কেন রেকর্ড সংখ্যক আমেরিকান নাগরিক উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে ছুটছেন?

প্রতি বছরই চাকরি ছাড়ছেন বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার লাখো নাগরিক। কেন? অবশ্যই আরও ভালো কর্মসংস্থানের আশায়। কিন্তু তাদের চাকরি ছাড়ার একটি বড় উদ্দেশ্য হলো, আর কখনোই যেন অন্যের অধীনে চাকরি করতে না হয়।
মহামারিকালে এই প্রবণতা আরও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে দেশটিতে। প্রচুর মার্কিন নাগরিক এখন নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন কিংবা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। ২০২১ সালে রেকর্ড ৫ দশমিক ৪ মিলিয়ন বিজনেস আইডি নাম্বারের জন্য আবেদন করেছেন মার্কিনিরা। কুইকবুকস অনুমান করছে, ২০২২ সালও একই রেকর্ডের পথে হাঁটছে। যদিও সত্যিকার অর্থেই ব্যবসা দাঁড় করানোর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত; কিন্তু ব্যবসায়িক আইডির আবেদন করার সাথে এটির বাস্তব প্রয়োগের সম্পর্ক অবশ্যই আছে। দেশটির ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিক্স এবং বেশকিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ডেটা থেকে জানা যায়, আমেরিকায় স্বনির্ভর লোকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নতুন ব্যবসা খাতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো, এটি সমাজের নানা শ্রেণীর মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। নারী, কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এবং যাদের কলেজের ডিগ্রি নেই; মহামারির পর থেকে তারাও অনলাইন মাইক্রোবিজনেস বা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের বিভিন্ন টুলস সরবরাহ করে এমন একটি ওয়েব ডোমেইন কোম্পানি হলো 'গো ড্যাডি'। তাদেরই গবেষণা কার্যক্রম ভেঞ্চার ফরওয়ার্ড-এর ডেটা থেকে এই তথ্য জানা যায়।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নারীদের মাধ্যমে পরিচালিত ৫৭ শতাংশ ক্ষুদ্র ব্যবসার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০২০ সালের মার্চ থেকে। আগে এই সংখ্যাটা ছিল ৪৮ শতাংশ। এগুলোর মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানরা ২৬ শতাংশ এবং কলেজের ডিগ্রিবিহীন আমেরিকানরা ৪৪ শতাংশ ব্যবসা চালু করেছেন।
মহামারি শুরুর পর ফার্নিচার কোম্পানিতে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চাকরি ছেড়ে দেন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান নারী কিম্বারলি ব্ল্যাকমন। এর বদলে নিজেই রূপচর্চা-প্রসাধনী সামগ্রীর ব্যবসা খুলে বসেছেন তিনি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ট্যাম্পাতে তার প্রতিষ্ঠান গ্লোমার বিউটি মেডিস্পা'র নতুন শাখা খোলেন।
ব্ল্যাকমন বলেন, "মাঝে মাঝে এমন হয় যে কেউই আমাদের আইডিয়াগুলো শুনতে চায় না। সেজন্যেই মানুষ তখন সিদ্ধান্ত নেয়, ঠিক আছে, আমার কাজটা আমি একাই করবো! নিজের জন্য কাজ করা খুবই তৃপ্তির। এখানে আমার সিইও হওয়ার সুযোগ আছে এবং আমি আমার কর্মীদের পরামর্শ দেই, শেখাই এবং পরিচালনা করি। কর্পোরেট জগতে গিয়ে আমি নিজে যেমনটা অনুভব করেছি, আমি চাইনা আমার কর্মীরাও সেটা অনুভব করুক।"
তবে আমেরিকানদের নিজেদের মতোই তাদের উদ্যোক্তা বনে যাওয়ার পেছনের কারণও অসংখ্য। অর্থনৈতিক কারণ থেকে শুরু করে দার্শনিক, সব রকম যুক্তি-ব্যাখ্যাই আপনি এখানে পাবেন। কেউ কেউ আগে যে ধরনের কাজে যুক্ত ছিলেন, সে সম্পর্কিত ব্যবসা দাঁড় করান; আবার কেউবা একেবারেই ভিন্ন পথে ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়ে যান।
প্রায় সবগুলো শিল্পখাতেই বিজনেস আইডি চেয়ে আবেদন জমা পড়লেও, খুচরা ব্যবসার দিকেই মার্কিন নাগরিকদের ঝোঁক বেশি; বিশেষত, যে দোকানগুলো শুধুমাত্র অনলাইনে পণ্য বিক্রি করে। তাছাড়া প্রচুর মানুষ পরিবহণ খাত ও ওয়্যারহাউজের ব্যবসার প্রতিও আগ্রহ দেখিয়েছেন। একাউন্টিং বা গ্রাফিক ডিজাইনের মতো পেশাদার সেবা প্রদানকে ব্যবসা হিসেবে নিয়েছেন অনেকে।
গতানুগতিক প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর অ্যারি রাসেখ বুঝতে পেরেছেন যে তিনি আসলে উদ্যোক্তাই হতে চান। অতঃপর manor.care প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি, যার কাজ হলো গৃহ ব্যবস্থাপনা। রাসেখ বলেন, "আমি নিজেকে অসংখ্যবার প্রশ্ন করেছি, বড় হয়ে আমি কি হতে চাই? অবশেষে এতদিন পর বুঝলাম যে আমি আসলে উদ্যোক্তাই হতে চেয়েছি সবসময়!"
