টিকটক ক্রিয়েটররা হলিউডের মুভিকে সংক্ষেপিত করে কয়েক মিনিটে নামিয়ে এনে মিলিয়ন ভিউ কামিয়ে নিচ্ছে

অনেকদিন ধরে একটা সিনেমা দেখতে চাইছেন, কিন্তু সময় পাচ্ছেন না? এই মুশকিলের আসান নিয়ে এসেছে বেশ কিছু টিকটক অ্যাকাউন্ট।
যেমন, একটি রোবটিক কণ্ঠ টিকটকের একটি ভিডিও ক্লিপের ধারাবিবরণী করছিল এভাবে: 'এই মহিলা বাড়ির সবকিছুর সঙ্গে ধাক্কা খেল, তারপর নিজের শরীর থেকে ৮০০ সিসি রক্ত বের করে নিল।'
'হাই আইকিউ রিভেঞ্জ ফর চিটিং হাজব্যান্ড' শিরোনামের ভিডিওটিতে আড়াই ঘণ্টার ছবির কাহিনিসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে মাত্র সাত মিনিটে।
৪৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপে 'দ্য ড্যানিশ গার্ল'-এর সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে। ভিডিওটির শিরোনাম 'দ্য ওয়াইফ লেট দ্য হাজব্যান্ড ড্রেস আপ অ্যাজ আ উম্যান, অ্যান্ড হি ইজ অ্যাডিক্টেড টু ইট'। অর্থাৎ স্ত্রী স্বামীকে মহিলাদের মতো পোশাক পরতে দিয়েছিল, এবং স্বামী এতে আসক্ত হয়ে পড়ে।
চীনা ক্রিয়েটররা অনুবাদ অ্যাপ, ডাবিং সফটওয়্যার ও ভিপিএন (কারণ চীনে টিকটক ব্লক করা) ব্যবহার করে ইংরেজি, স্প্যানিশ ও বাহাসা ইন্দোনেশিয়ায় (ইন্দোনেশীয় ভাষা) দর্শকদের দ্রুতগতিতে, অল্প সময়ে সিনেমা ও টিভি ড্রামা দেখতে সাহায্য করে।
অনুবাদের ভুল এবং রোবটমার্কা ধারাবিবরণী সত্ত্বেও একেকটি ভিডিও ক্লিপ কয়েক হাজার থেকে কয়েক মিলিয়ন পর্যন্ত ভিউ কুড়িয়ে নিচ্ছে। এ থেকে ক্রিয়েটররা ভালো অর্থ উপার্জনও করছে। 'দ্য ড্যানিশ গার্ল'-এর কাহিনিসংক্ষেপের ভিডিওটির ভিউসংখ্যা এখন চার মিলিয়নের বেশি।
দুউয়িন (টিকটকের চীনা সংস্করণ), কুয়াইশু ও বিলিবিলি-র মতো ভিডিও প্ল্যাটফর্মগুলোতে বিভিন্ন সিনেমাকে ছোট ভিডিও বানিয়ে উপস্থাপন করা চীনাভাষী অঞ্চলে বহু বছর ধরেই জনপ্রিয়। আর এখন স্থানীয় ভিডিও শিল্প আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে ওঠায় ক্রিয়েটররা তাদের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে এই ভিডিওগুলোকে চীনে নিষিদ্ধ প্ল্যাটফর্ম টিকটকে নিয়ে যাচ্ছে।
চীনের পূর্বাঞ্চলীয় জিয়ানজি প্রদেশের মুভি-ক্লিপ প্রযোজক উইলসন সংবাদমাধ্যম রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ডকে বলেন, 'মুভি আর টিভি দুনিয়ার সব প্রান্তের সব মানুষের জন্য। আমরা সবাই একই জিনিসের জন্য কাঁদি, হাসি আর অভিযোগ করি।'
ব্যক্তিগত গোপনীয়তার জন্য নিজের পুরো নাম জানাতে রাজি হননি উইলসন। তিনি জানান, ১০টি টিকটক অ্যাকাউন্ট থেকে মাসে তার ১ হাজার ৪০০ ডলার আয় হয়।

নিজের টিকটক অ্যাকাউন্টগুলোর জন্য উইলসন দুউয়িনের মতো প্ল্যাটফর্ম থেকে মুভি ও টিভি ক্লিপ ডাউনলোড করেন। প্রথমে সিনেমার কাহিনিসংক্ষেপ চীনা ভাষায় লিখে নেন তিনি। তারপর সেটিকে ইংরেজিতে রূপান্তরিত করার জন্য ডিপএল নামক অনুবাদসেবা ব্যবহার করেন। এরপর ডাবিং অ্যাপ ময়িন দিয়ে নতুন নেপথ্যকণ্ঠ (ভয়েসওভার) তৈরি করেন। সবশেষে উইলসন অ্যাডোবি প্রিমিয়ারে সবকিছু সংযোজন করেন। তবে তিনি কিছু ফ্রেম সরিয়ে ফেলেন বা উল্টে দেন, যাতে টিকটক ক্লিপটিকে চুরি হিসেবে ধরতে না পারে।
বি নামের আরেক টিকটক মুভি এডিটর রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ডকে জানান, তিনি ভিপিএন দিয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক দুটি টিকটক মুভি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে প্রতিটি মুভি ক্লিপ থেকে ৩৪২ ডলার আয় করেন। তার জনপ্রিয় ক্লিপের মধ্যে পেপ্পা পিগ-এর মতো ব্রিটিশ শো-ও আছে। তবে তিনি অ্যাকাউন্টগুলোতে প্লেজেন্ট গোট ও বিগ বিগ উলফের মতো চীনা শোয়ের ভিডিও ক্লিপ আপলোড করেও সাফল্য পেয়েছেন।
