নিউ ইয়র্কের সড়কে বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি চলত সেই ১৮৯০-এর দশকেই!

১৯ শতকের শেষভাগে নিউইয়র্ক সিটি এক গুরুতর সমস্যার মুখোমুখি হয়। তখন শহরের রাস্তায় প্রায় দেড় লাখ ঘোড়া চলাচল করত, এবং প্রতিটি ঘোড়া প্রতিদিন গড়ে ৩৫ পাউন্ডের বেশি বর্জ্য উৎপন্ন করত। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য পরিষ্কার করা ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ, যা শহরবাসীকে চরম ভোগান্তিতে ফেলে। ঠিক সেই সময়েই সম্ভাব্য সমাধান হিসেবে আবির্ভাব ঘটে অটোমোবাইলের।
১৮৯৬ সালে নিউইয়র্কে প্রথম মোটরচালিত ট্যাক্সি পরিষেবা চালু হয়। এই ট্যাক্সিগুলো এমন এক পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রযুক্তি ব্যবহার করত, যা আধুনিক যুগেও বিস্ময় জাগায়—এগুলো ছিল সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক। 'ইলেকট্রিক ভেহিকল কোম্পানি' নির্মিত এই গাড়িগুলো 'ইলেকট্রোব্যাট' নামে পরিচিতি পায়।
ফিলাডেলফিয়ার দুই উদ্ভাবক, হেনরি মরিস ও পেদ্রো সালোম, ১৮৯৪ সালে ইলেকট্রোব্যাটের পেটেন্ট নেন এবং পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এটিকে আরও ছোট ও গতিশীল করেন। নতুন মডেলটির ওজন ছিল ২,৯০০ পাউন্ড, যা লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির মাধ্যমে চলার শক্তি পেত। একবার চার্জে এটি ২৫ মাইল পর্যন্ত চলতে পারত এবং সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২০ মাইল।
১৮৯০-এর দশকে নিউইয়র্কের রাস্তায় বৈদ্যুতিক গাড়ির চলাচল আজ অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু সে সময় এগুলো অন্তর্দহন ইঞ্জিনচালিত গাড়ির চেয়েও বেশি জনপ্রিয় ছিল। কারণ এ গাড়িগুলো ছিল নীরব, দূষণমুক্ত এবং চালানো সহজ।
সেটা ছিল বিদ্যুতের যুগের সূচনা, যখন মানুষ বিশ্বাস করত, বিদ্যুৎই ভবিষ্যতের শক্তি। বৈদ্যুতিক যানবাহনের ইতিহাসবিদ ও 'দ্য ইলেকট্রিক ভেহিকল অ্যান্ড দ্য বার্ডেন অব হিস্ট্রি' গ্রন্থের লেখক ডেভিড এ. কির্শ বলেন, "সেই সময় যদি কাউকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো, তারা বলত, 'বিদ্যুৎ এক জাদুকরি শক্তি'—আমরা এটি দিয়ে আলো জ্বালাচ্ছি, ট্রলি চালাচ্ছি, আর এখন এটি আমাদের পরিবহনব্যবস্থাতেও যুক্ত হচ্ছে।"
মরিস ও সালোম নিউইয়র্কে ইলেকট্রোব্যাট চালু করার পর তাদের ট্যাক্সিগুলোর জন্য এক অভিনব ব্যাটারি-বদল ব্যবস্থা তৈরি করেন। ব্রডওয়ের একটি পরিত্যক্ত আইস-স্কেটিং রিংকে ব্যাটারি স্টেশন হিসেবে ব্যবহার করে তারা এমন একটি ব্যবস্থা চালু করেন, যেখানে মাত্র তিন মিনিটের মধ্যে ১,২৫০ পাউন্ড ওজনের ব্যাটারি বদলানো যেত। কর্মীরা লিফট ও হাইড্রোলিক যন্ত্রের সাহায্যে গাড়িগুলো সরিয়ে আনতেন, আর ওপরে থাকা একটি ক্রেন পুরোনো ব্যাটারি সরিয়ে নতুন ব্যাটারি বসিয়ে দিত।
ডেভিড এ. কির্শ বলেন, "এটি ঘোড়া বদলের চেয়েও দ্রুত ছিল এবং আধুনিক যুগের গ্যাস ট্যাঙ্ক ভরার সময়ের সঙ্গেও তুলনীয়।"
তবে ইলেকট্রোব্যাটের উচ্চগতি ও নীরব চলাচল কিছু অপ্রত্যাশিত সমস্যার সৃষ্টি করে। ১৮৯৯ সালের মে মাসে ট্যাক্সিচালক জ্যাকব জার্মান নিউইয়র্ক শহরের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে অতিরিক্ত গতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। তিনি লেক্সিংটন অ্যাভিনিউ দিয়ে ঘণ্টায় ১২ মাইল গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। কয়েক মাস পর একটি বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি আপার ওয়েস্ট সাইডে ট্রাম থেকে নামা এক পথচারীকে ধাক্কা দিলে তিনি মারা যান। বৈদ্যুতিক ট্যাক্সির আওয়াজ এতটাই কম ছিল যে পথচারী সেটির আসার সংকেত শুনতেই পাননি।
