টিবিএস বাংলার ২০২২-এর সেরা ২০
২০২২ সালে টিবিএস বাংলার ফিচার লেখকরা অনেকগুলো অসাধারণ ফিচার উপহার দিয়েছেন আমাদের। সেখান থেকে বাছাই করা ২০টি ফিচার তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। এই ফিচারগুলো বিষয়বস্তুর গুরুত্ব দিয়েই পাঠকদের পছন্দের হয়ে উঠেছে, পাঠকরা এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে এই বিশটিই যে টিবিএস বাংলার এ বছরের সেরা লেখা, তা নয়। এসবের বাইরেও রয়ে গেছে অনেকগুলো অসাধারণ লেখা, স্থানাভাবে সেগুলোর উল্লেখ করা গেল না।
আমাদের বিচার এই হলো ২০২২ সালে টিবিএস বাংলার লেখকদের অন্যতম সেরা ২০ ফিচার।
৫০০ সিনেমার বারী স্টুডিও যেভাবে বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ থেকে হারিয়ে যায়!
মো. পনিচুজ্জামান সাচ্চু
ডিও নামের সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। চলচ্চিত্রের স্টুডিও বলতে এমন প্রতিষ্ঠানকে বোঝানো হয়, যেখানে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের সকল সামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ বিদ্যমান। ভারত ভাগের এক দশক পর পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা (ইপিএফডিসি) গঠিত হয়। তবে তখনও বেসরকারি কোনো স্টুডিও ছিল না। ষাটের দশকে প্রথমবারের মতো পূর্ববাংলায় বেসরকারি চলচ্চিত্র স্টুডিও স্থাপিত হয়। ষাটের দশকের শুরুর দিকে কারওয়ান বাজারে 'ইস্টার্ন থিয়েটার' নামে একটি স্টুডিও আত্মপ্রকাশ করলেও কোনো কারণ ছাড়াই ১৯৬৮ সালে সেটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৭০ সালে ইস্টার্ন থিয়েটার নাম পরিবর্তন করে 'বারী স্টুডিও' নামে চালু হয়। তবে এবার নামের সাথে স্থানও পরিবর্তন করা হয়। স্টুডিওটি স্থাপিত হয় ফার্মগেট এলাকার পূর্ব তেজতুরী বাজারের চৌরঙ্গী মোড়ে। দীর্ঘকাল সিনেমা স্টুডিওটি রমরমা ব্যবসা করার পাশাপাশি ব্যাপক সুনাম অর্জন করে।
তবে এখন আর স্টুডিওটি নেই। ইন্টারনেটে বারী স্টুডিও লিখে খোঁজ করলেও তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। স্টুডিওর জায়গায় নতুন করে তৈরী হয়েছে মসজিদ। নাম 'মসজিদুল বারী-তা'য়ালা'।
কেন মায়ের দোয়া নাম রাখতে ভালোবাসেন দোকানিরা?
মাহবুব চোকদার
