ক্র্যাশ প্রোগ্রামে ‘ক্রাশ’ হচ্ছে না ডিএনসিসি’র মশা

নাসিমা বেগম, থাকেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) পল্লবী থানার সাগুফতা খাল এলাকায়। সন্ধ্যা হলেই বাসায় তিন-চারটি মশার কয়েল জ্বালিয়ে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়াসহ ঘরের কাজ সারতে হয়। এরপরেও রেহাই মেলেনা মশা থেকে। রাতে মশারি টাঙ্গিয়ে ঘুমানোর পরও প্রায় মাঝ রাত পর্যন্ত দুই হাত দিয়ে মশারির ভেতরের মশা মারতে হয়।
নাসিমা বেগম টিবিএসকে বলেন, "গত ৮ মার্চ এখানে ডিএনসিসি'র মেয়রসহ অন্যরা এসে মশার ওষুধ, স্প্রে, ফগার মেশিন দিয়ে ধোয়া দিয়ে গেল। ভেবেছিলাম মশা কমবে; কিন্তু এখন মশার জ্বালাতন আরও বেড়েছে! রাতে মশা মারতে মারতে হাত লাল হয়ে যায়। শনিবার রাতেও বাচ্চাদের মশারির মধ্যে বসিয়ে রেখে পড়িয়েছি। এরপরেও মশা থেকে মেলেনি মুক্তি।'
শুধু নাসিমা বেগমই নন, মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ পুরো নগরবাসী। অন্য মশার সঙ্গে বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। তাই এ থেকে রেহাই পেতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই চালানো হয় মশা নিধনে নতুন নতুন প্রক্রিয়ায় অভিযান। থাকে কোটি কোটি টাকার বাজেট।
এ বছরের মশা নিধনের জন্য নতুন পদ্ধতিতে গত ৮ মার্চ থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে শুরু হয় অঞ্চলভিত্তিক সমন্বিত মশক নিধন অভিযান (ক্র্যাশ প্রোগ্রাম)। পল্লবী থানার সাগুফতা খাল এলাকা পরিদর্শন করে এ ক্র্যাশ প্রোগ্রামের উদ্বোধন করেন ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।
১০ দিনের এ কর্মসূচির আওতায় প্রতিদিন ডিএনসিসির একটি করে অঞ্চলে এ অভিযান চালানো হচ্ছে। গত এক সপ্তাহে (১৪ মার্চ পর্যন্ত) ৭টি অঞ্চলে এ ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানো হয়। কিন্তু মশা নিধনের এ ব্যবস্থায়ও স্বস্তি পাচ্ছেন না ডিএনসিসি'র বাসিন্দারা।
গত এক সপ্তাহে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম সম্পন্ন হওয়া অঞ্চলগুলোতে সরেজমিনে গিয়ে এবং স্ব স্ব অঞ্চলের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ ক্র্যাশ প্রোগ্রামে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি মশা নিধনের ক্ষেত্রে।
অধিকাংশ অঞ্চলের ডোবা-নালা, ঝোপ-ঝাড় পরিষ্কার করা হয়নি। কিছু কিছু খালে পানির প্রবাহ থাকলেও ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালানোর পরও দেখা মেলছে মশক লার্ভাসহ ছোট-বড় মশার।
মিরপুর আগারগাঁও তালতলার বাসিন্দা সারমিন ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'ওষুধ প্রয়োগের পরে মনে হচ্ছে বাইরের মশাগুলোও বাসার মধ্যে এসে পড়েছে! মশা তো কমছেই না; বরং বাড়ছে।'
পল্লবীর বাসিন্দা সুজন মিয়া বলেন, 'মশার খুব চাপ! ঘরে মশা, বাইরে মশা, সন্ধ্যার পরে বাইরে থাকার সুযোগই নেই। সিটি করপোরেশন থেকে ওষুধ দিয়ে গেলে মশা কমার কথা; কিন্তু কমছে না। ওষুধ দিয়ে যায়, নাকি পানি দিয়ে যায়, তারাই ভালো জানে!'