মহামারির থাবায় দীর্ঘদিন ঘরে বসে থাকতে হয়েছে প্রচুর মার্কিন নাগরিককে। এই সময়টায় তারা ভেবেছেন কিভাবে এই অফুরন্ত অবসর কাজে লাগানো যায়। অনেকেই উপলব্ধি করেছেন, তারা আসলে তাদের বসকে ঘৃণা করেন এবং নিজেরাই নিজেদের বস হয়ে উঠতে চান। কেউ কেউ চেয়েছেন নিজের পরিবার-সন্তানকে বেশি সময় দিতে; আবার অনেকের ভাষ্যে, তারা নিজেরাই নিজেদের ভাগ্যের রাশ টেনে ধরতে চেয়েছেন। আর এভাবেই উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা মাথায় এসেছে।
সাধারণত অর্থনৈতিক মন্দায় পড়লে কিংবা বেকারত্বের হার বেশি থাকলে মানুষ নিজেই ব্যবসায়ে লেগে পড়ার চেষ্টা করে, যা মহামারির শুরুর দিকে ছিল। কিন্তু বর্তমানে অর্থনীতি আবারও চাঙা হয়ে ওঠার পরেও কেন আমজনতার এই সিদ্ধান্ত? মার্কিন নাগরিকদের এই রেকর্ড হারে চাকরি ছাড়াকে 'গ্রেট রেজিগনেশন' বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সফটওয়্যার কোম্পানি জেনেফিটস-এর এইচআর ড্যানি স্পেরোস বলেন, "একটা চাকরি, কর্মক্ষেত্র এবং জীবন থেকে মানুষের কি প্রত্যাশা; তারা সেটিই সার্বিকভাবে মূল্যায়ন করে দেখছে। আমরা বরং এটিকে 'গ্রেট রিফ্লেকশন' বলতে পারি।"
স্বাস্থ্যসেবা খাতে ক্রমবর্ধমান সুযোগ-সুবিধা, ব্যবসায় প্রযুক্তির প্রসার এবং মহামারির ফলে সৃষ্ট নতুন নতুন সুযোগ মানুষকে তাদের স্বপ্ন পূরণের দিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে।
তাছাড়া উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার মাধ্যমে শুধু যে মালিকের নিজেরই উপকার হচ্ছে তা না, বরং অন্যের অধীনে কর্মরত হাজারো আমেরিকানের জন্যও সুবিধা এনে দিচ্ছেন তারা। কারণ দেশটিতে চাকরি বাজারে জনবল প্রয়োজ়ন হলেও প্রতিষ্ঠানগুলো তা পাচ্ছে না, ফলে তারা কর্মীদের বেতন-ভাতা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
তবে উদ্যোক্তা হতে চাই বললেই হয়ে গেলাম এমনটা মোটেও নয়। ব্যবসা মানেই ঝুঁকি; স্বাস্থ্যসেবা ব্যয়, পে-চেকের পাশাপাশি কঠোর ট্যাক্স কোড এবং সবশেষে ব্যবসায়িক উদ্যোগ সম্পূর্ণ বিফলে যাওয়ার ঝুঁকি তো আছেই। আমেরিকায় উদ্যোক্তা গোষ্ঠীর বিকাশে কিছু সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে বটে; কিন্তু এখনো তাদের লাভের পরিমাণ দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের সমান নয়।
কেন উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী?
মহামারির ফলে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের কথা না বললেই নয়। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারিতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু মানুষের মনোজগতে এক বিশাল ধাক্কা দিয়েছে, জীবনের অর্থ সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। অনেকেই মহামারিকালে চাকরি হারিয়েছেন কিংবা ঘরে বসে কাজ করেছেন। ফলে নিজেদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার প্রচুর সময় হাতে পেয়েছেন তারা।
অনেকের ক্ষেত্রেই উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার পেছনে ছিল কোনোকিছুর নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার বাসনা। কারণ নিজ ব্যবসায়ে আপনি সফল বা ব্যর্থ যাই হন না কেন, এর দায় শুধুই আপনার। তাই এক জীবনে নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করে ফেললেই বা ক্ষতি কি!