দেড় কিলোমিটার পথে ১৩টি মায়ের দোয়ার দেখা পেলাম। এর মধ্যে সেলুন ১টি, চটপটির দোকান ১টি, মুদি দোকান ১টি, কনফেকশনারি ১টি, দর্জির দোকান ২টি, টি স্টল ৩টি, টেলিকম সার্ভিসের দোকান ২টি এবং ১টি হোটেল। পথে হয়তো আরো দু'চারটি ছিল, সব তো চোখে পড়ে না। ঢাকায় দোকানের নাম দেখতে দেখতে পথ চললে গাড়ি চাপা পড়ার সম্ভাবনা ১০০ পারসেন্ট না হলেও ৯৯ পারসেন্ট তো বটেই। ওই ১৩টি দোকানের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরটি হলো, একটি চায়ের স্টল। দোকানের ভিতরের শেষ দেওয়াল যেটি রাস্তার দিকে মুখ করা, তাতে একটি সূর্যের মাঝখানে মায়ের দোয়া লেখা, আর সূর্যটি থেকে ছড়াচ্ছে অনেকগুলো রশ্মি। আলমগীর কুমকুম পরিচালিত মায়ের দোয়া ছবিতে যেভাবে কথাটি লেখা হয়েছে এখানেও তেমনটিই দেখতে পেলাম।
উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মায়ের দোয়া ছবির শ্রেষ্ঠাংশে আছেন আলমগীর, শাবানা, অরুনা বিশ্বাস, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। খোশনূর আলমগীর এ ছবির প্রযোজক ছিলেন। ছবির গল্প লিখেছেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু।
টাইপরাইটারের জীবন: '১৬ বছর পর এবার শীতে একটা গরম কাপড় কিনতে পেরেছি'
সালেহ শফিক
সিরাজুদ্দিন সুজার (ছদ্মনাম) বয়স ৫৪। বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ঢাকায় পড়তে এসেছিলেন সোহরাওয়ার্দী কলেজে। পড়ার পাশাপাশি টাইপরাইটারে (ম্যানুয়াল) লিখতেন রায়সাহেব বাজারে জজ কোর্টের পাশে ডিসি অফিস চত্বরে। সেটা ১৯৮৭ সাল। পড়েন আর পড়ার খরচ চালান। বাবা মারা গেছেন সেই ১৯৮১ সালে। শেষে এইচএসসির পর পড়াশোনায় ইস্তফা দিলেন। ইংরেজি টাইপরাইটার কিনেছিলেন ৬ হাজার টাকা দিয়ে। বাড়ির জমি বিক্রি করে জোগাড় করেছিলেন সে টাকা। টাইপরাইটারের নাম ছিল অপটিমা মুনির। ডিসি সাহেবের কাছ থেকে একটা পরিচয়পত্র জোগাড় করে তবেই একটি ডেস্ক নিয়ে বসা যায় ডিসি অফিস চত্বরে। প্রস্থে সাড়ে ৩ ফুট হবে সুজার ডেস্কটি। ওপরে ছাউনি দিয়ে খোপের ভেতর থাকত টাইপরাইটার। এখন আছে একটি কম্পিউটার মনিটর। খোপের ভেতর আরো আছে একটি চিরুনি, একটি টুপি, ছোট্ট আয়না আর চাবির গোছা। ধোপদুরস্ত থাকতে পছন্দ করেন সুজা। ব্যাকব্রাশ করা চুল, পায়ে পরিষ্কার শ্যু, কালো প্যান্টের ওপর একটি জ্যাকেট পরেছিলেন।
বলছিলেন, 'তখন ৮৫ জন টাইপিস্ট ছিল এখানে। দলিল, হলফনামা, চুক্তিনামা, দরখাস্ত, দানপত্র ইত্যাদি কাজের সবই আমরা করতাম। এক পাতা করতে ৫-৭ টাকা নিতাম। চুক্তিপত্র করতে ২৫ বা ৩০ টাকায় চুক্তি করে নিতাম পাতা বুঝে। দিনে ৩৫০-৪০০ টাকা ইনকাম ছিল।'
লবণ-জলে জ্বলে জীবন, ছবি তুলে সাক্ষী রাকিবুল!