রোববার ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, 'মশক নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান সনাতনী পদ্ধতি থেকে আমাদেরকে আধুনিক পদ্ধতিতে যেতে হবে। আধুনিক পদ্ধতিতে যাওয়ার জন্য চতুর্থ প্রজন্মের কীটনাশক নোভালিউরন নিয়ে এসেছি। কিন্তু এগুলো যখন কাঠিতে গেঁথে জলাশয়ে দিয়েছি, তখন মাছের জাল দিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে।'
মশা নিধনের বর্তমান পদ্ধতিগত পরিবর্তন করতে হলে মশক নিধনকর্মীদের বায়োমেট্রিক ট্র্যাকারের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে বলে জানান তিনি।
মেয়র আরও বলেন, 'বৃষ্টি হলে এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। সেটির আরেকটি চ্যালেঞ্জ শুরু হয়ে গিয়েছে। কিউলেক্স মশা নিধনের অভিযান শেষ হওয়ার সাথে সাথে এডিস মশার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।'
আদৌ মশার ওষুধ কোনো কাজ করছে কি না, জানতে চাওয়া হলে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, 'ডিএনসিসি এখন যে প্রক্রিয়ায় মশা নিধন কার্যক্রম চালাচ্ছে, তা পুরোপুরি আনপ্রফেশনানি প্রক্রিয়ায়। আমি নিজেও দেখেছি মেয়রের সাথে থেকে এ অভিযান। তাই যা দেখলাম, এ প্রক্রিয়ায় মশা নিধন সম্ভব না।'
'এর জন্য দরকার একদল এক্সপার্ট কীটতত্ত্ববিদ, যারা সারাক্ষণ এগুলো নিয়ে গবেষণা করবেন এবং কোন মাত্রার কী কী ওষুধ প্রয়োগ করা দরকার, তা ঠিক করবেন। শুধু ফগার মেশিন দিয়ে ধোঁয়া দিলে আর কীটনাশক ছিঁটালেই মশা মরবে না,' বলেন তিনি।
ডিএনসিসি'র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ জোবায়দুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা গত এক সপ্তাহে চালানো মশক নিধন কর্মসূচির পজেটিভ ফিডব্যাক পাচ্ছি। এরমধ্যে অনেক জায়গায়ই মশা কমেছে; তবে একেবারে কমানো সম্ভব না। এ মশা নিধনের দায়িত্ব শুধু সিটি করপোরেশনের নয়; জনগণেরও। কেউ নিজের জমিতে যদি ভাগাড়ে করে রাখে, সেখানে মশা তো জন্মাবেই। এজন্য সবার সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার।'
স্পেন থেকে আমদানি করা হবে কীটনাশক
মশক নিয়ন্ত্রণের জন্য স্পেন থেকে উন্নতমানের কীটনাশক আমদানি করা হবে বলেও জানিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র মোঃ আতিকুল ইসলাম।
রোববার দুপুরে গুলশানস্থ ডিএনসিসির নগর ভবনে বাংলাদেশে নিযুক্ত স্পেনের রাষ্ট্রদূত ফ্রান্সিসকো দে আসিস বেনিতেজ সালাসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে মেয়র এ কথা বলেন।
মশা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে স্পেন থেকে উন্নতমানের কীটনাশক আমদানিতে সম্ভাব্য সকল সহযোগিতা করা হবে বলে জানান স্পেনের রাষ্ট্রদূত।
প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা নেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের
সিটি করপোরেশনের মশা নিধনে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মশার ওষুধ প্রয়োগের ধারণা গতানুগতিক। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা তাদের নেই বললেই চলে। যারা মাঠে ওষুধ প্রয়োগ করেন, তারা তাদের মতো করেই দায়সারাভাবে করে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন মশার ওষুধ প্রয়োগকারী কর্মচারীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, তাদের এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো প্রশিক্ষণ নেই। একবার দেখানো অনুপাতের ভিত্তিতে তারা মশার ওষুধ প্রয়োগ ও ফগার মেশিনের মাধ্যমে ধোঁয়া দেন।
কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, "ডিএনসিসি'র মেয়রের আন্তরিকতার ঘাটতি নেই; তবে শুধু আন্তরিকতা থাকলেই হবে না, মশা নিধনের জন্য পর্যাপ্ত লোকবল ও প্রশিক্ষণ দরকার- যার প্রচুর ঘাটতি আছে ডিএনসিসি'র।"
'প্রয়োজনের তুলনায় কীটতত্ত্ববিদ খুবই কম রয়েছেন; আবার যারা আছেন, তারা সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারছেন বলে আমার মনে হচ্ছে না। কোন স্থান, ঘনত্ব প্রভৃতির জন্য কোন ধরনের প্রক্রিয়া এবং কী পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করা দরকার, সে বিষয়ে তাদের ধারণা নেই বললেই চলে।"
ডিএনসিসি'র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোঃ জোবায়দুর রহমান বলেন, 'আমাদের চারজন কীটতত্ত্ববিদ রয়েছেন, যারা এগুলোর নমুনা নিয়ে ওষুধ প্রয়োগের পরিমাণ এবং অন্যন্য ব্যবস্থা ঠিক করেন। আর যারা মাঠে কাজ করেন, তারা কাজ করতে করতেই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। সেক্ষেত্রে আলাদা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। তবে আমাদের যা জনবল আছে, তাদের দিয়েই সম্ভব- যদি মানুষ সচেতন হয়।'
- সংবাদটি ইংরেজিতে পড়ুন: Dhaka North's crash programme fails to crush mosquitoes