মরিস ও সালোম তাদের গাড়িগুলো বিক্রি না করে মাসিক বা প্রতি রাইড ভিত্তিতে ভাড়ায় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নিউইয়র্কজুড়ে তাদের ট্যাক্সি পরিষেবা 'ইলেকট্রিক ক্যারিয়েজ অ্যান্ড ওয়াগন কোম্পানি' দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৮৯৭ সালে মাত্র এক ডজন গাড়ি দিয়ে শুরু হওয়া এই বহর ১৮৯৯ সালের মধ্যে একশটিরও বেশি গাড়িতে পরিণত হয়।
ব্যবসার দ্রুত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তারা আরও বড় পরিকল্পনা হাতে নেন এবং নিউইয়র্কের প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী উইলিয়াম হুইটনির মতো ধনকুবেরদের কাছ থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহ করেন। হুইটনি নিউইয়র্কের ট্রামব্যবস্থাকে বিদ্যুতায়িত করার জন্য পরিচিত ছিলেন। তার মালিকানায় দলটি একটি প্রধান ব্যাটারি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অধিগ্রহণ করে, যার লক্ষ্য ছিল বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে আধিপত্য স্থাপন।
'ইলেকট্রিক ভেহিকল কোম্পানি' দ্রুত ফিলাডেলফিয়া, শিকাগো ও বোস্টনের মতো বড় শহরে ট্যাক্সি ব্যবসা সম্প্রসারিত করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই এটি আমেরিকার বৃহত্তম অটোমোবাইল নির্মাতা হয়ে ওঠে। তবে এত দ্রুত সম্প্রসারণ টেকসই হয়নি।
নিউইয়র্কের বাইরের কার্যক্রম বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছিল। ১৮৯৯ সালে নিউইয়র্ক হেরাল্ড-এর এক প্রতিবেদনে কোম্পানির ঋণ জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ পেলে বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত বোধ করেন। এর ফলে শেয়ারমূল্য পড়ে যায় এবং ১৯০২ সালের মধ্যে কোম্পানিটি চরম আর্থিক সংকটে পড়ে।
এই পতন বিনিয়োগ মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং বৈদ্যুতিক যানবাহনের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। এরপর গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কোম্পানির গাড়ি বহরের একটি বড় অংশ ধ্বংস হয়ে যায়। শেষে ১৯০৭ সালের অর্থনৈতিক মন্দা নিউইয়র্কের বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি শিল্পকে চূড়ান্ত ধাক্কা দেয়।
একই সময়ে গ্যাসচালিত যানবাহন জনপ্রিয় হতে শুরু করে। নিউইয়র্কের ব্যবসায়ী হ্যারি অ্যালেন ১৯০৭ সালে ফ্রান্স থেকে ৬৫টি গ্যাসচালিত ট্যাক্সি আমদানি করে নতুন সার্ভিস চালু করেন। এক বছরের মধ্যেই তার বহরে ৭০০ গাড়ি যুক্ত হয়। এরপর নিউইয়র্ক আর পেছনে ফিরে তাকায়নি।
১৯০৮ সালে সাশ্রয়ী 'মডেল-টি' বাজারে আসার পর বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগ ধীরে ধীরে শেষ হতে শুরু করে। যদিও বৈদ্যুতিক গাড়ি ১৯২০-এর দশক পর্যন্ত টিকে ছিল, অন্তর্দহন ইঞ্জিন ধীরে ধীরে পুরো মার্কিন পরিবহনব্যবস্থায় আধিপত্য বিস্তার করে।
তবে বৈদ্যুতিক গাড়ির পুনর্জন্ম ঘটতে বেশি সময় লাগেনি। ২০২২ সালে নিউইয়র্কের রাস্তায় ২৫টি সম্পূর্ণ বৈদ্যুতিক ট্যাক্সি চালু হয়।