সালেহ শফিক
নয় দিনের জন্য গিয়েছিলেন এ দফায়। সেপ্টেম্বর মাস ছিল সেটা। সঙ্গে স্ত্রী ফাবিহা মনীর। দুজনেই ফটো জার্নালিস্ট। মোহাম্মদ রাকিবুল হাসান জুমা প্রেসের স্টাফ, ফাবিহা নিউ ইয়র্ক টাইমসের। রয়টার্সও ডেকে পাঠায় সময় সময়।
রাকিবুল সুন্দরবনসংলগ্ন জনজীবনের ছবি তোলা শুরু করেছেন ২০০৯ সাল থেকে। ২০০৭ সালে প্রলয়ংকরী সিডর আর নয়ে আইলা সুন্দরবন তথা উপকূলের মানুষদের জীবনযাত্রা যাকে বলে 'ছ্যাড়াব্যাড়া' করে ফেলে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। সিডর এসে তা হাতেনাতে বুঝিয়ে দিয়ে গেল। লবণ ঢুকে পড়ল ব্যাপকভাবে উপকূলের জমিজমায়, খাবার পানিতে, দোকানপাটে মায় বসতবাড়িতেও।
সিডরের পর থেকে ফি বছরই কিন্তু একটা না একটা দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। সাগরও আগের তুলনায় বেশি বেশি উতলা হয়, লবণ ঢেলে দেয় জনজীবনে। রাকিবুল খুব খেয়াল রাখেন ওদিকটায়।
'হাতিরঝিল, এলিফ্যান্ট রোড, হাতিরপুল সবই আছে ঢাকায় হাতিই নেই কেবল'
সালেহ শফিক
শাহজাহান নাম নেওয়ার আগে তাঁকে খুররম বলেই ডাকা হতো। তখন তিনি বাদশাহ ছিলেন না, ছিলেন মুঘল প্রিন্স। বাবা জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তিনি ঢাকা অধিকার করেন। সাত দিন ঢাকায় থেকে পকেটে পুরেছিলেন থেকে ৪০ লক্ষ টাকা, চারশ ঘোড়া আর পাঁচশ হাতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিষয়ক ২১টি বইয়ের প্রধান সম্পাদক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, ভাটির এ দেশের পুরোটাই ছিল বণ্যপ্রাণীর জন্য উপযুক্ত আবাসস্থল। প্রচুর বৃষ্টিপাত ও অগণিত জলাশয় অঞ্চলটিকে করে তুলেছিলে বণ্যপ্রাণীর জন্য উর্বরা ও সুফলা। ব্যতিক্রম ছিল না ঢাকাও।
বাঘ-হাতি-সাপের আখড়া ছিল আজকের মেট্রোপলিটন সিটি- ঢাকা। প্রত্নতাত্ত্বিক সূফী মোস্তাফিজুর রহমানের উয়ারি-বটেশ্বর খননে প্রাপ্ত তথ্য আমাদেরকে হাজার হাজার বছর পূর্বের গঙ্গাঋদ্ধি নামের সমৃদ্ধশালী এক জনপদের কথা জানাচ্ছে। গঙ্গাঋদ্ধির শৌর্য-বীর্যের কথা আগে থেকে জানা ছিল গ্রীক বীর আলেকজান্ডারের। মাঝপথে যুদ্ধযাত্রা তাঁর স্থগিত করার একটি কারণ ওই গঙ্গাঋদ্ধির শান-শওকত। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, গঙ্গাঋদ্ধি আক্রমণ করলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। আর ধারণা করতে কষ্ট হয় না, রাজ্যটির মূল বাহুবল ছিল হাতি।
মোহাম্মদ শামছুদ্দোহা যেভাবে 'বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন' খুঁজে পেলেন
সালেহ শফিক
পিএইচডি শেষ করলেন ২০১১ সালে মোহাম্মদ শামছুদ্দোহা, শামস বলেই যাকে পরিবারের লোকেরা ডাকে। গবেষণাপত্রের একটি নির্বাচিত অংশ প্রকাশিত হলো পানিবিশেষজ্ঞদের আন্তর্জাতিক সংঘের বিখ্যাত সাময়িকী হাইড্রোজিওলজি জার্নালে। এতে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন কথাটি ছিল না, তবে ভাবনাটি বিস্তারিত বলা হয়েছিল। কারণ তখনো শামসের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্ত (অন্তত তিন দশকের) ছিল না যা দিয়ে মেশিনটি কোথায় কতটা কাজ করে নিশ্চিত করে বলা যেত।
শামস পড়েছেন ভূতত্ত্বে। তবে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়নি স্নাতকোত্তর শেষ করার আগে। সুযোগটা আসে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল বিজ্ঞানী আর্সেনিক নিয়ে গবেষণা করতে এলে। তাঁরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদের কাছে—যিনি শামসের শিক্ষকও—গবেষণা সহকারী হিসাবে একজন ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটের সন্ধান চেয়েছিলেন।
যে জীবন বাস কন্ডাক্টরের: দিন শুরু যার বচসায়, ভাড়ার বিবাদে!
