ইলেকট্রিক গাড়ির বিপুল ভুবনে স্বাগতম...

একবিংশ শতকে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলবায়ু পরিবর্তন। কার্বণ নিঃসরণ কমানো পাচ্ছে নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে অগ্রাধিকার। তাই তো জোর চেষ্টা চলছে বৈদ্যুতিক যানবাহন দিয়ে ভবিষ্যতের পরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর। দেশে দেশে রব উঠেছে দূষণ-শোষণ বন্ধ কর- 'ফিরিয়ে দাও অরণ্য, লও হে নগর।'
কিন্তু, শতভাগ বিদ্যুৎ চালিত যানের সে ভবিষ্যতের দুয়ার সহজে খুলবার নয়। যেমন আছে কম দামে ব্যাটারি ও গাড়ি প্রস্তুতের চ্যালেঞ্জ, তেমনি সহযোগী অবকাঠামো স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা। প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে পরিবহন অবকাঠামো গড়েই উঠেছে জ্বালানি পাম্প কেন্দ্র করে। পৃথিবীর সকল দেশের জনপথেই নির্দিষ্ট দূরত্বে পাবেন পেট্রল পাম্প।
সে তুলনায় সিংহভাগ চার্জিং স্টেশনের অস্তিত্ব ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের উন্নত অঞ্চলে। উদীয়মান অর্থনীতি চীন ও ভারতেও আছে, তবে বড় সমস্যা বাড়িতে চার্জিংয়ের ব্যবস্থা নিয়ে।
বৈদ্যুতিক যান বা ইভির মালিকরা বাড়িতে চার্জ করাতে চান, তাতে বাঁচে বাইরে চার্জ করানোর ঝঞ্ঝাট। তাছাড়া, পাবলিক চার্জিং স্টেশনে খালি পোর্ট পেতেও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। তাই বাড়িতে চার্জিং ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন ক্যানাডার এক অধ্যাপক দম্পতি রব ও কিম নেলসন।
ইউনিভার্সিটি অব উইন্ডসরের অধ্যাপকদ্বয় মহানন্দে তাদের প্রথম ইলেকট্রিক কার কেনেন, যা ছিল একটি শেভ্রলো বোল্ট। প্রথমে তারা ব্যবহার করতেন লেভেল ওয়ান চার্জার। কিন্তু, গেল সেপ্টেম্বরে তারা এটি লেভেল টু'তে আপগ্রেডের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ দামে সামান্য বেশি লেভেল টু চার্জার দ্রুত চার্জ করে (প্রতিঘণ্টা চার্জে দেয় গড়ে ৩০ কিলোমিটার রেঞ্জ)।
তবে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়েই সমস্যার সূত্রপাত। লেভেল টু চার্জার বৈদ্যুতিক স্টোভ বা ড্রায়ারের মতো লোড টানে। যা সাধারণত ২৪০ ভোল্ট বা ৩০ অ্যাম্পিয়ার। অথচ কানাডার বেশিরভাগ পুরোনো বাড়ির মতোই নেলসনের বাড়িতে ছিল মাত্র ১০০ অ্যাম্পিয়ার সমর্থক বৈদ্যুতিক লাইন।
বাড়িতে ছিল একটি সুইমিং পুলের পাম্প ও শীতাতপ ব্যবস্থা। গ্রীষ্মের সে সময়ে এগুলোয় বন্ধ রাখার প্রশ্নই ওঠে না। তাই শেষমেষ পুরো বাড়ির ওয়্যারিং বদলানোর সিদ্ধান্ত নিলেন নেলসনরা।
তারা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা ২০০ অ্যাম্পিয়ারে আপগ্রেড করার সিদ্ধান্ত নেন। এতে তাদের বাড়তি খরচ করতে হবে আরো কয়েক হাজার কানাডিয় ডলার। খোঁড়াখুঁড়ি চলবে উঠোনে সাধের বাগানটিতে। কারণ সেপথেই আসবে নতুন ইলেকট্রিক লাইন।
যাই হোক, সব কাজ শুরু হলো। সাধের গাড়ির কথা ভেবে জলাঞ্জলি গেলো উঠোনের গাছগুলো। কিন্তু, তারপরই দুঃসংবাদ দিলেন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদার। তিনি জানালেন, আশেপাশের আরও তিন/ চারটি বাড়ি এভাবে সংযোগ আপগ্রেড করালেই পুড়ে যাবে ট্রান্সফর্মার। দীর্ঘদিন ধরে সেটিও পরিবর্তন করা হয়নি।
রব নেলসেন সেকথা স্মরণ করে বলেন, "খুব বুঝতে পারছিলাম সমস্যার ব্যাপকতা। সব বাড়িতে ২০০ অ্যাম্পিয়ার লাইন চাইলে পুরো গ্রিড ব্যবস্থার খোলনলচে বদলাতে হবে।"
এটি শুধু কানাডার একটি মহল্লা বা শহরের চিত্র নয়। বরং পুরো দেশটির প্রতিনিধিত্ব করছে। কানাডার মতো উন্নত দেশের এ অবস্থা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতো। এতে স্পষ্ট হয় আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ইভি-কেন্দ্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণ কত বড় চ্যালেঞ্জ।
এরমধ্যেই কানাডায় বাড়ছে বাড়িতে গাড়ি চার্জকারীর সংখ্যা। এ চাহিদায় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। বিকল্প হিসেবে পাবলিক চার্জ স্টেশনের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে; তবে খুব শিগগিরই সেগুলোয় গাড়ি রাখার জায়গা ফুরিয়ে আসছে। এসব স্টেশনও গ্রিডে আরও চাপ সৃষ্টি করবে।
