গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ করার সময় এখনই: প্রধানমন্ত্রী

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা 'গ্লাসগো জলবায়ু চুক্তি অনুসরণ করার এখনই সময়' শীর্ষক একটি নিবন্ধ রোববার (৬ নভেম্বর) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া, আর্লিংটন কাউন্টিতে অবস্থিত একটি আমেরিকান-জার্মান মালিকানাধীন রাজনৈতিক সাংবাদিকতা পত্রিকা কোম্পানি 'পলিটিকোতে' প্রকাশিত হয়েছে।
নিবন্ধটির সম্পূর্ণ পাঠ্য নিচে তুলে ধরা হলো:
মানব ইতিহাসের অন্য কোনো সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার চেয়ে জরুরি কোনোকিছু প্রমাণিত হয়নি; এই গ্রহ, আমরা যাকে বাড়ি বলি এবং অন্যান্য প্রজাতির সঙ্গে আমরা যেটি ভাগাভাগি করে নিয়েছি, সেখানে আমাদেরকে এরচেয়ে বড় আর কোনো বেশি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হয়নি।
যাইহোক, উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা এবং অনুপ্রেরণাদায়ক ভাষা এখন কেবল শূন্য অনুভূতি সৃষ্টি করে। বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল ধরে জোরদার পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে আসলেও খালি প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই পাননি।
এক শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি বাংলাদেশের সিলেটের মানুষের কাছে এই শব্দগুলো পর্যাপ্ত নয়। শব্দগুলো আকস্মিক বন্যা থেকে তাদের বাড়িঘর ও জীবিকা ধ্বংস হওয়া, তাদের প্রিয়জনদের মৃত্যু ঠেকাতে পারেনি এবং গতমাসে পাকিস্তানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩৩ মিলিয়নের মানুষের জন্য সমর্থন বা ছোট সাহায্য প্যাকেজের টুইটগুলোও যথেষ্ট ছিলনা।
এর পরিবর্তে, আমি আজ যা আহ্বান করছি, তা হল পদক্ষেপ- গত বছর গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ-২৬-এ দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য পদক্ষেপ; গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মতো কঠোরতম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, আমাদের মতো এমন দেশগুলোকে সহায়তা করার জন্য বিশ্ব নেতারা যখন আবারও একত্রিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এবার শারম আল-শেখ এ আমি আমার সম্মানিত সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা রক্ষার উপায় যেন খুঁজে বের করেন। অন্ততপক্ষে ২০২৫ সালের মধ্যে অভিযোজনের পাশাপাশি অর্থের ব্যবস্থা দ্বিগুণ করার জন্য।
উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুত আর্থিক সহায়তা প্রাপ্তিকে একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত; এটি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা আমাদের মতো দেশগুলোর জন্য অত্যাবশ্যক। এটি ভবিষ্যতের কোনো সময়ের জন্য তুলে রাখা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃত পরিণতির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি এবং এই মুহূর্তে এ লড়াই চালিয়ে যেতে হলে অবিলম্বে সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ বর্তমানে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে ০.৫৬ শতাংশ অবদান রাখছে; তবুও, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশের ক্ষতির অনুপাত অপ্রতিরোধ্য।
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, উপকূলীয় ক্ষয়, খরা, তাপ এবং বন্যা সবই আমাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এগুলো আমাদের অবকাঠামো এবং কৃষি শিল্পকে ধ্বংস করবে; কারণ, আমরা চরম এবং ধীরগতির জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত ক্ষয়ক্ষতির মুখোমুখি হয়ার পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধ, হ্রাস এবং মোকাবেলায় যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হচ্ছি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট উষ্ণায়নের কারণে আমাদের জিডিপি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, এবং গড় আয় ২১০০ সালে ৯০ শতাংশ কম হবে বলে অনুমান করা হয়েছে। অন্যদিকে, ইন্টারগভার্মেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনে ধারণা করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে দারিদ্র্য প্রায় ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
এই ধরনের উদ্বেগজনক পূর্বাভাসের মুখোমুখি হলে হতাশাগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক; এমন সময় জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান শোনা তো যাচ্ছেই না এবং এ সংক্রান্ত অগ্রগতিও খুব ধীরগতির। উদ্বেগের পক্ষাঘাতে ডুবে যাওয়া অনেক সহজ হবে, তবে আমাদের অবশ্যই তা প্রতিরোধ করতে হবে।
আর বাংলাদেশে আমরা সেটিই করছি।
এই ধরনের গুরুতর হুমকির মুখে আমরা এখন পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়গুলো মোকাবেলা করার জন্য আমরা মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনাও উন্মোচন করেছি, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য আমাদের এনার্জি নেটওয়ার্ককে ডিকার্বনাইজ করা থেকে শুরু করে সবুজ বিনিয়োগের উদ্যোগ, আমাদের গতিপথকে ক্ষতির প্রভাব থেকে বাঁচাবে এবং এর পরিবর্তে এনে দেবে সমৃদ্ধি।
২০০৯ সালে আমরা একটি বিস্তৃত জলবায়ু পরিবর্তন কৌশল এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এমন পদক্ষেপ গ্রহণে আমরাই প্রথম। এখন পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন অভিযোজন এবং প্রশমন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ৪৮০ মিলিয়ন বরাদ্দ রেখেছি।
বর্তমানে, আমরা আমাদের উপকূলীয় জেলা কক্সবাজারে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য একটি আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছি। এই প্রকল্পে প্রায় ৫,০০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছি। আমার ১৮ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে আমার সরকার আজ পর্যন্ত প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যক্তিকে বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে।
ইতোমধ্যে আমরা 'বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০' গ্রহণ করেছি, যার লক্ষ্য একটি নিরাপদ, জলবায়ু-সহনশীল এবং সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ গড়ে তোলা। প্রতিবছরই আমার সরকার আমাদের দেশের গাছের সংখ্যা বাড়াতে লক্ষ লক্ষ চারা রোপণ করছে।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম (সিভিএফ) এবং ভি-২০-এর সাবেক চেয়ার হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থ প্রচারে মনোনিবেশ করে চলেছে। শুধু বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়; আমরা সফল হতে চাই, একজন বিশ্বনেতা হতে চাই, আমাদের প্রতিবেশী এবং বিশ্বকে দেখাতে চাই যে, এখনও একটি আশাপূর্ণ ভবিষ্যতের পথ রয়েছে; কিন্তু আমরা একা এটি করতে পারবো না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কথাগুলোকে অবশ্যই কাজে পরিণত করতে হবে।
গ্লাসগোতে সম্মত হওয়া অভিযোজন তহবিলে ৪০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অবশ্যই আমাদের সাধারণ ভবিষ্যতের প্রাথমিক বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অন্যথায়, নিষ্ক্রিয় থাকার জন্য ভবিষ্যতে চরম মূল্য দিতে হবে। গত বছরের আইপিসিসি ওয়ার্কিং গ্রুপের দ্বিতীয় প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই সতর্ক করেছে, ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জিডিপি ১০ থেকে ২৩ শতাংশ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা পূর্বের পূর্বাভাসের চেয়ে অনেক বেশি।
২১ শতকের প্রতিটি বছর পেরিয়ে যাওয়া সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গ্রহের জলবায়ু সংক্রান্ত ঝুঁকিগুলো আরও গভীর হচ্ছে। সরবরাহ লাইন এবং শক্তি নির্ভরতা আমাদের সবার ওপরেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ বছর ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্যে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে।
আমরা যেদিকেই তাকাই না কেনো, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ সংক্রান্ত ক্ষয়ক্ষতি সাধারণ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বজুড়ে অসংখ্য উপায়ে এটি চলছে এবং আমাদের মতো জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশগুলো লাগাতার এ সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকলে খুব শিগগিরই অন্যান্য জাতির দ্বারস্থ হতে হবে।
আমাদের যদি এই বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার কোনো আশা থাকে, তাহলে আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে বন্যা, ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, ইউরোপের খরা- তাপমাত্রা ১.২ ডিগ্রি বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট- সবই পরস্পর সম্পর্কিত এবং আমাদেরকে অবশ্যই একসঙ্গে এগুলোর মোকাবেলা করতে হবে।
গতবছর দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে হবে; তাহলেই কেবল সেই প্রতিশ্রুতিগুলো অবশেষে কাজের দিকে এগোবে।