বি বলেন, 'টিকটকে আপনি সারা বিশ্ব থেকে ট্রাফিক পাবেন। যতক্ষণ এডিট ও পোস্ট করতে থাকবেন, কেউ না কেউ দেখবেই।'
বি আর উইলসন অর্থের বিনিময়ে নতুনদের ভিডিও ক্লিপ এডিটিংসহ অন্যান্য কলাকৌশলও শেখান।
বি জানান, তার অনেক ছাত্রছাত্রী বাড়িতেই বসে থাকে। তাই তারা অবসরে অর্থ উপার্জনের সহজ উপায় খুঁজছিল।
উইলসন জানান, তিনি ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়া সম্প্রতি তিনি জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ ও বাহাসা ইন্দোনেশিয়াতেও মুভি ক্লিপ তৈরি করতে আরম্ভ করেছেন।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ডের পক্ষ থেকে টিকটকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি।
এই অ-মৌলিক কাজটির জনপ্রিয়তা চীনে অনেকদিন ধরেই কপিরাইট বিতর্ক উসকে দিয়েছে। ২০২১ সালে দুউয়িনের মতো শর্ট ভিডিও অ্যাপগুলোতে মুভি ও ড্রামার ক্লিপ আপলোডের প্রতিবাদ করে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আইকিয়ি, টেনসেন্ট ভিডিও ও ইউকু।
টেনসেন্ট পরে কপিরাইট লঙ্ঘনের জন্য কয়েক মিলিয়ন ডলার দাবি করে দুউয়িনের বিরুদ্ধে মামলা করে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে চায়না নেটকাস্টিং সার্ভিসেস অ্যাসোসিয়েশন—যা সেন্সরশিপ নির্দেশিকা জারি করে—শর্ট ভিডিও অ্যাপগুলোকে লাইসেন্সবিহীন ফিল্ম ও টিভি ক্লিপ নিষিদ্ধ করার নির্দেশ দেয়।
কিন্তু এই বিধিনিষেধও মানুষকে নতুন ভিডিও ক্লিপ পোস্ট করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তারা মাঝেমধ্যে থাই, কোরিয়ান ও আমেরিকান ড্রামা থেকে নতুন ক্লিপ পোস্ট করত। তাদের যুক্তি ছিল, চীনের বাইরের কপিরাইটধারকরা চীনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুলিশিং করবে তেমন সম্ভাবনা কম।
কিছু স্থানীয় স্ট্রিমিং কোম্পানি এসব শর্ট ভিডিও অ্যাপের সঙ্গে বিরোধে না জড়িয়ে বরং তাদের সঙ্গে সমঝোতায় এসে একসাথে কাজ করছে। চলতি বছরের জুলাইয়ে দুউয়িন ব্যবহারকারীদেরকে ভিডিওতে নিজেদের কনটেন্ট ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছে আইকিয়ি। বিনিময়ে দুউয়িন ভিডিওর নিচে একটি লিঙ্ক যুক্ত করে দিচ্ছে, যাতে ওতে ক্লিক করে ব্যবহারকারীরা আইকিয়ির মূল ভিডিওতে যেতে পাবে।
লস অ্যাঞ্জেলেসের কপিরাইট ও বিনোদন অ্যাটর্নি ল্যারি জার্নার রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ডকে বলেন, অ-মৌলিক কাজগুলোর জনপ্রিয়তা আরও বাড়লে হয়তো আমেরিকান স্টুডিওগুলো টিকটকের সঙ্গে লাইসেন্সিং চুক্তি করতে আগ্রহী হবে। এখন বিদেশি ক্রিয়েটরদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করলেও তা কোম্পানিগুলোর জন্য আর্থিকভাবে লাভজনক হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শর্ট ভিডিওগুলোর দর্শক ক্রমেই বাড়ছে। যারা কয়েক মিনিটে পুরো একটি মুভি বা ড্রামা সিরিজ শেষ করে ফেলতে চায়, তারাই এসব ভিডিওর দর্শক। কাহিনিসংক্ষেপ দেখার পর কেউ কেউ পুরো মুভি বা ড্রামা দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে, ভিডিওর নিচে মন্তব্য লিখে সিনেমার নাম জানতে চায়। এছাড়া তারা নিজেরা নিজেদের মধ্যে সিনেমা বা ড্রামা নিয়ে মতামত আদানপ্রদান করে। আর অনুবাদের ভুলত্রুটিগুলোও ব্যবহারকারীদের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠেছে।
- সূত্র: রেস্ট অভ ওয়ার্ল্ড