অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পরাজয়ের পর ফ্রান্সে সরকারের পতন
ফরাসি আইনপ্রণেতারা সোমবার ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরুকে পদচ্যুত করার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এর ফলে দেশটি নতুন রাজনৈতিক সংকটে পড়েছে এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপ ও ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার সময় সরকারহীন অবস্থার মুখে পড়েছে।
বাইরু ৪৪ বিলিয়ন ইউরো (৫১ বিলিয়ন ডলার) সঞ্চয় পরিকল্পনা অনুমোদনের চেষ্টা করতেই নিজেই এই ভোট ডাকেন। ওই পরিকল্পনায় দুটি সরকারি ছুটি বাতিল এবং সরকারি ব্যয় স্থগিত রাখার প্রস্তাব ছিল, যা অনেকটাই অগ্রহণযোগ্য ছিল। শেষ পর্যন্ত ৩৬৪ জন এমপি বাইরুর বিপক্ষে ভোট দেন এবং ১৯৪ জন তার পক্ষে ভোট দেন। বাইরুকে ক্ষমতাচ্যুত করতে যে ২৮০ ভোটের প্রয়োজন ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ভোট পাওয়ায় তার সরকারের পতন হয়েছে।
মাত্র নয় মাস দায়িত্ব পালনের পর প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঁসোয়া বাইরুকে এখন পদত্যাগ করতে হবে। এর মাধ্যমে তিনি তার পূর্বসূরি মিশেল বার্নিয়ের পথেই হাঁটলেন, যিনি গত ডিসেম্বর অনাস্থা ভোটে হেরে পদচ্যুত হয়েছিলেন।
এলিসি প্রাসাদের বরাতে জানা গেছে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ আগামী কয়েক দিনের মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন। তবে বাইরুর পদত্যাগ ম্যাখোঁকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে, কারণ তার সামনে গ্রহণযোগ্য বিকল্প প্রার্থীর সংখ্যা খুবই সীমিত।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। ফরাসি সরকারি বন্ডের আয় বা বিনিয়োগকারীদের চাওয়া সুদের হার এখন স্পেন, পর্তুগাল ও গ্রিসের বন্ডের চেয়েও বেশি, যদিও এক সময় এই দেশগুলোই ছিল ইউরোজোন ঋণ সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। আগামী শুক্রবার ফ্রান্সের সার্বভৌম ঋণমান পর্যালোচনায় সম্ভাব্য অবনমন দেশটির ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অবস্থানে আরও বড় আঘাত হানতে পারে।
সোমবার ভোটের আগে আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে বাইরু বলেন, 'আপনারা সরকারের পতন ঘটানোর ক্ষমতা রাখেন, কিন্তু বাস্তবতাকে মুছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। বাস্তবতা কঠোরভাবেই থেকে যাবে: ব্যয় বাড়তেই থাকবে, আর ঋণের বোঝা—যা ইতিমধ্যেই অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে—আরও ভারী ও ব্যয়বহুল হয়ে উঠবে।'
বাইরু স্বীকার করেন যে তারা তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে করা 'সামাজিক চুক্তি ভেঙে ফেলেছেন'।
ফ্রান্সের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সূত্রপাত প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ গত বছরের নাটকীয় সিদ্ধান্তে। ২০২৪ সালের মে মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালির চমকপ্রদ ফলাফলে ক্ষুব্ধ হয়ে ম্যাখোঁ আকস্মিক নির্বাচনের ডাক দেন। তবে সেই সিদ্ধান্ত উল্টো ফল বয়ে আনে। নির্বাচনে ম্যাখোঁর দল ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয় শক্তির কাছে আসন হারায়, ফলে ফ্রান্স এক বিভক্ত ও অস্থিতিশীল সংসদ পায়।
এরপর কী?
