ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যটন খাতে প্রাণচাঞ্চল্য

ঈদকে কেন্দ্র করে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরছে করোনায় বিপর্যস্ত পর্যটন খাতে। মহামারির মধ্যে গত দুই বছর ঈদুল ফিতরে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হলেও এবার অভ্যন্তরীণ ও বহির্গামী পর্যটনে ভালো সাড়া পাচ্ছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
তারা বলছেন, এবার ১০ লাখ লোক ঈদের ছুটিতে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে ঘুরতে যাবেন। বিদেশেও যাবেন কয়েক লাখ।
হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, রেস্টুরেন্ট, এভিয়েশনসহ পর্যটনের বিভিন্ন উপখাতে অগ্রিম বুকিং দিয়েছেন অতিথিরা।
এবারের ঈদের ছুটি ২ মে থেকে শুরু হয়ে শেষ হবে ৪ মে বুধবার। অন্যদিকে, ১ মে রবিবার শ্রমিক দিবসে সরকারী ছুটি। আর আগের দিন ৩০ এপ্রিল শনিবার, ২৯ এপ্রিল শুক্রবার। ফলে ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত টানা ৬ দিনের ছুটি। অন্যদিকে, ঈদের ছুটির পর ৫ মে বৃহস্পতিবার। তারপর ৬ ও ৭ মে পড়বে শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি। চাকরিজীবীরা ৫ মে একদিন ছুটি পেলে মোট ৯ দিন ছুটি কাটাতে পারবেন ঈদে।
আর এই দীর্ঘ ৯ দিনের ছুটিই আশার আলো দেখাচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যটন খাতের সর্ববৃহৎ সংগঠন ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মোঃ রাফিউজ্জামান।তিনি বলেন , "বিপুল সংখ্যক মানুষ গত দুই বছর বেড়াতে পারেনি। এই ৯ দিনের ছুটিতে অনেকেই এবার ঘুরতে বের হবে।"
"আমরা আশা করছি, এবার ঈদের ছুটিতে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে ভ্রমণ করবে। তারা যেন বিভিন্ন গন্তব্যে বেড়াতে পারে এর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। এবার আমরা দেশের মধ্যে পর্যটনকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।"
অনেকে পার্শ্ববর্তী দেশে ঘুরতে যায় উল্লেখ করে তিনি বলেন, "বিদেশের চেয়ে আমাদের এখানে অনেক দর্শনীয় জায়গা আছে। কেউ যদি নেপাল যায় হিল স্টেশনের জন্য, তারা আমাদের রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সাজেক অনেক বেশি উপভোগ করতে পারবেন। মাদ্রাজে যায় ব্ল্যাক ওয়াটার উপভোগ করার জন্য, তা না গিয়ে আমাদের টাঙ্গুয়ার হাওড়, চলনবিল, হাকালুকি হাওরে গেলে অনেক ভালো উপভোগ করতে পারবে।"
"একইভাবে ভারতের সুন্দরবনে না গিয়ে আমাদের এলাকার সুন্দরবন আরও বেশি সুন্দর। আমাদের সমুদ্রসৈকত অনেক সুন্দর।"
পর্যটন খাতের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা জানান, এই ঈদে শুধু কক্সবাজার ভ্রমণ করবে এক লাখের বেশি পর্যটক। এরই মধ্যে সেখানকার হোটেল-মোটেলের ৮০ শতাংশ কক্ষ পর্যটকরা বুকিং দিয়েছেন।
কক্সবাজারের পাঁচতারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইসের পরিচালক আব্দুল কাদির মিশুর বলেন, তাদের হোটেলে কক্ষ আছে ২৫০টি। ঈদের ছুটির সময়ে হোটেলের ৮০ শতাংশ কক্ষ আগাম বুকিং হয়ে গেছে। যারা আগে বুকিং দিয়েছে তাদের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেয়া হয়েছে।
নভোএয়ারের হেড অব সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ঈদের ছুটির সময় ৪ থেকে ৫ মে কক্সবাজার রুটে আমাদের সব টিকেট অগ্রিম সেল হয়েছে। এছাড়া, কলকাতা রুটের টিকেটও সব অগ্রিম বিক্রি হয়ে গেছে।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করার জন্য বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা। এবার ঈদের ছুটির সময়ে কুয়াকাটায় বেশ ভালো পর্যটকের সমাগম হবে বোলে আশা এখানকার হোটেল ব্যবসায়ীদের।
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ বলেন, তাদের সদস্যভুক্ত ৭৪ সহ সব মিলিয়ে কুয়াকাটায় দেড় শতাধিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০ শতাংশ হোটেলের রুম বুকিং হয়েছে । এখনও বুকিং চলছে।
