাদের অভ্যাস হয়ে যায়।
শুধু নিজে খাবেন বলে এরকম কিছু রান্না করেন না বা নিজের জন্য তুলে রাখেন না। মায়ের শরীরেও যে পুষ্টি, বিশ্রাম, আরাম ও চিকিৎসার প্রয়োজন আছে– এগুলো খুব সাম্প্রতিক একটি শহুরে ধারণা। পরিবারে অন্যান্য নারী সদস্যদের চাহিদার দিকেও কেউ চেয়ে দেখিনি। আমরাই সবসময় ভেবেছি স্বামী ও সন্তানদের ভাগ-বাটোয়ারা করে খাওয়ানোর জন্যই আমাদের মায়েদের জন্ম।
সংসারগুলোতে মায়েরা বেশি কর্মঠ ও দায়িত্বপালনকরী শক্তি। সন্তানের স্কুলের কাপড়-চোপড়, টিফিন থেকে শুরু করে ঠিক সময়ে টেবিলে নাস্তা, ভাত সবকিছুর যোগানদার ও পড়াশোনার দায়িত্বে থাকেন পরিবারের মা। বাসায় ছয়জনের জায়গায় ১০ জন মানুষ খেলেও সেই ব্যবস্থাও করেন মা।
আমি আমার মায়ের কথা জানি, জানি এমনই আরো অনেক মায়ের কথা। বিয়ের পর থেকেই আম্মাকে শিখতে হয়েছে সীমিত আয়ে বড় সংসার কীভাবে টেনে নিয়ে যেতে হয়। আমরা দুই ভাইবোন হলেও ঢাকা শহরে আমাদের বাসাটি ছিল সরাইখানার মতো। অজস্র মানুষের আসা-যাওয়া তো ছিলই— বাসায় স্থায়ী সদস্যও ছিল অনেকজন। কেউ পড়াশোনার জন্য, কেউ চাকরি, ব্যবসা বা অন্য প্রয়োজনে, কেউ চিকিৎসার জন্য ঢাকায় এসে আমাদের বাসাতেই অবস্থান করতেন। সে একটা হইচই অবস্থা ছিল। ড্রইংরুমে এতো মানুষ থাকতো যে, সেটাও বেডরুম হয়ে গিয়েছিল।
পুরো সংসার আম্মা একা হাতে ম্যানেজ করেছেন, যা এখন কেউ কল্পনাও করতে পারবে না— এমনকি আমিও না। আব্বার নির্ধারিত আয়ে এতবড় সংসারে, এতজন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার দায়িত্ব এই আম্মাই পালন করেছে। সব অভাব-অভিযোগকে পাশ কাটিয়ে সবাইকে নিয়ে থাকার যে আনন্দ, তা আম্মার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। আম্মার সহযোগিতা না পেলে, আব্বার একার পক্ষে এই দায়িত্বপালন করা সম্ভব হতো না। তবে এজন্য আম্মাকে নিজের চাহিদা, আনন্দ, অবসর অনেকটাই ত্যাগ করতে হয়েছিল। আমাদের জেনারেশনের মধ্যবিত্ত পরিবারের অধিকাংশ মায়েরা এভাবেই সংসারের হাল টেনেছেন।
সংসারে মায়ের কাজের যে ভার, তা আর কারো কাজের চেয়ে কোনো অংশে কম না, বরং বেশি। বাবারা আয় করেন, কিন্তু সেই নির্ধারিত আয়ে সবার মুখে খাওয়ার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব মায়ের। মায়েদের এই অদৃশ্য কাজগুলো শুধু পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, রান্না, শিশুযত্ন, বয়স্ক মানুষের যত্ন নয়— এর পাশাপাশি গ্রামে মায়েদের আরো দায়িত্ব হচ্ছে কৃষিকাজ, গবাদিপশুর দেখাশোনা ও বীজ সংরক্ষণ। পরিবার পরিচালনায় একক নারীর দায়িত্ব আরো অনেক কঠিন।
যেহেতু পরিবারে ও সমাজে মায়েদের এবং মেয়েদের অবস্থান অধ:স্তন তাই বাংলাদেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার। তাদের একটি অংশ রীতিমতো অপুষ্ট, ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম। বেশ কয়েকবছর আগে আইসিডিডিআরবি দেশের নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি নিয়ে এ তথ্য দিয়েছে।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, একজন নারীর স্বাস্থ্যরক্ষায় বয়ঃসন্ধিকালসহ সব বয়সে শরীরের প্রয়োজন অনুসারে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই নারীর পুষ্টিহীনতার হার কমে আসবে। কিন্তু সেই পুষ্টি কি নারী পাচ্ছেন? আমাদের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিতে একজন নারী মা হওয়ার সময়ও ঠিকমতো পুষ্টি পান না।
দরিদ্র পরিবারে নারীরা খাবার খুব কম পান। ক্রয়সীমার মধ্যে নেই বলে সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অসম্ভব। অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে নারী বা মায়ের খাবার গ্রহণ সবসময় উপেক্ষিত থাকে। বর্তমান বাজার ব্যবস্থা ও দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির কারণে নারীর খাদ্য ও চিকিৎসা প্রাপ্তির পরিমাণ আরো কমবে।
অন্যদিকে গ্রামীণ মায়ের খাদ্যগ্রহণ পরিস্থিতি আরো অবহেলিত। গ্রামে মায়েরাই হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করেন, ডিম ফুটান, আঙ্গিনায় মৌসুমি শাকসবজি উৎপাদন করে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে আসছেন। কিন্তু তার উৎপাদিত পুষ্টি কি তার শরীরের চাহিদা মেটাচ্ছে?