এলিসি প্রাসাদের বরাতে জানানো হয়েছে, ফ্রাঁসোয়া বাইরু মঙ্গলবার সকালে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। এরপর আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ম্যাখোঁ নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকোর্নু ও বিচারমন্ত্রী জেরাল্ড দারমানিনকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে এগিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে এই পদকে 'বিষপেয় পেয়ালা' হিসেবে দেখা হচ্ছে—অর্থাৎ যিনি নিয়োগ পাবেন, তাকেই কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
বাইরুর পতনের আগেই প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁর সরে দাঁড়ানোর আহ্বান উঠেছিল। তবে তিনি মেয়াদের শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করার অঙ্গীকার করেছেন। ডানপন্থী নেত্রী মেরিন লে পেন সংসদ ভেঙে নতুন নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। কিন্তু নতুন নির্বাচন হলে তার দল আরও শক্তিশালী হবে এবং ফরাসি সংসদ আরও বেশি বিভক্ত হয়ে পড়বে।
ম্যাখোঁর জন্য সমস্যা হলো, পরপর তিনজন মধ্যমপন্থী প্রধানমন্ত্রী ব্যর্থ হওয়ার পর বিরোধীদলগুলো আরেকজনকে সুযোগ দিতে একেবারেই রাজি নয়। ডানপন্থী ও বামপন্থী উভয় শিবিরই স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, যদি আবার একজন মধ্যমপন্থী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেওয়া হয় তবে তারা সঙ্গে সঙ্গেই অনাস্থা ভোটের প্রস্তাব আনবে। তাত্ত্বিকভাবে ম্যাখোঁ অন্য কোনো রাজনৈতিক শিবির থেকে প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে পারেন, তবে তিনি যদি ডান দিক থেকে কাউকে বেছে নেন, বাম শিবির তা বাধা দেবে, আর বাম দিক থেকে কাউকে বেছে নিলে ডান শিবির বাধা দেবে।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীকেও সমানভাবে কঠিন বাজেট যুদ্ধের মুখে পড়তে হবে। সোশ্যালিস্ট পার্টি ধনীদের ওপর কর বাড়াতে এবং ম্যাখোঁর ব্যবসায়ীদের জন্য দেওয়া কর ছাড় বাতিল করতে চায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা দল ও আকস্মিক নির্বাচনের পর গড়া জোটের গুরুত্বপূর্ণ অংশ 'লে রিপাবলিকান' এসব প্রস্তাব একেবারেই মানতে রাজি নয়। এর ফলে ফ্রান্সের আর্থিক জট শিগগিরই মিটবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
যদি আবার আকস্মিক সংসদ নির্বাচন হয়, সাম্প্রতিক এলাবে জরিপে দেখা গেছে ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি সবচেয়ে বেশি আসন পাবে, বামপন্থীরা দ্বিতীয় স্থানে থাকবে আর ম্যাখোঁর মধ্যমপন্থী জোট থাকবে অনেক পিছিয়ে তৃতীয় স্থানে। এখন অনেকেই ধরে নিচ্ছেন, অবশেষে ডানপন্থীরাই ক্ষমতায় আসবে—যদি এখনই না হয়, তবে ২০২৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর। যদিও খুব কম মানুষই বিশ্বাস করেন, এতে ফ্রান্সের সমস্যাগুলোর প্রকৃত সমাধান হবে।
ফরাসি রাজনীতিবিদদের প্রতি জনসাধারণের আস্থা ভেঙে পড়েছে এবং ক্ষোভ রাস্তায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। বামপন্থীরা বুধবার সারা দেশে 'ব্লোকঁ তু' (অর্থাৎ 'সবকিছু অবরুদ্ধ করো') স্লোগানে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। এ ছাড়া ট্রেড ইউনিয়নগুলো ১৮ সেপ্টেম্বর আরেক দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সবকিছু ঘটছে একেবারে সবচেয়ে অস্বস্তিকর ভূরাজনৈতিক সময়ে—যখন ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে। প্যারিসের এই অস্থিতিশীলতা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার মার্কিন সমকক্ষ ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য বড় সুযোগ, কারণ তারা ইউরোপের দুর্বলতাকে উপহাস করে আনন্দ পান।
