আম্পানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত সুন্দরবন উপকূল

এগার বছর আগের প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় আইলার ক্ষত সারতে না সারতেই সুপার সাইক্লোন আম্পানের তাণ্ডবে লণ্ড-ভণ্ড হয়ে গেছে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকা। বুধবার সারা রাত প্রচণ্ড ঝড়ে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাজার হাজার গাছপালা ভেঙ্গেচুড়ে একাকার হয়ে গেছে।
ভারী বর্ষণ ও তীব্র জোয়ারের পানির তোড়ে বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমি ও মাছের ঘের। সড়কে বড় বড় ভাঙা গাছ পড়ে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে।
আম্পানের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত জনপদে পরিণত হয়েছে গোটা সুন্দরবন উপকূল।
বুধবার সন্ধ্যায় প্রবল গতিতে সুন্দরবন উপকূলে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আম্পান। সারা রাত ধরে চলে এর তাণ্ডব। প্রলয়ঙ্কারি ঘূর্ণিঝড় সিডর ও আইলার ক্ষত সারতে না সারতেই আবারও বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সুন্দরবন উপকূলের খুলনার কয়রা, দাকোপ, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, বাগেরহাটের মোংলা ও শরণখোলা উপজেলাসহ বিস্তীর্ণ জনপদ। খুলনা মহানগরীসহ এসব এলাকার বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
তীব্র ঝড়ের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের সারা রাত কাটে কাটে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়।

কয়রা সদর ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির ও স্থানীয়রা জানান, ঘুর্ণিঝড়ের আঘাত ও জোয়ারের পানির তোড়ে সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ছোটো আংটিহারা বাকেরগাজীর বাড়ির পাশে শাকবাড়িয়া নদীর প্রায় ১২০ গজ বেড়িবাঁধ, আংটিহারা মজিদ গাজীর পাশে ৩০০ গজ বেড়িবাঁধ, জোড়সিং বাজারের পাশে ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ, কপোতাক্ষ নদের চোরামোখা খেয়াঘাটের কাছে ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ ও গোলখালী তসলিম মোল্লার বাড়ির পাশে ৫০০ গজ বেড়িবাঁধ, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাজীপাড়া গ্রামের মাথায় কপোতাক্ষ নদের ৬০০গজ বেড়িবাঁধ, কাটকাটা বাজারের শাকবাড়ীয়া নদীর ৩০০ গজ বেড়িবাঁধ, মহারাজপুর ইউনিয়নের দশালিয়া গ্রামে কপোতাক্ষ নদের ৭০০ গজ বেড়িবাঁধ এবং কয়রা সদর ইউনিয়নের হরিণখোলা ও গোবরা ঘাটাখালি গ্রামে কপোতাক্ষ নদের আধা কিলোমিটার এলাকাসহ ১০টি জায়গার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে এবং মহেশ্বরীপুর ইউনয়নের কয়রা নদীর পানি পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বাঁধ উপচে লবণ পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে।
এছাড়া ঝড়ে কয়রা উপজেলার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারে ভেসে গেছে ছোট-বড় ৫ হাজার মাছের ঘের। প্রায় ৭ কিলোমিটার রাস্তা বিধ্বস্ত হয়েছে। ঝড়ে কয়রা সদর ইউনিয়ন অফিসের টিন উড়ে গেছে। উপজেলা পরিষদের নিচে লবণ পানিতে ডুবে গেছে।
অন্যদিকে, পাইকগাছা উপজেলার লতা, দেলুটি, লস্কর, গোড়ইখালী সোলাদানা ও রাড়ুলি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি জায়গায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা ও বাড়িঘর লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অসংখ্য সাদা মাছ ও চিংড়ি ঘের। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে গাছপালা, কাঁচা, আধাপাকা ঘরবাড়ি, রাস্তা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিমুল কুমার সাহা বলেন, উপজেলার প্রায় ১৩-১৪টি জায়গায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা চেষ্টা করা হচ্ছে।
খুলনা-৬ (পাইকগাছা-কয়রা) আসনের সংসদ সদস্য আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, ঝড়ে কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়নে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া পাইকগাছা উপজেলার লতা, দেলুটি, লস্কর, গোড়ইখালী সোলাদানা ও রাড়ুলি ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি জায়গায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা ও বাড়িঘর লবণ পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে অসংখ্য সাদা মাছ ও চিংড়ি ঘের।
এছাড়া প্রচুর পরিমাণে গাছপালা, কাঁচা, আধাপাকা ঘরবাড়ি, রাস্তা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে স্থানীয়ভাবে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে ঘূর্ণিঝড়ে দাকোপ উপজেলার অনেক জায়গায় পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। বহু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। হাট-বাজারের দোকান ঘরের টিন উড়ে গেছে।
স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় সংসদের হুইপ শ্রী পঞ্চানন বিশ্বাস বলেন, ঘূর্ণিঝড়ে দাকোপ উপজেলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অসংখ্য গাছপালা উপড়ে গেছে। বহু কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। এছাড়া বটিয়াঘাটা উপজেলা সদরসহ অনেক হাট-বাজারের দোকান ঘরের টিন উড়ে গেছে।
বিস্তারিত জানার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
অন্যদিকে, ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন উপকূলের বাগেরহাট জেলার রামপাল, মোংলা ও শরণখোলা এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায়ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
যশোরে কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
এদিকে ঝড়ের প্রভাবে যশোরের কৃষিখাতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর উপ-পরিচালক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, জেলাব্যাপী প্রায় দুই হাজার হেক্টর জমির সবজি, চার হাজার হেক্টর জমির আম, ৭০০ হেক্টর লিচু ও ১০০ হেক্টর জমির পানের বরজ নষ্ট হয়ে গেছে।
এছাড়া রাস্তার দু'পাশের গাছ পড়ে যশোর-বেনাপোল, যশোর-সাতক্ষীরা ও যশোর-মাগুরার সড়ক বন্ধ রয়েছে।