বিচার না হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বার বার ঘটছে: মতবিনিময় সভায় বক্তারা

বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা বলছেন, গত কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া নিমতলী, তাজরীন ফ্যাশন ও চুড়িহাট্টার মতো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলাগুলোর বিচার না হওয়ার কারণেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বার বার ঘটছে। সম্প্রতি বেইলি রোডে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বিগত দিনের ঘটনাগুলোরই পুনরাবৃত্তি।
শনিবার 'নিমতলী থেকে বেইলি রোড: অগ্নিকাণ্ডের বাস্তবতা ও করণীয়' শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
বক্তারা দাবি করেন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনায় মৃত্যু অবহেলিত মৃত্যু নয়, এগুলো বেআইনি এবং সরাসরি হত্যাকাণ্ড। বিগত দিনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেরা পার পাওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখানে কেউই দায় এড়াতে পারেন না।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি), আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট), শ্রমিক নিরাপত্তা ফোরাম (এসএনএফ), সেইফটি অ্যান্ড রাইটস সোসাইটি (এসআরএস) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ বলেন, 'একটি নিয়ম বহির্ভুত ইমারত কীভাবে তৈরি হয়? এসব ইমারতের অনুমতি কারা দেন এবং কীভাবে তৈরি হয় তাদের চিহ্নিত করা দরকার।'
তিনি বলেন, 'বিগত দিনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো ঝুলে আছে বছরের পর বছর। আর মামলাগুলো করা হয় অবহেলিত কারণে মৃত্যু দেখিয়ে। কিন্তু এটা সরাসরি বেআইনি কারণে মৃত্যু। এখন সময় এসেছে এসব মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে বিচার চাওয়ার।'
তিনি আরও বলেন, 'কীভাবে মানুষের সাহস হয় ভবনের নকশা পরিবর্তন করে অন্য কাজে ব্যবহার করার। যেখানে রেস্টুরেন্টের অনুমোদন নেই, সেখানে রেস্টুরেন্ট করা হচ্ছে। এসব কাউকে না কাউকে ম্যানেজ করেই করা হয়। আর সেটা আইন ভেঙে। বেআইনিভাবে যারা নকশা বহির্ভূত ভবন করছেন তাদের আগে ধরতে হবে৷ এরপর ধরতে হবে ভবন মালিকদের।'
২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের করা মামলা নিয়ে বেলার কো-অর্ডিনেটর (লিগ্যাল) এস. হাসানুল বান্না বলেন, 'পুরান ঢাকার নিমতলীতে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১১৯ জন মানুষ প্রাণ হারান। তখন দায়ের করা রিট পিটিশনে হাইকোর্ট বিভাগ ঢাকা শহরের অগ্নি নির্বাপন ও প্রতিরোধে পর্যাপ্ত এবং কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারি করলেও সেগুলোর বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে রিট পিটিশনটি হাইকোর্টে শুনানির অপেক্ষায় আছে।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'আমাদের প্রতিনিয়ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। শ্রমিকরা দগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন। বহুতল ভবন নয়, বস্তিতেও আগুন লাগে এবং লাগানো হয়। মানুষের জীবনের কোনো দাম নেই। একটি শোক দিবসও পালন করা হয় না। এখন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে বাচ্চারা ও আমরা ভয় পাই।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সহসভাপতি স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, 'প্রতিটি ভবনের সামনে ওই ভবন সম্পর্কিত বিষয়গুলো উল্লেখ করে ব্যানার টাঙিয়ে দিতে হবে। যেন দেখেই বোঝা যায় সেই ভবনে প্রবেশ আমার জন্য ঠিক হবে কি না।'
তিনি বলেন, '২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত যেসব ভবন ঢাকায় হয়েছে তার ৯৬ শতাংশই অবৈধ। এই নগরীর বড় সমস্যা হচ্ছে কেন্দ্রীভূত সবকিছু। এজন্য ক্ষমতা ও কার্যক্রম তদারকি থাকতে হবে।'
চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত একজনের স্ত্রী ফাতেমা আক্তার বলেন, 'এত বছর পার হলেও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। আমাদের চোখের সামনে অপরাধীরা ঘুরছে, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।'
সভায় বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদের সঞ্চালনায় এবং এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদার সভাপতিত্বে অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন।