যুবকের ৪৪৬ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিলামে তোলা হচ্ছে মর্টগেজ রাখা সম্পত্তি

প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকেই শুধু আড়াই হাজার কোটি টাকাই সংগ্রহ করেনি যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক), কল্পিত প্রকল্পের নামে ব্যাংক থেকে বিশাল অংকের ঋণ নিয়ে তাও আত্মসাৎ করেছে।
দেশের ৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৪ সালে নেয়া ৩০০ কোটি টাকার একটি সিন্ডিকেট লোনের স্থিতি বর্তমানে সুদসহ দাঁড়িয়েছে ৪৪৬ কোটি টাকা। মোবাইল অপারেটরদের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে টাওয়ার নির্মাণের জন্য টেলিবার্তা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে এই ঋণ নেয়া হয়েছিল।
যুবকের এই প্রকল্পের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে ঋণ আদায়ের জন্য দীর্ঘ ১২ বছর আইনী লড়াই করেছে ঋণদানকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। সেই লড়াইয়ে জয়ী হয়ে তারা মর্টগেজ রাখা যুবকের দুটি সম্পত্তি বিক্রির জন্য ২৫ জানুয়ারি নিলামে তুলতে যাচ্ছে।
যুবককে ঋণ দেয়া ৬টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- ঢাকা ব্যাংক, এবি ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ফিনিক্স ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এবং প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স লিমিটেড। সিন্ডিকেট লোনে লিড ব্যাংকের দায়িত্ব পালন করে ঢাকা ব্যাংক।
৩০০ কোটি টাকার মধ্যে ঢাকা ব্যাংক ১০০ কোটি, এবি ব্যাংক ১০০ কোটি, উত্তরা ব্যাংক ৫০ কোটি, পিপলস লিজিং ২৫ কোটি, ফিনিক্স ফাইন্যান্স ১০ কোটি এবং প্রিমিয়ার লিজিং ১৫ কোটি টাকা দিয়েছিল।
পাওনা আদায়ে নিলামে তোলা হচ্ছে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ভবনসহ দেড় বিঘার একটি এবং পুরানা পল্টন লেনে ১৩ কাঠার আরেকটি প্লট।
যুবক কেলেংকারির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ড. ফরাসউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ২০১০ সালে গঠিত কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেজগাঁওয়ের প্লটটির তৎকালীন বাজারমূল্য প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। পুরানা পল্টন লেনের প্লটের দাম প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
ঢাকা ব্যাংকের প্রধান আইন কর্মকর্তা ফারহানা আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ২০০৮ সালে যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করার পর আদালতে আবেদন করে মর্টগেজ রাখা এই দুটি সম্পত্তি নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেয় ঢাকা ব্যাংক।
অভিযোগ আছে, তৎকালীন বিএনপি সরকারের একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী, যিনি একইসঙ্গে ঢাকা ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যও, যুবককে এই ঋণ পাইয়ে দেয়ার ব্যাপারে ভূমিকা রেখেছিলেন। ঢাকা ব্যাংক অবশ্য দাবি করেছে, টেলিবার্তায় যুবকের বিনিয়োগ ও সম্পদ যথাযথভাবে যাচাই করেই নিয়ম মেনে ঋণ দেয়া হয়েছিল।
চেয়ারম্যান আবু মোহাম্মদ সাঈদ ও নির্বাহী পরিচালক হোসাইন আল মাসুমের নেতৃত্বে চল্লিশজন পরিচালক নিয়ে ১৯৯৪ সালে কোনো নিবন্ধন ছাড়াই কার্যক্রম শুরু করে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি (যুবক)। ১৯৯৭ সালে এসে প্রতিষ্ঠানটি দ্য সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্টে নিবন্ধিত হয়।
শুরু থেকেই এক লাখ টাকার আমানতে বছরে ১০ হাজার টাকা সুদ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সদস্যপ্রতি সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা করে মাসিক সঞ্চয় নেয়া শুরু করে যুবক। কল্পিত আবাসিক প্রকল্পে প্লট বেচার নামেও মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধের আগে আমানতকারীদের কাছ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করে যুবক। এই অর্থ দিয়ে অন্তত ২০ ধরনের ব্যবসা শুরু করা হয়, যার অন্যতম ছিল টেলিবার্তা।
টেলিবার্তা প্রকল্পের আওতায় মোবাইল অপারেটরদের কাছে ভাড়া দেয়ার জন্য সারাদেশে ২৫০টি টাওয়ার স্থাপন করার কথা বলেছিল যুবক। ব্যাংকঋণের আবেদনে টাওয়ার নির্মাণের পাশাপাশি যুবক ফোনের সুইচিং কন্ট্রোল রুম স্থাপনের কথাও বলা হয়েছিল।
এক যুগের আইনি লড়াই
খেলাপি ঋণ আদায়ে যুবকের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালে ঢাকার অর্থঋণ আদালতে দায়ের করা মামলার বিচারকাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। তখন যুবকের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট করলে প্রথমে মামলার কার্যক্রম পরিচালনায় ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেয় আদালত।
স্থগিতাদেশ পরে বাড়তে বাড়তে ২০১৪ সাল পর্যন্ত মাঝামাঝি পর্যন্ত গড়ায়। সে বছরেই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে অক্টোবর থেকে শুরু হয় বিচারকাজ। গত বছরের ১৯ নভেম্বর অর্থঋণ আদালত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে রায় দেয়।
রায় বাস্তবায়নে এরপর এক্সিকিউশন মামলা হলে গত নভেম্বরে মর্টগেজ রাখা সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকের পাওনা বুঝিয়ে দিতে ঢাকার জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের আদেশ দেয় আদালত।
ঢাকা ব্যাংকের আইন কর্মকর্তা ফারহানা আহমেদ বলেন, আগামি ২৫ জানুয়ারি বেলা ২ ঘটিকায় মর্টগেজড সম্পত্তি নিলামে তোলা হবে।
ড. ফরাসউদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, যুবক শুধু মানুষের কাছ থেকেই প্রতারণামূলকভাবে টাকা নেয় নাই, ব্যাংক থেকেও একইভাবে ঋণ নিয়েছে। কার্যক্রম শুরু করার পর থেকেই বিতর্কিত একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে এতোবড় সিন্ডিকেট ঋণ পেয়েছে, তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।