সালেহ শফিক
বেশ কয়েকটি রুটের বাসের জিরানোর জায়গা মিরপুর ১২ নম্বর। এর মধ্যে নাম করা যায় নারায়ণগঞ্জগামী হিমাচল, মাওয়াগামী স্বাধীন, যাত্রাবাড়িগামী শিকড়, কালিয়াকৈরগামী রাজধানী, মতিঝিলগামী বিকল্প বা আজিমপুরগামী সুপার লিংকের। ঢাকার মধ্যে চলা বাসগুলো জিরানোর সময় বেশি পায় না, তবে নারায়ণগঞ্জ বা আরেকটু দূরে যারা যায় তারা কিছু বেশি সময় পায়। মিরপুর সিরামিকস থেকে কালশী যাওয়ার পথটিই মূলত বাসগুলোর বিশ্রামখানা। তাই এপাশে ওপাশে ফুটপাথের ওপর চায়ের দোকান, ভাতের দোকানও বসেছে কয়েকটি।
শিকড় পরিবহনের কন্ডাক্টর জুম্মনের বয়স ৩৪। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন। ৯৬ সালের দিকে মা ও মামার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে ফার্মগেট যেতেন। সেখানে ১৮ টাকা শয়ে ইট ভাঙতেন। তারপর নিরানব্বই সালে পরিবহন লাইনে আসেন। পাড়াতো ভাই বন্ধুরা ছিল লাইনে, তাদের মাধ্যমেই গাড়ির হেলপার হন। তার একটি মেয়ে ছিল, নাম রেখেছিলেন সাজিয়া, নিউমোনিয়ায় মারা গেছে ১৩ বছর আগে। জুম্মনকে দেখতে অবশ্য ২০-২২ বছরের মনে হয়। হাল আমলের ছেলেদের মতো ত্যারচা করে চুল কাটা তার। গলাটা বেশ ভারী। গাড়ির ভিতর বসেই ওস্তাদের সঙ্গে ভাত খাচ্ছিলেন গরুর সালুন দিয়ে। দুই বেলায় খোরাকি বাবদ ৭০ টাকা করে পান প্রতিজন। তাতে সবসময় কুলায় না, বিশেষ করে যেদিন গরুর তরকারি দিয়ে ভাত খেতে মন চায়। তখন নিজের পকেট থেকে ভরতে হয়।
ঢাকার অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান: সেইসব আধা সাদা সাহেব-মেম
সালেহ শফিক
অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলতে কী বোঝেন আপনি?
এ প্রশ্নের জবাবে আমি ছোট্ট করে বললাম, ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান মিক্সড।
হাশেম সূফী বললেন, কেবল ব্রিটিশ নয়, বলা উচিত ইউরোপিয়ান-ইন্ডিয়ান মিক্সড। ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ দখলে নেওয়ার পর দলে দলে ডাচ, আইরিশ, আর্মেনীয়, স্প্যানিশ, গ্রিকরা এসেছিল এখানে। পর্তুগিজরা তো এসেছিল তাদেরও আগে। গোয়া তো পর্তুগিজ কলোনিই ছিল। গোয়ানিজ পর্তুগিজদের বড় একটা দল ভারতের নানা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তবে অ্যাংলোদের বেশি দেখা গেছে বাংলাতেই বেশি। বাংলাদেশে তাদের বসতি বেশি ছিল ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জে। উনিশ শতকের মধ্যভাগ মানে ১৮৪০ বা ১৮৫০-এ ঢাকা শহরটি ছিল সদরঘাটের আশপাশে এক বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে, মানে লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, পাটুয়াটুলি, মিটফোর্ড বা নওয়াবপুর। তীব্র আত্মপরিচয় সংকটে ভুগত অ্যাংলোরা। এরা হাফ রেড, বাদামি বা ফর্সা রঙের হতো। তবে তাদের সবার নাক ছিল খাড়া। বাইরের কারও সঙ্গেই তারা সেভাবে মিশত না। বিয়েশাদি তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমিত ছিল। পরিচয় জটিলতায় ভুগত বলেই সম্ভবত তারা কিছুটা উগ্র মেজাজের হতো।
