৩ হাজার কোটি টাকার কৃষি প্রকল্পের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তে দুদক

কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য সরকারের ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের একটি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
কৃষিকাজে শ্রমিক সংকটের তীব্রতা মোকাবিলায় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়িয়ে শস্য অপচয় রোধ, চাষাবাদে সময় ও অর্থ সাশ্রয়, কৃষিতে উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্য ২০২০ সালের জুনে 'সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরন প্রকল্প'-এর বাস্তবায়ন শুরু হয়।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাইস ট্রান্সপ্ল্যান্টার, রিপার, কম্বাইন হারভেস্টার, পাওয়ার থ্রেসার, সিডারসহ বিভিন্ন যন্ত্র হাওর ও দাক্ষিণাঞ্চলীয় উকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে বিতরণ করা হচ্ছে।
কিন্তু প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পরই কম দামে কৃষকদের কাছে নিম্নমানের যন্ত্রপাতি বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে। চলতি বছরের জুনে প্রকাশিত পরিকল্পনা পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার পর অভিযোগগুলো শক্ত ভিত্তি পায়।
গত নভেম্বরের মাঝামাঝিতে দুদকের উপপরিচালক মো. ইয়াছির আরাফাতকে প্রধান করে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি দুই ধাপে তদন্ত করছে। এর মধ্যে প্রকল্পের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ব্যক্তিগত দুর্নীতি এবং কৃষি যন্ত্র বিতরণ, কেনাকাটায় বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির তদন্ত করা হচ্ছে।
দুদক কর্মকর্তারা জানান, প্রকল্পটির সাবেক প্রকল্প পরিচালক মো. বেনজির আলম, বর্তমান ডিপিডি আলতাবুন নাহার, মনিটরিং অফিসার জুলফিকার আলী ভুট্টো, ঊর্ধ্বতন হিসাব রক্ষক আব্দুল খালেক, সহকারী হিসাব রক্ষক আরমানসহ মোট ৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর ব্যক্তিগত দুর্নীতির তদন্ত হচ্ছে।
একই সঙ্গে প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত জনবল নিয়োগ, পরামর্শক নিয়োগ, যেসব প্রতিষ্ঠানকে যন্ত্র সরবরাহে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তাদের বৈধতা, যন্ত্র যথাযথভাবে বিক্রি হয়েছে কি না, প্রকল্পের আমদানি-বিতরণ ও মজুতসহ বিভিন্ন বিষয়ে যাছাই-বাছাই শুরু করেছে এই তদন্ত কমিটি।
এজন্য অবশ্য প্রকল্প অফিসে চিঠি দিয়ে সব ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে দুদক থেকে।
প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দুদক আমাদেরকে চিঠি দিয়েছে। তারা যেসব তথ্য আমাদের কাছে চাচ্ছে, সেগুলো দিয়ে আমরা সব ধরনের সহযোগিতা করছি।'
তিনি বলেন, 'তদন্ত চলমান অবস্থায় অভিযোগগুলোর বিষয়ে কোনো কথা বলা উচিত নয়।'
আইএমইডির প্রতিবেদনে যা উঠে এসেছে
আইএমইডির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্নমানের যন্ত্র যেমন হেড ফিড কম্বাইন হারভেস্টার বারবার নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে কৃষকেরা এই যন্ত্র ব্যবহারেই অনীহা প্রকাশ করছেন। যে কারণে হারভেস্টারে বিনিয়োগ করা অর্থ না ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় অনেক কৃষকই মানসম্মত যন্ত্র পাননি।
এর কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, যন্ত্র সরবরাহকারী অনেক প্রতিষ্ঠানই কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা ছাড়াই প্রকল্পে তালিকাভুক্ত হয়। অথচ কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কৃষিযন্ত্রের ব্যবসায় অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছিল।
একই যন্ত্র একাধিকবার বিক্রি, যন্ত্র বিক্রির চেয়ে বেশি পরিমাণে ভর্তুকির টাকা তুলে নেওয়া, একই যন্ত্র দিয়ে একাধিকবার ভর্তুকির টাকা উত্তোলন, তালিকাভুক্ত কৃষককে যন্ত্র না দেওয়া, বিদেশ থেকে নিম্নমানের যন্ত্র আমদানি ও সেগুলো মাঠ পরীক্ষা ছাড়াই কৃষকের মাঝে বিতরণ করার মতো নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
আইএমইডি তাদের মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলেছে, মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অনেকে তালিকাভুক্ত না হয়েও প্রকল্প থেকে যন্ত্র পেয়েছেন, আবার অনেকে তালিকাভুক্ত হওয়ার পরও যন্ত্র পাননি। অনেকে বিভিন্ন নামে প্রকল্প থেকে একাধিক যন্ত্র নিয়েছে।
আইএমইডি বলছে, অনেক কৃষকের নাম চূড়ান্তভাবে তালিকাভুক্ত হওয়ার পর মেশিনের নাম, মডেল, ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বরসহ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে এবং মেশিন হস্তান্তর অনুষ্ঠান করার পর সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেশিনটি তাদের শো-রুমে ফেরত নিয়ে অন্য জায়গায় বিক্রি করেছে। একই যন্ত্র দিয়ে একাধিকবার ভর্তুকির টাকা নিয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এ কাজে প্রকল্প অফিসের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। আবার যে অঞ্চলে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে যন্ত্র বিতরণের কথা সেখানে ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতেও যন্ত্র বিতরণ করা হয়েছে।
যন্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দেশের বিভিন্ন জেলায় সার্ভিস সেন্টার থাকার কথা থাকলেও সেটা বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই নেই। এ কারণে যন্ত্র নষ্ট হয়ে গেলে কৃষকদেরকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়, কারণ প্রয়োজনীয় পরিমাণ মেকানিক নেই কোম্পানিগুলোর।