এব্যাপারে কনকোর্ডিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ক্লঁদে এল-বায়েহ আশঙ্কা প্রকাশ করেন, "ভবিষ্যতে যখন লাখ লাখ ইভি একসাথে চার্জ হবে, তখন বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা দেখা দিতে পারে।"
শঙ্কার কারণ ইভির বিক্রি বৃদ্ধি। ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত কানাডায় যার পরিমাণ বছরে ৪৬০টি থেকে ৫৩ হাজারে উন্নীত হয়েছে। দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা- স্ট্যাটসক্যান জানায়, ২০২১ সালের দ্বিতীয় প্রান্তিকে মোট নিবন্ধিত গাড়ির ৪ দশমিক ৯ শতাংশই ছিল শূন্য নির্গমন প্রযুক্তির গাড়ি (ইভি ও হাইব্রিড)। ২০২০ সালের একইসময়ের চেয়ে ৮৯ দশমিক ২০ শতাংশ বেশি।
জ্বালানি গ্যাসের দাম বাড়ায় ইভি বিক্রি আরও বাড়ার আভাস দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া, সরকারও দিচ্ছে উৎসাহ। ২০৩৫ সালের মধ্যে বিক্রি হওয়া সকল গাড়িকে বিদ্যুৎচালিত হতে হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে জাস্টিন ট্রুডোর সরকার। প্রযুক্তির উন্নয়ন, বাড়তি চাহিদা ও বিভিন্ন সরকারি প্রণোদনায় উৎসাহিত উৎপাদকরাও ২০৩০ বা ২০৩৫ সাল নাগাদ শুধু ইভি তৈরির লক্ষ্য নিচ্ছে।
বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০৪০ সাল নাগাদ ইভি বিক্রি মোট যানবাহন বিক্রির দুই-তৃতীয়াংশ হবে। তার বিপরীতে, প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো গাড়ি বিক্রি ৯৯ শতাংশের বেশি কমে মাত্র এক-তৃতীয়াংশে নামবে। ভবিষ্যৎ বাজার সম্ভাবনা মাথায় রেখে বৈদ্যুতিক যান উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় নামে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন, এবং এ দৌড়েও আপাতত বহুদূর এগিয়ে রয়েছে চীন।
এ চিত্র বৈশ্বিক, এশিয়ায় ভারত ও চীন চায় বৈদ্যুতিক যানের আধিপত্য।
বাংলাদেশ সরকারও শিল্পটির বিকাশ চায়। কিন্তু, সে তুলনায় গ্রিড ব্যবস্থার উন্নতি চোখে পড়ছে না।
রাজধানী ঢাকায় চার চাকার বৈদ্যুতিক শক্তিচালিত যানের প্রসার বাড়াতে চার্জিং স্টেশনের মতো দরকারি অবকাঠামো স্থাপনে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থা- ইউএনডিপি। কিন্তু, বিদ্যুৎচালিত গণ-পরিবহন প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা হিসেবে অধিক শুল্ক ও চার্জিং স্টেশনের অভাবকে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি।
গত জুনে মন্ত্রিপরিষদের সবুজ সংকেত পাওয়া অটোমোবাইল শিল্প উন্নয়ন নীতি-২০২১-এর আওতায় এ খাতের বিকাশে কর অবকাশ ও বার্ষিক প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সুবিধাগুলো পাবে, স্থানীয়ভাবে ইলেকট্রিক যান সংযোজক, জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণে জড়িত প্রতিষ্ঠান।
প্রস্তাবিত নীতির আওতায় ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে পরিবেশ বান্ধব নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৫ শতাংশ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়।
দেশে চাহিদার তুলনায় এখন বেশি বিদ্যুৎ উপাদন হওয়ার কথা উল্লেখ করে, গত ১২ সেপ্টেম্বর নতুন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনকালে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ বিদ্যুৎচালিত যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশাপ্রকাশ করেন, যার আওতায় থাকবে বিদ্যুৎচালিত রেলগাড়ি, বাস ও কার।
কিন্তু, এসব পরিকল্পনার বিপরীতে বাসাবাড়ির বৈদ্যুতিক সংযোগ, পাবলিক চার্জিং স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ বা মূল গ্রিডের উন্নয়ন ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির উদ্যোগ একেবারেই চোখে পড়ে না।
তাই প্রশ্ন জাগে, বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতোই আমাদের ইভি ভিশনও কি শুধু আকাশ-কুসুম কল্পনাতেই থেকে যাবে?