প্লেন স্পটারস বাংলাদেশ: মুরাদ হাসান ও তাঁদের 'প্লেনধরা' দল
সালেহ শফিক
জেটফটোজ দেখতে দেখতে ইচ্ছা জাগল মুরাদ হাসানের। নাম থেকেও আঁচ করা যায় প্লেনের ছবির হাট ওই জেটফটোজ। পৃথিবীর তাবৎ প্লেন স্পটাররা নিজের তোলা ছবি তুলে আড্ডা জমায় ওখানে। তবে জেটফটোজে ছবি ওঠানো সহজ নয় মোটেই। বেশ ভারী একটা বিশেষজ্ঞ দল আছে ফটোসাইটটির। সপ্তাহখানেক ধরে ছবি যাচাই-বাছাই করে তারা। ছবিটা কতটা পরিষ্কার আর তাতে প্লেনের বৈশিষ্ট্যগুলি ঠিকমতো ফুটে উঠেছে কি না, তারপর নির্দিষ্ট প্লেনটির ছবি আগে কতবার তোলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে নতুনটির বিশেষত্ব কী ইত্যাদি অনেক কিছুই তাদের যাচাই-বাছাইয়ের বিষয়ে থাকে।
এহেন একটি ভ্রু কুঁচকানো বিচারসভাকে তুষ্ট করে এরই মধ্যে এগারোশ'র বেশি প্লেনের ছবি জেটফটোজে তুলে ফেলেছেন মুরাদ হাসান। তার মধ্যে আবার ৩০টি প্লেনের ছবি তাঁর আগে কেউ দেয়নি। আর বিশেষায়িত প্লেনের ছবি আছে ৯১টি। উল্লেখ্য, প্লেন ফটোর আরেকটি সাইট প্লেনস্পটারসডটনেটেও আছে মুরাদের ছবি।
সদরঘাট: 'বুড়িগঙ্গা জীবন দিয়েছে ঢাকাকে, আর ঢাকা নদীটাকে মারল!'
সালেহ শফিক
বাবা একবার লঞ্চঘাট ডেকেছিলেন। ঘাটে একটা চারপেয়ে টেবিল ছিল, তার একটা ড্রয়ার ছিল, বসার জন্য দুটি কাঠের চেয়ার ছিল। টেবিলের ওপর টিকিটের তোড়া থাকত। সেটা আশির দশকের মাঝামাঝি। টিকিটগুলো ছাপানো ছিল, জনপ্রতি মূল্য আট আনা ছিল- বোধকরি।
ছোট্ট ঘাট একটা, ধলেশ্বরীর পাড়ে, মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ি থানার আব্দুল্লাপুর গ্রামে। দুই রুটের লঞ্চ আমাদের ঘাট ধরে যাতায়াত করত। একটা রুট ছিল তালতলা থেকে নারায়ণগঞ্জ; অন্যটা তালতলা থেকে ঢাকা। লঞ্চগুলোর ছিল কাঠের বডি। স্টিলের বডিওয়ালা লঞ্চ তখন হাতেগোনা।
সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন, ১০০ হাত দূরে থাকুন, আমাকে ডিজেল দিন—ট্রাক যখন ক্যানভাস
তামারা ইয়াসমীন তমা ও মো. পনিচুজ্জামান সাচ্চু
সমগ্র বাংলাদেশ ৫ টন, সাধারণ পরিবহন, ১০০ হাত দূরে থাকুন, আমাকে ডিজেল দিন—লেখাগুলো পড়লেই চোখের সামনে ভেসে উঠবে ধুলোমাখা এক ট্রাকের ছবি।
শুধু লেখা নয়, মহাসড়কে মাইলের পর মাইল ছুটে চলা এসব ট্রাকের পুরো শরীরই যেন চলন্ত ক্যানভাস। চাঁদ-তারা, কাবাঘর, তাজমহল, বাঘ, ময়ূর, ঈগল, বোরাক, দুলদুল, শাপলা, কলমী, ফুল-লতাপাতা, গ্রামের দৃশ্য কী নেই তাতে! বহুবার চোখে পড়লেও শিল্পের এই নান্দনিক দিক নিয়ে কখনো হয়তো গভীরভাবে চিন্তার সুযোগ আসেনি। অথচ অন্যান্য লোকজ শিল্পের মতো ট্রাকে আঁকা এসব নকশা ও ছবিতেও রয়েছে দেশের মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক চর্চাসহ সামাজিক পারিপার্শ্বিকতার প্রতিফলন।
মাত্র ১০০ টাকায় অফিসেই পৌঁছে যাবে বাড়ির রান্না খাবার!