তাই মায়েদের জন্য রক্তশূন্যতায় ভোগা, মাথাব্যথা, মাথাঘোরা, বাতের ব্যথা, খিঁচুনি, পানি স্বল্পতা, জরায়ু সংক্রমণ খুব সাধারণ অসুখ। অতিরিক্ত পরিশ্রম আর পরিমিত পুষ্টির অভাবে অল্প বয়সেই তাদের শরীর-স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। আইসিডিডিআরবি জানিয়েছিল, ৮০ শতাংশ নারী রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন, কারণ তারা যথেষ্ট পরিমাণে খাবার পান না।
এখন মানুষের বায়িং ক্যাপাসিটি কিছুটা বাড়লেও সন্তান, সংসার ও সমাজ নারীকে কম খেতে, কম আনন্দ করতে, কম দাবি জানাতে অভ্যস্ত করে তোলে। শারীরিক স্বাস্থ্যতো বটেই, মায়েদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও পরিবারের কেউ চিন্তা করেননা। এরপর একদিন যখন মা কর্মক্ষমতা হারান, সম্পত্তি হারান, গয়নাগুলো সন্তানদের মধ্যে ভাগ করে দেন, তখন এই সংসারেও তার প্রয়োজন আরো ফুরিয়ে যায়।
মায়ের প্রতি এ ধরনের নির্মম আচরণের গল্প একটা নয়, অনেক। জমিজমা লিখে দেওয়ার জন্য মাকে খুন করা, প্রয়োজন মতো টাকা দিতে না পারায় মাকে হত্যার হুমকি বা বাসা থেকে বের করে দেওয়ার খবর চোখে পড়ছেই।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোর প্রায় ৯৯ শতাংশই প্রবীণ নারীদের পরিত্যাগ করার কাহিনী। দরিদ্র পরিবারের কাহিনী বেশি প্রকাশিত হয়। নারী অধিক হারে পরিত্যাক্ত হওয়ার কারণ কী? নারীদের গড় আয়ু বেশি? সন্তানেরা মাকে পালন করতে গিয়ে কি ধৈর্য হারাচ্ছেন? নারীর হাতে সম্পত্তি কম বা নেই বলে? নাকি মায়েরা বয়স হলে কাজ করতে পারেন না বলে? (প্রথম আলো)। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য একটা গবেষণা করা দরকার। হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন— 'আমাদের মা দিন দিন ছোটো হতে থাকে। আমাদের মা দিন দিন ভয় পেতে থাকে।'
ঠিক তাই; মায়েরা ভয় পান সংসার থেকে বিতাড়িত হওয়ার, বিচ্ছিন্ন হওয়ার, প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার, অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকার, অবহেলা পাওয়ার অথবা ভালবাসা হারানোর। প্রবীণ মায়েদের সাথে কথা বললেই বোঝা যায়, কতটা অনাদরে, অবহেলায় মানুষগুলো বেঁচে আছেন। স্বামী বেঁচে থাকতে বা সুস্থ থাকতে যাও কিছুটা আশ্রয় ছিল, স্বামী অসুস্থ হলে বা মারা গেলে অধিকাংশ মায়ের জীবনে সন্তানদের সেই আশ্রয়টুকুও হারিয়ে যায়।
'মা দিবস' পালন করার চাইতেও বেশি জরুরি সারাজীবন মায়ের পাশে থাকার চেষ্টা করা, মাকে ভালবাসা ও সম্মান করা। মায়েরা যেভাবে বিপদে-আপদে সন্তানের পাশে থাকেন, সন্তানেরও উচিৎ ঠিক সেভাবেই মায়ের হাত ধরে থাকা। মা-বাবা পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর যেন মনে না হয়, আমরা আমাদের দায়িত্বটা পালন করিনি। নিজ পরিবার ও সন্তানকে সময় ও সুবিধা দিতে গিয়ে মাকে উপেক্ষা করেছি। ভুলে গেলে চলবে না যে আপনিও একজন মা, আপনার সন্তানের পরিবারে আপনিও একদিন উপেক্ষিত হতে পারেন— ঠিক সেভাবে, যেভাবে আপনি আপনার মা বা শ্বাশুড়িকে অবহেলা করছেন। সংসারের এই 'অদেখা হিরো' মাকে অবহেলা নয়, বরং অনেক ভালবাসি।
লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।