বিশ্বকাপের আগেই রাজনৈতিক কারণে আমাকে আক্রমণ করা হয়েছে: মাশরাফি

বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি বরাবরই আলোচিত। গত বিশ্বকাপ থেকে অবশ্য সমালোচনার সূচেই বিদ্ধ হতে হয়েছে বেশি। তবে সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস সঙ্কটে আবার তার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে তুমুল। সব মিলিয়ে মাশরাফি বিন মুর্তজা সবার কৌতুহলের কেন্দ্রেই আছেন।
বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়ক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় কথা বললেন এখনকার সঙ্কটে তার কার্যক্রম, গত বিশ্বকাপের ব্যর্থতা, মাঠের ভেতর-বাইরের আলোচনা-সমালোচনাসহ আরও অনেক কিছু নিয়ে।
টিবিএস: করোনাভাইরাসের কারণে অনেকদিন ধরেই ঘরবন্দি অবস্থা। এই মুহূর্তে কীভাবে সময় কাটছে?
মাশরাফি বিন মুর্তজা: এই মুহূর্তে আসলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে সময় কাটছে। এ ছাড়া তো আর কিছু করার নেই। সবার একই অবস্থা, কিছু করার নেই। ঘরের মধ্যেই আছি, সবার সঙ্গে সময় কাটছে।
টিবিএস: করোনায় আপনি বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। এটা কি সংসদ সদস্য হিসেবে দায়বদ্ধতা নাকি মাশরাফি বিন মুর্তজাও ঠিক এই কাজই করতেন?
মাশরাফি: মাশরাফি কী কাজ করতো, এখানে বলাটা কতুটুকু মূখ্য আমি জানি না। তবে অবশ্যই করতো। আর সংসদ সদস্য হিসেবে যেটা আছে, সেটা তো অন্যরকম জিনিস। সেটা তো করতেই হবে। তবে ব্যক্তি মাশরাফিও করতো।
টিবিএস: করোনাভাইরাসের প্রকোপ শেষে ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে ক্রিকেটারদের সমস্যা হবে কিনা? হয়তো অনেক কিছুই বদলাবে, কী কী প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে বলে মনেহয়?
মাশরাফি: চ্যালেঞ্জিং যে ব্যাপারটা থাকবে, সেটা ফিটনেস। কারণ ফিটনেস নিয়ে মাঠেই বেশি কাজ করার থাকে। পাশাপাশি স্কিলে কিছুটা সময় লাগতে পারে, ঠিক জায়গা মতো আনতে সময় লাগতে পারে। কারণ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। এরপরে আরও কতদিন অপেক্ষা করতে হবে, আমরা কেউ জানি না। স্কিলের ঘাটতি যেটা, কাটিয়ে ওঠা হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সম্ভব হবে। তো এসব সাময়িক চ্যালেঞ্জ থাকবে। এর জন্য সময় দিতে হবে।
টিবিএস: আপনার ফিটনেসের কী অবস্থা?
মাশরাফি: কাজ করছি। সাধারণত রোজায় আমি ডায়েট করি না, এবার করেছি। এটুকু বলতে পারি, যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো অবস্থায় আছ।
টিবিএস: নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়ার পর জীবন কতটা বদলেছে? এতো মানুষকে সামলাতে হয়, স্বপ্ন দেখাতে হয় আবার সেটা পূরণও করতে হয়। এই কাজটাই কাজটাই কি বেশি কঠিন?
মাশরাফি: কাজ সবই কঠিন। কোনোটাই এতো সহজ না। আপনি কীভাবে করছেন সেটার ওপর সবকিছু নির্ভর করে। আপনি কীভাবে দেখছেন, কীভাবে করছেন, সেটা ব্যাপার। একজন কখনও সবার মন রক্ষা করতে পারে না। একটা প্ল্যাটফর্মে যখন আপনি কাজ করবেন, তখন চেষ্টা করবেন নিজের সেরাটা দিতে। লক্ষ্য রাখবেন নিজের সেরাটা দিচ্ছেন কিনা, এটাই সব। এর বাইরে কিছু নেই। সেরাটা দেওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ।
টিবিএস: ২০১৯ বিশ্বকাপের কথা ভুলে গেছেন নাকি দুঃস্বপ্ন হয়েই আছে?
মাশরাফি: অবশ্যই এটা দুঃস্বপ্ন হয়ে আছে। এটা এতো সহজে ভুলে যাওয়ার মতো নয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এটা দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে যাবে।
টিবিএস: আপনার জন্য এটাই সবচেয়ে বাজে বিশ্বকাপ কিনা?