সুস্মিতা চক্রবর্তী মিশু
সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসের পানে ছুটে চলা বঙ্গের নারী-পুরুষের জীবনে প্রায় নৈমিত্তিক ব্যাপার। তার উপর রাস্তায় জ্যাম হলে তো কথাই নেই। যেভাবেই হোক, নির্ধারিত সময়ে অফিসে পৌঁছাতেই হবে। সময়মতো অফিসে পৌঁছানোর তাড়নায় অনেকে হয়তো দুপুরের খাবার নিতেই ভুলে যান।
তাই দুপুরের খাবারের সহজ সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে বিভিন্ন ক্যাটারিং সার্ভিস। ভাজা-পোড়াকে দূরে রেখে ৯৯ টাকা থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে বাড়ির খাবারের মতো খাবার অফিসে সরবরাহ করেন তারা। স্বল্প খরচে মানসম্মত খাবার সরবরাহকারী এসব ক্যাটারিং সার্ভিসের অবস্থান আমাদের আশেপাশেই। আজ তাদেরই গল্প শোনাব।
ঢাকার হারানো বইয়ের দোকানের খোঁজে
রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
আমাদের কাছে বইয়ের ভাণ্ডার মানেই ঢাকার নীলক্ষেত। কিন্তু তার আগে ঢাকার মানুষরা বইয়ের খোঁজ পেত কোথায়? সে নিয়েই আজকের লেখাটি।
সময়টা ৬০ এর দশক। ঢাকা শহর তখন এত বিস্তীর্ণ আর মানুষে ভরপুর ছিল না। মানুষ কম ছিল ঠিকই, কিন্তু যোগাযোগ ও যাতায়াত ভালো ছিল তাদের মধ্যে। ফলে সবাই সবাইকে চিনতো, জানতো। তখন কেবল স্টেডিয়াম হলো জিন্নাহ এভিনিউয়ের পাশে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু এভিনিউ)। স্টেডিয়ামের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল মোহাম্মদ শাহাজাহান নামটি। শাহজাহান ছিলেন ক্যালকাটা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের ক্যাপ্টেন। ভিক্টোরিয়া পার্কের বিখ্যাত বইয়ের দোকান প্রভেনশিয়াল বুক ডিপো ছিল তাদের পারিবারিক ব্যবসা। মূলত পাঠ্যবইয়ের দোকান ছিল এটি। যা পরে চলে এলো স্টেডিয়ামের দোতলায়।
'ইতিহাসের গল্প' বলছেন যারা ডিজিটাল দুনিয়ায়
রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
সত্তরের দশকের একটি পালকিটানা সাদাকালো ছবি মোবাইলের পর্দায় ভেসে উঠল। সে ছবির নিচে অসংখ্য মানুষ জুড়ে দিচ্ছে পালকিকে ঘিরে তাদের নানান স্মৃতি। তাদের কেউ কেউ ছোটোবেলায় দেখেছেন পালকিতে করে বউ নিয়ে যেতে, কেউ আবার নিজের বোনের বিয়েতে পালকি ব্যবহার করেছেন। কেউ আবার নিজেই পালকিতে চড়ে বিয়ে করেছেন। আবার পালকির সঙ্গে মানুষের বিয়ে হতে দেখেছেন, এমন আজব স্মৃতির রোমন্থনও করেছেন কেউ কেউ!
আরেকটি পোস্টে রয়েছে, মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র পেরেকের সঙ্গে চুল বেঁধে পড়াশোনা করছে। রাত জেগে পড়াশোনায় ঘুম যেন ব্যাঘাত না ঘটায়– সেজন্যই এই বিশেষ ব্যবস্থা। ছবিটি ১৯৪৮ সালের দিকে তোলা। কিন্তু অনেকেই সে ছবিতে কমেন্ট করে লিখেছেন, তাদের বাবা বা গুরুজনেরাও পড়াশোনার জন্য মাঝে মাঝে চেয়ারের সঙ্গে নিজেদের বেঁধে রাখতেন। অনেকে আবার এই ছবি দেখে কেউ এ ব্যবস্থার নিন্দেও করেছেন, অনেকে পেয়েছেন বিনোদন। আবার মজা করে অনেকে টুকে দিয়েছেন এমন কমেন্ট, 'দারুণ হিটলারি আইডিয়া, আমিও এখন থেকে এভাবে পড়াশোনা করব!'
