‘আমিন সাইকেল স্টোর’ একই রূপে একই স্থানে সাইকেল ব্যবসায় ৮০ বছর

১৯৪৩ থেকে ২০২৩ সাল – সময় ৮০ বছর। মাঝে ১৯৪৬ সালের ঐতিহাসিক নোয়াখালী দাঙ্গা, ৪৭ সালের দেশভাগ, ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ ঘটে গেছে অসংখ্য ঘটনা। বয়ে গেছে কত দূর্যোগ। সব কিছুর সাক্ষী ''আমিন সাইকেল স্টোর''। একই স্থানে, একই চেহারায় টিনশেড ঘরে টানা ৮০ বছর পার করছে এ প্রতিষ্ঠান।
তবে চেহারার পরির্বতন না হলেও, দীর্ঘ সময় ধরে বৃহত্তর নোয়াখালী (ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী) এবং চাঁদপুরের দক্ষিণাঞ্চলের অধিবাসীদের কাছে সাইকেল ও রিক্সার মতো মতো ক্ষুদ্র যানবাহন বিক্রির একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে আমিন সাইকেল স্টোর। এর প্রতিষ্ঠাতা বশির উল্লাহ মিকার একজন শ্রমজীবী মানুষ থেকে হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বর্তমানে লক্ষ্মীপুর জেলার সর্ববৃহৎ সাইকেল বিক্রির কেন্দ্র এটি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা শহরের বড় মসজিদ সংলগ্ন চাঁদপুর-রায়পুর সড়ক পাশে টিনের ছাউনির নিচে চলছে ঐতিহাসিক এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম।
স্থানীয়রা জানায়, দেশীয় যেকোন সাইকেল ও রিক্সার পাশাপাশি বর্তমানে আধুনিক সব ধরনের সাইকেল, রিক্সা ও যন্ত্রাংশের জন্য সুখ্যাতি রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।
প্রতিষ্ঠাতা বশির উল্লাহ মিকার মারা যাওয়ার পর, হাল ধরেছেন তার ছেলে নুরুল আমিন। নুরুল আমিনের সাথে এখন ব্যবসায় যুক্ত রয়েছেন তার ছেলে সারোয়ার আমিন।

৮০ বছরের পুরাতন সেই দোকান ঘরের গদিতে বসেই ব্যবসার ইতিহাস বলছিলেন সারোয়ার আমিন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ শেষ করে চাকুরিতে যোগদান করেননি। যোগ দিয়েছেন দাদার প্রতিষ্ঠিত আমিন সাইকেল স্টোরে।
সারোয়ার জানান, ৮০ বছর পরেও আমিন সাইকেল এর ব্যবসায়িক অবস্থান, দোকান ঘরের চোহারায় পরিবর্তন আসেনি। তবে উত্তরাধিকারী সূত্রে পালাক্রমে ৩ প্রজন্মের মানুষ গদিতে বসেছেন। বর্তমানে পুরাতন দোকানের পাশাপাশি একই শহরে ৪তলা ভবন জুড়ে গড়ে তুলেছেন আধুনিক সাইকেল বিক্রয় কেন্দ্র। মাসে হাজার সাইকেল বিক্রয় হয় সেখানে।
''আমার দাদা সাইকেল মেকানিক থেকে হয়েছেন একজন প্রতিষ্ঠিত সাইকেল বিক্রেতা। আমি সাইকেল বিক্রেতা থেকে একজন সাইকেল উৎপাদনকারী হতে চাই। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও চাকুরি করব না সিদ্ধান্ত নিয়েছি'' বলছিলেন সারোয়ার।
নুরুল আমিন জানান, তার বাবা বশির উল্লাহ জীবিকা নির্বাহের জন্য রিক্সা ও সাইকেল মেরামতের কাজ করতেন। স্থানীয়রা তাকে বশির উল্লাহ 'মিকার' নামেই জানতো। ১৯৪৩ সালে তিনি বর্তমান জায়গায়টি ভাড়া নিয়ে সেই মেকানিকের দোকানের সাথেই সাইকেল ও রিক্সার যন্ত্রাংশের ব্যবসা শুরু করেন। দোকানের নাম রাখেন, আমিন সাইকেল স্টোর।
অল্প সময়ের মধ্যে দোকানটি ক্রেতাদের মন কাড়ে। দোকানে নানান ধরনের নতুন সাইকেল, সাইকেল ও রিক্সার যন্ত্রাংশের বিক্রি বাড়তে থাকে। আমিন সাইকেল স্টোরে দেশ-বিদেশের নিত্যনতুন সাইকেল বিক্রির খবর পুরো নোয়াখালী অঞ্চলে পৌঁছে যায়। আসতে থাকেন ক্রেতারা। এরপর মেকানিকের কাজ ছেড়ে দেন বশির উল্লাহ। পুরোপুরি ব্যবসায় মনোযোগী হন তিনি।
নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর ছাড়াও আশপাশের চাঁদপুর এবং ভোলা জেলার মানুষও রায়পুর এসে পাইকারি ও খুচরায় সাইকেল নিয়ে যেত এক সময়। এখনও নোয়াখালী পর্যন্ত তাদের পাইকারি ও খুচরা ক্রেতা রয়েছে।