"একজন পর্যটক আসলে পান দোকান থেকে শুরু করে ভাড়ায় যারা মটরসাইকেল চালায় তাদেরও আয় হয়। আমরা আশা করছি, এবার উপচে পড়া ভিড় হবে সমুদ্র সৈকতে।"
তিনি বলেন, "করোনার দুই বছরে আমাদের এখানে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। অনেক হোটেল ব্যবসায়ী ঋণের দায়ে হোটেল বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করছে। ঈদের ছুটিতে যে আয় হবে সেটা দিয়ে তদের ক্ষতি সামলানো সম্ভব নয়। আমরা প্রণোদনার কোন ঋণ পাই নি।এখন সরকার আমাদের টিকে থাকার জন্য যেন সহজ শর্তে ঋণ দেয়।"
রিসোর্টগুলোতে প্রায় ৬০% অগ্রিম বুকিং
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০০টির অধিক রিসোর্ট আছে। বিশেষত, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদিসহ ঢাকার আশেপাশের অঞ্চলে এসব রিসোর্ট গড়ে উঠেছে।
ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ট্রায়াব) মতে, রিসোর্টগুলোর প্রায় ৫০-৬০% অগ্রিম বুকিং সম্পন্ন।
এছাড়া অনেকে ঈদের ছুটিতে সরাসরি চলে আসবে রিসোর্টে, বলেন ট্রায়াব সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ।
গাজীপুরের জয়দেবপুরের ছুটি রিসোর্টের হেড অব সেলস আবুল হোসেন আবির বলেন, "আমাদের রিসোর্টের ৫০টি রুমে ১০০ জন থাকতে পারে। ৪ থেকে ৫ মে তারিখের জন্য এ রুমগুলো সব বুকিং হয়ে গেছে।"
তিনি বলেন, "করোনার সময় যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর সময় লাগবে। তবে বলা যায় এবার ঈদের যে সাড়া পাচ্ছি তাতে নতুনভাবে আমাদের ব্যবসা শুরু হয়েছে।"
এদিকে চলমান গরম আবহাওয়া সুন্দরবন ঘোরার জন্য তেমন উপযোগী না হলেও ঈদের ছুটিতে ভাল সাড়া পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট ট্যুর অপারেটররা।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের উপদেষ্টা (তোয়াস) এবং পগমার্ক ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী নজরুল ইসলাম বাচ্চু বলেন, "এবার ঈদের ছুটির মধ্যে আমাদের ভালো বুকিং হয়েছে। বিদেশ থেকে ১৬ জনের একটি টিম এসেছে সুন্দরবন ঘুরতে। আর দেশি পর্যটকরাও বুকিং দিয়েছে।"
পাহাড়প্রেমীদের স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় পার্বত্য অঞ্চলগুলো
পাহাড়প্রেমীরা ঈদের ছুটিতে ছুটবেন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে। এদের কেউ কেউ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিবেন সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন পাহাড়ী গন্তব্যও।
পর্যটন মোটেল বান্দরবানের ইউনিট ম্যানেজার বলেন, "আমাদের ২৫টা রুম আছে। ঈদের পর থেকে ৫ দিন ৮০% রুম ইতিমধ্যে বুকিং হয়ে গেছে।"
পর্যটন হলিডে রাঙ্গামাটির স্টাফ বলেন, "৩ মে থেকে ৯ মে পর্যন্ত আমাদের ৭০% কক্ষ বুকড হয়ে গেছে।"
দেশের বাইরে ভ্রমণেও সাড়া
গত দু'বছর স্থলপথে বাংলাদেশ থেকে পর্যটকরা ভারতে যেতে পারেনি।
তবে চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ-ভারত যাত্রী যাতায়াতের জন্য স্থলবন্দর খুলে দেওয়ার পর ভিসা আবেদন কয়েক গুণ বেড়েছে।
প্রতি কর্মদিবসে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের ভারতীয় ভিসা আবেদনকেন্দ্রগুলোতে সাহরির পর থেকে আবেদনকারীদের দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ঈদের ছুটিতে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ ভারতে যেতে পারে।
এছাড়া অনেকে মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, নেপাল, দুবাই যাচ্ছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, বিদেশ ভ্রমণে বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে আছে ভারত, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে রয়েছে যথাক্রমে সৌদি আরব ও মালয়েশিয়া। এরপরই আছে থাইল্যান্ড।
জরিপের তথ্য বলছে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২৯ লাখ ২১ হাজার পর্যটক বিদেশে ঘুরতে যায়।
ভ্রমণে গিয়ে একেকজন পর্যটক বিদেশে গড়ে ছয় দিন অবস্থান করে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক পর্যটক গেছে ভারত ভ্রমণে। এটা মোট পর্যটনের প্রায় ৬০ শতাংশ।