নিউমার্কেটের বিস্মৃত যশ-পরিচয়হীন এক শিল্পীর গল্প!
রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
'ধরুন, আপনি বসে আছেন, আমি এখানে কী দেখবো জানেন? দেখবো আপনার মন কেমন, মুড কেমন। আপনার মুড যদি তুলে ধরতে পারি ছবিতে, তবেই বুঝবো আমার ছবিটা হয়েছে।'
কথাগুলো বলছিলেন ফ্রিল্যান্সার শিল্পী আমিরুল ইসলাম।
কয়েকবছর আগেও নিউমার্কেটে গেলে দেখা মিলতো তার। লাইব্রেরীর দোকানগুলোর সামনে কখনো দাঁড়িয়ে কখনোবা বসে ইজেলে রঙ ছড়াতেন তিনি। কারও ছবি না, মার্কেটের ভেতরের দৃশ্য তুলে ধরতেন ক্যানভাসে। মানুষের আসা-যাওয়া, কেনাকাটা, ব্যস্ততা- সে এক জমজমাট দৃশ্য ফুটে উঠতো রঙ তুলির ছোঁয়ায়!
সিনে ব্যানার, রিকশা পেইন্টার হানিফ পাপ্পু: মন পড়ে থাকে এখনো বিশ ত্রিশ ফিটের সেই ক্যানভাসে!
রাফিয়া মাহমুদ প্রাত
এখন পাপ্পু সারাদিন দোকানেই বসে থাকেন। দোকানের সামনে ছোটখাটো আড্ডার জায়গা হয়ে উঠেছে, প্রতিদিনই আড্ডার আসর বসে এখানে।একেকজন আসে গল্প করে, আবার চলে যায়। মাঝে মাঝে পাপ্পু নিজেও তাদের সঙ্গে গলা মেলান, কখনোবা সিগারেট ফুঁকেন বকশী বাজার লেনের এই দোকানটির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কখনোবা ছোটো ছোটো ঘর সাজানোর জিনিসে করেন নকশা। এভাবেই বিশ্রাম আর টুকিটাকি কাজে চলছে তার জীবন।
অথচ, স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৮৫-৯০ সাল পর্যন্ত হানিফ পাপ্পুর জীবন কেটেছে একপ্রকার না ঘুমিয়ে, না খেয়ে। ঠিকমতো ভাত খাবার সময়টুকুও পেতেন না তিনি। শুক্রবার দিন শুধু একটু বিশ্রাম করতে পারতেন। তাও দু' ঘণ্টা। অথচ, জীবনের সেই সময়টাই ছিল পাপ্পুর জন্য সোনালী সময়।
কেন বাংলাদেশে তারা? স্পেন, আমেরিকা, ভারত থেকে আসা হলি ফ্যামিলির ১১১ শিক্ষার্থী…
শেহেরীন আমিন সুপ্তি
বিদেশি শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজগুলো বরাবরই আকর্ষণীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সরকারি মেডিকেল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীর কোটা খুব সীমিত হলেও দেশের বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা বাড়ছে নিয়মিত। সম্প্রতি বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে মোট আসন সংখ্যার ৪৫ শতাংশ বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। উন্নত অনেক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় বাংলাদেশের মেডিকেল শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশি আস্থা রাখছেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
বাংলাদেশি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য সাধারণত নিজ দেশের কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন করেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা। উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে মেডিকেল কলেজগুলোতে তাদের ভর্তি যোগ্যতা যাচাই করা হয়। কলেজভেদে পড়াশোনার খরচ আর সুযোগ-সুবিধাও ভিন্ন হয়।