ব্ল্যাকমন যেমনটা বলেন, "চাকরি ছাড়ার আগে আমার মনে হতো, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে তো হুট করে একদিন মরেও যেতে পারি! তখন আর আমার স্বপ্ন পূরণ করা হতো না।"
মহামারিকালে হোম অফিস করার ফাঁকে শখের বসে বেকারি আইটেম বানাতেন এমিলি কেলার। কিন্তু একসময় ইনস্টাগ্রামে মানুষের কাছ থেকে অনুরোধ আসতে লাগলো, তারা এমিলির বানানো ম্যাকারন কিনতে চান। ব্যস! ফুল-টাইম চাকরিকে পার্ট-টাইমে নিয়ে শুরু করলেন 'টেস্টি ট্রিটস লুইসভিল' নামের নিজস্ব বেকারি। চলতি বছরেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর রাঁধুনি বনে যাওয়ার ইচ্ছা আছে তার।
ইউএস চেম্বার অব কমার্সের স্মল বিজনেস পলিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট থমাস সুলিভান বলেন, "ব্যবসা হচ্ছে আপনার সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার।"
তাছাড়া বেকারত্ব ভাতা, মহামারিকালে সীমিত খরচ এবং সঞ্চয় বেশি হওয়ায় অনেকেই তাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগটি চালু করার পুঁজি হাতে পেয়েছেন। এদিকে গতানুগতিক কর্মসংস্থান ক্ষেত্রগুলোতে কর্মীদের চাকুরির নিরাপত্তা, পেনশন, ঐক্য সমিতির সংখ্যা- সবকিছুই আগের চেয়ে হ্রাস পেয়েছে।
তাছাড়া, আমেরিকায় অ্যাফোরডেবল কেয়ার আইনের অধীনে হেলথ কেয়ার এক্সচেঞ্জ চালু করায় এখন কর্মীরা তাদের নিয়োগকর্তার কাছে না গিয়েই স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন।
স্বকর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় একটি সুবিধা হলো, এখানে মানুষ স্বাধীনভাবে কোনো একটা উপায় বেছে নিতে পারে। অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক চান, সাময়িকের জন্য হলেও দূরে কোথাও কাজ করতে, কিন্তু বসের কাছে এই আবদার করা মানেই কোণঠাসা হয়ে পড়া।
সাবস্ক্রিপশন পডকাস্ট নিয়ে কাজ করছেন ক্রিস নেলডার। তার ভাষ্যে, "নিজের জন্য কাজ করতে পারা খুবই আনন্দের। দিনশেষে কাউকে রিপোর্ট করতে হয় না এবং সবদিকেই আমার ইচ্ছামত সবকিছু পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।"
কাজের ঝুঁকি এবং যেসব পরিবর্তন দরকার
স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, নিজস্ব উদ্যোগ বা ব্যবসা আরম্ভ করা একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রথম কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
সার্প-এর বেকার বলেন, "আমার মনে হয় অধিকাংশ লোকই নিজের উদ্যোগ নিয়ে অতিমাত্রায় আশাবাদী থাকে। তারা সারা জীবনের সঞ্চয় এই ব্যবসায়ের পেছনে ঢেলে দেয় যা দিনশেষে কোনো লাভ বয়ে আনে না। আমার মতে, সুযোগ বুঝে পদক্ষেপ নাও, কিছু তো ভালো ফল আসবেই।"
শুধু তাই নয়, সফল ব্যবসার ক্ষেত্রেও দেখা যায় লাভ তুলে আনতে অনেকদিন সময় লেগে যায়। সরকারি আইন, করপ্রদান নীতিও অনেক সময় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষে যায় না। সে কারণেই অনেক আমেরিকান নাগরিক ব্যবসার পাশাপাশি পার্ট-টাইম চাকরি বা ফ্রিল্যান্সিং এর কাজে লেগে থাকেন।
দক্ষতা অর্জন না করে ব্যবসায় নেমে পড়াও একটি মারাত্মক ভুল। ভেঞ্চার ফরওয়ার্ড তাদের গবেষণায় দেখে, পুঁজি, লাভ এবং সুলভ ব্রডব্যান্ড ছাড়াও ক্ষুদ্র ব্যবসার জন্য যা দরকার তা হলো, ব্যবসায়িক পরিকল্পনা নিয়ে প্রাথমিক দক্ষতা থাকা।
তবে স্বকর্মসংস্থান বা উদ্যোক্তা হয়ে ওঠায় ব্যর্থতার হার অনেক বেশি হলেও, এরই মধ্য থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে অনেকেই সফলতা পাচ্ছে। তাই দিনশেষে প্রশ্ন হচ্ছে, সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কে পারবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে?
সূত্র: ভিওএক্স নিউজ