সারোয়ার আমিন জানান, বর্তমানে গ্রাম অঞ্চলে প্যাডেল-চালিত রিক্সার ব্যবহার প্রায় ২-৩ ভাগ। কিন্ত, আমিন সাইকেল স্টোরে এখনো দেশীয় রিক্সা ও সাইকেল এর যেকোন যন্ত্রাংশ পাওয়া যায়। অনেকে দোকানে এসে যন্ত্রাংশ কিনেও নিজস্ব বা কাস্টমাইজ সাইকেল ও রিক্সা তৈরি করে নেয়।
তারা আরও জানান, বর্তমানে দেশীয় প্রচলিত সাইকেল বিক্রি কমলেও বেড়েছে আধুনিক সাইকেল বিক্রি। সেকারণে তারা আধুনিক সাইকেল বিক্রির জন্য একই শহরের ভিন্ন একটি ভবনের ৪ তলা জুড়ে গড়ে তুলেছেন সাইকেল বিক্রয় কেন্দ্র।
'আমিন সাইকেল' নাম কিভাবে এলো এবিষয়ে জানতে চাইলে সারোয়ার আমিন বলেন, প্রতিষ্ঠাতা বশির উল্লাহর বাবার নাম ছিল আবদুস সমিদ আমিন, অন্যদিকে তার ২ ছেলে রুহুল আমিন ও নুরুল আমিন। অনুমান করা হয়, দাদা বশির উল্লাহর বাবার নামের 'আমিন' কিংবা ছেলেদের নামের 'আমিন' অংশ থেকে হয়তো প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা হয় ''আমিন সাইকেল স্টোর''।
এখন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম থেকে তারা সবাই আমিন বংশের লোক হয়ে গেছে। সারোয়ার আমিন বলেন, আমিন অর্থ বিশ্বাসী। তাই নামের সাথে আমরা মানুষের বিশ্বাস ধরে রাখতে পেরেছি বিধায় ছোট এ প্রতিষ্ঠানটি ৮০ বছর ধরে টিকে রয়েছে।
নুরুল আমিন জানান, তার বাবার সময় ইংল্যান্ডের রেলি, ফিলিপস, ভিএস ব্র্যান্ডের সাইকেল তারা বিক্রি করতেন। পরে দীর্ঘ সময় ধরে ফনিক্স, হিরো, এভোন, ফরইভার ইত্যাদি ট্রেডিশনাল ব্র্যান্ডের সাইকেল বিক্রি করেছেন। আমিন সাইকেলের হাত ধরেই লক্ষ্মীপুর জেলায় প্রথম বার ফনিক্স সাইকেল প্রবেশ করে।

বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী ব্র্যান্ডের সাইকেল ব্যবহার প্রায় ৫০ ভাগ কমে গেছে। এখন ট্রেডিশনাল ব্র্যান্ডের সাইকেলের ক্রেতা হচ্ছেন- শ্রমিক শ্রেণির মানুষ, স্কুল, মাদরাসার ছাত্র, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন।
বর্তমান সময়ে চলছে আধুনিক সাইকেল। আধুনিক সাইকেলের ক্রেতারা বেশির ভাগই ছাত্র বা সৌখিন সাইকেল চালক।
পারিবারিক ব্যবসা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নুরুল আমিন জানান, শুরু থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত দোকান ঘরটি ভাড়া ছিল। পরে ১৯৫২ সালের দিকে স্থানীয় জমিদার দুলাল চৌধুরীর মা মায়া প্রসন্ন রাণীর থেকে জায়গাটি কিনে নেন আমার বাবা। এরপর থেকে ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে। সাইকেলের পাশাপাশি রিক্সার যন্ত্রাংশ বিক্রি শুরু করা হয়।
বশির উল্লাহ মিকারের ২ ছেলের মধ্যে রুহুল আমিন রুপালি ব্যাংকে চাকুরি পেয়ে সেখানে যুক্ত হন। ১৯৭৫ সালের দিকে বশির উল্লাহর সাথে তার ব্যবসায় পুরোপুরি যুক্ত হন ছেলে নুরুল আমিন। তখন বয়স ছিল মাত্র ৮ বছর। ব্যবসার পাশাপাশি পড়াশোনা চলতে থাকে। ১৯৮২ সালে বিএ পাশ করেন তিনি। তখন চাকুরি করতে পারতেন। কিন্ত তা করেননি। পুরোদমে নেমে পড়েন ব্যবসায়।
তখন থেকে সরাসরি আমদানিকারকদের থেকে সাইকেল ও যন্ত্রাংশ কিনে এনে বিক্রি শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। অল্প সময়ের মধ্যে বৃহত্তর নোয়াখালীতে পাইকারি ও খুচরা বিক্রির অনন্য প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় আমিন সাইকেল।
বর্তমানেও লক্ষ্মীপুর জেলার বিভিন্ন এলাকায় যত সাইকেল বিক্রি হয় তার বেশির ভাগই যায় এ প্রতিষ্ঠান থেকে।

সারোয়ার আমিন জানান, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ, এমবিএ শেষ করে ৩৮তম বিসিএসে নন-ক্যাডার সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। কিন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাবার মতো চাকুরি করবেন না। তবে ফিফা বিশ্বকাপ-২০২২ এর ফিফার একটি প্রকল্পে ৬ মাসের জন্য কাতারে চাকুরি করেছিলেন। এরপর পুরোপুরি ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছেন। এখন সাইকেল উৎপাদন করতে চান তিনি।
ব্যবসার গল্প বলতে গিয়ে সারোয়ার জানান, আমিন সাইকেল ১৯৪৬ সালের দাঙ্গা এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সাক্ষী। ১৯৪৬ সালে বহু হিন্দু পরিবারের লোকজন আমিন সাইকেল স্টোরে রাতে আশ্রয় নেন বা লুকিয়ে ছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন খবর অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পৌঁছে দেওয়ার জন্য বশির উল্লাহর কাছে বলে যেতেন। কারণ এ অঞ্চলে দোকান অনেক কম ছিল। অনেকে পরিবারের জন্য টাকাপয়সা এবং খাবার তার দাদার কাছে রেখে যেতেন। পাকিস্তানীরা এ খবর জেনে ফেলে। একবার পাকিস্তানী আর্মি বশির উল্লাহকে স্থানীয় এলএম স্কুলের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। পরে স্থানীয় এক লোকের সহযোগিতায় তার দাদা বেঁচে যান।
কোন সময়ে সাইকেল বেশি চলে? এ বিষয়ে সারোয়ার বলেন, 'ডিসেম্বর থেকে জানুযারি পর্যন্ত সময়ে সাইকেল ভালো চলে। কারণ এ সময় বাচ্চাদের পরীক্ষা শেষ হয়। অনেক ছাত্রছাত্রীকে পরীক্ষার পর সাইকেল কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে অভিভাবকদের। তখন ভালো চলে। আবার জুন-জুলাইতে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেও সাইকেল বেশি চলে। আমরা প্রতিনিয়ত দেখি বাচ্চারা তাদের মা, বাবা থেকে একটা সাইকেল পেলে কত খুশি হয়'।
নুরুল আমিন বলেন, '৪টা প্রজন্ম আমাদের থেকে সাইকেল কিনছে এ অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। দাদা, বাবা, ছেলে এবং নাতি ও আমাদের থেকে সাইকেল কিনছে। একই দোকান থেকে ৪টা জেনারেশন সাইকেল কিনেছেন। আমরাও বিক্রি করতে পেরেছি, এটা একটা আনন্দের খবর'।
লক্ষ্মীপুর জেলায় এখনো আধুনিক ও দামি যে কোন সাইকেল এবং দেশীয় সাইকেল ও রিক্সার যন্ত্রপাতি পাওয়া যাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠানে। আমিন সাইকেলের শততম বছরটা বর্তমান স্বত্বাধিকারীরা সাইকেল উৎপাদনকারী হিসেবে উদযাপন করতে চান।