স্টুডিও পদ্মা: ৩৭ বছর ধরে তারকাদের প্রিয় যে ফটো স্টুডিও
শেহেরীন আমিন সুপ্তি
"৪০০, নিউ ইস্কাটন রোড– এক অভিজাত ঠিকানা। একটা ছোট দোতলা মার্কেট ছিল এখানে। নিচে ১০টা দোকান, ওপরে আরও ১০টা। এখানেই ছিল, অভিনেতা আমিরুল হক চৌধুরীর 'ঢাকা কফি হাউজ'। তার পাশেই 'স্টুডিও পদ্মা'। কফি হাউজের আড্ডায় জড়ো হতেন দেশের বিখ্যাত সব অভিনেতা, গায়ক, সাংবাদিক আর রাজনীতিবিদেরা। যেই আড্ডা ছড়িয়ে পড়ত স্টুডিও পদ্মা জুড়েও। সেসময় পদ্মা শুধু ছবি তোলার জায়গা ছিল না– তার চেয়েও বেশি ছিল তারকাদের মিলনমেলা," স্মৃতিচারণ করছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম আলোকচিত্রী আক্কাস মাহমুদ। স্টুডিও পদ্মার কর্ণধার তিনি।
ওরাও কম যায় না! দক্ষিণী সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য নির্মাণ করে এখন তারাও 'হিরো'
শাবনুর আক্তার নীলা
বাণিজ্যিক সিনেমায় নায়ক ও খলনায়কের মধ্যে মারামারির দৃশ্য প্রায়ই দেখা যায়। যেখানে নায়কের শক্তি ও অন্যদের থেকে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের জন্যে-একাই তাকে প্রতিপক্ষ বা ভিলেন দলের সবাইকে মেরে কাবু করতে দেখা যায়। সব দেশের সব ভাষার সিনেমায় এ ধরণের অ্যাকশন দৃশ্য অত্যন্ত কমন।
বর্তমান সময়ে দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাগুলো রাতারাতি জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনেও অন্যতম মূল কারণ , সিনেমায় দেখানো দুর্দান্ত সব অ্যাকশন দৃশ্যসমূহ। মাঝেমধ্যে অ্যাকশন দৃশ্যে দেখানো বিষয়গুলো বাস্তবিকতার ঊর্ধ্বে মনে হলেও দর্শক এগুলোকে দারুণভাবে উপভোগ করে। কারও কারও আবার মনে ইচ্ছে জাগে এইরকম মারকাটারি দৃশ্যে নিজে অভিনয় করার। কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। আর এই ইচ্ছের বশেই একদল তরুণ কোনরকম অর্থের যোগান ছাড়াই বানিয়ে ফেলছে হুবহু দক্ষিণী সিনেমার অ্যাকশন দৃশ্য।
বাংলাদেশে ব্যতিক্রমী এক লাইব্রেরি—যেখানে কোনো বই নেই, আছে শুধু মানুষ
শাবনুর আক্তার নীলা
লাইব্রেরি কথাটি শুনলেই গৎবাঁধা চিন্তা থেকে আমাদের মাথায় আসে সারি সারি বই দিয়ে সাজিয়ে রাখা একটি ঘর, যেখানে পাঠকেরা নিঃশব্দে পছন্দের বই পড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু লাইব্রেরি মানেই কি শুধু ছাপানো বইয়ের পাতা উল্টিয়ে পড়ে যাওয়া! জড়ো পদার্থ বইয়ে লেখা গল্পগুলো নিজেরা কথা বলতে পারে না, পাঠক গল্পগুলো পড়ার সময় নিজেদের কল্পনার মাধুরী দিয়ে সেগুলোকে জীবন্ত রূপ দেন। কিন্তু কেমন হতো যদি বই নিজেই নিজের গল্প বলতো?
'হিউম্যান লাইব্রেরি' অর্থাৎ মানুষের গ্রন্থাগার- যেখানে কাগজের ছাপানো বইয়ের পরিবর্তে থাকে 'জীবন্ত বই'। প্রতিটি মানুষের জীবনে এক ও একাধিক না বলা গল্প থাকে। নিজেদের জীবনের নানান চড়াই-উৎরাইয়ের গল্প বলতে আসা গল্পকাররা এখানে বই হিসেবে থাকেন। পাঠক বা লাইব্রেরিতে আগতদের সামনে সেই গল্পের সংক্ষিপ্ত কাহিনী দেওয়া থাকে এবং কাহিনী পড়ার পর নিজেদের পছন্দমতো 'বই'কে বেছে নেন তারা।