মাশরাফি: হ্যাঁ, সবকিছু মিলিয়ে এটা আমার জন্য খুবই খারাপ একটা বিশ্বকাপ। আমার খারাপ লাগার জায়গার কথা বললে অবশ্যই এই বিশ্বকাপটা। আমার সবচেয়ে খারাপ লেগেছে। এই খারাপ লাগাটা অবশ্যই থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
টিবিএস: বিশ্বকাপ শেষে কী মনে হয়েছে, কোথায় সমস্যা ছিল। বিশেষ করে আপনার ক্ষেত্রে, কারণ এমন টুর্নামেন্ট খুব কমই এসেছে আপনার ক্যারিয়ারে।
মাশরাফি: এমন টুর্নামেন্ট সত্যি আমি কখনও কাটাইনি। দুটি জায়গার কথা বলি। শুরুতে আমারটা বলি। আমি যদি আমার জায়গাটা পূরণ করতে পারতাম, যদি শুরুতে উইকেট এনে দিতে পারতাম বা আমার জন্য যে জায়গাটা, সেটা পূরণ করতে পারতাম তাহলে ভালো। আমি যদি শুরুতে উইকেট এনে দিতে পারতাম, দল অনেক বেশি এগিয়ে যেত।
শুধু একটা চিন্তা করেন আমি যদি পুরো টুর্নামেন্টে এক উইকেটের জায়গায় চার উইকেট বেশি পেতাম, মানে ৫ উইকেট পেতাম কেমন হতো। এর মধ্যে নিউজল্যিান্ডের বিপক্ষে দুটি শুরুর উইকেট আর পাকিস্তানের বিপক্ষে দুটি শুরুর উইকেট। এই দুই ম্যাচে দুটি শুরুর উইকেট নিতে পারলে দল সেমিফাইনালে খেলতো। তামিম যে ৫০ গুলো করেছে, তা যদি এই দুই ম্যাচে হতো, তাহলে চেহারা অন্যরকম থাকতো। ঠিক সময়ে ঠিক জিনিসটা হওয়াটাই আসল ব্যাপার।
টিবিএস: দেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে ত্রিদেশীয় সিরিজ জিতে বিশ্বকাপে গেছেন। বিশ্বকাপে পুরো উল্টো চিত্র। এই অল্প সময়ের মধ্যে এমন উত্থান-পতন, এটাকে কীভাবে দেখেন?
মাশরাফি: ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ পর্যন্ত আমরা রেসে ছিলাম। বিশ্বকাপের আগে একটা বিষয়ে পরিস্কার ছিলাম যে, ১০ পয়েন্ট হলে সেমিফাইনালে উঠতে পারব। প্রথম দিকে দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান সব ম্যাচে হেরে যাওয়ায় নিউজিল্যান্ড ও ইংল্যান্ডের জন্য সুবিধা হয়। এক তরফাভাবে জেতার পরও কিন্তু শেষের দিকে ইংল্যান্ডের ঝামেলা হয়েছিল। দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানের ম্যাচ এদিক-সেদিক হওয়াতে নিউজিল্যান্ড বের হয়ে যায়। যে মারামারি-কাটাকাটি হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি।
শেষের দিকে কয়েকটা দল হারাতে টুর্নামেন্ট উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ পর্যন্ত রেসে ছিলাম। ভারতের বিপক্ষে হারার পরও পাকিস্তানের বিপক্ষে জিতলে আমাদের পয়েন্ট হতো ৯। শ্রীলঙ্কা বিপক্ষে এক পয়েন্ট পেয়েছি। ওই ম্যাচটা হলে আর আমরা জিতলে আমাদের পয়েন্ট হতো ১০। হিসাব ছিল ১০ পয়েন্ট হলে আমরা শেষ চারে যেতে পারব। সেটা হয়নি। আবার শেষ ম্যাচ জিতলে আমরা ৫ নম্বর দল হতাম। পাঁচ নম্বর হলে হয়তো খারাপ লাগা আরও বেশি থাকতো। আরেকটা ধাপের জন্য আমরা সেমিফাইনালে উঠতে পারলাম না, এটা কাজ করতো।
তবে দারুণ একটা জায়গায় থাকতে পারতাম। শেষ দুই ম্যাচ জিতলে দৃশ্য অন্যরকম থাকতো। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অবনমন হয়েছে, তেমন নয়। একটা ভালো অবস্থানে থাকতে পারতাম, সেটা পারিনি, এটা নিয়ে আক্ষেপ থাকবে। সাকিব যা খেলেছে আমাদের টুর্নামেন্ট জেতার কথা। কেউ এমন খেললে টুর্নামেন্ট জেতা উচিত। যেমন যুবরাজ সিং টুর্নামেন্ট জিতেছে। বাকিরা অবদান রেখে গেছে। সাকিবও টুর্নামেন্ট জেতানো পারফরম্যান্স করেছে। কিন্তু আমরা কেউ সাপোর্ট করতে পারিনি।
টিবিএস: নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জিততে পারলে দৃশ্য অন্যরকম হতে পারতো কিনা?
মাশরাফি: ওই ম্যাচটাই ছিল আসল জায়গা। ওই ম্যাচটা জিতলে সবকিছুই বদলে যেতে পারত, এটা সত্যি কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা খুব কাছে গিয়েও ম্যাচটা জিততে পারিনি।
টিবিএস: বিশ্বকাপের মাঝেই আপনার অবসর নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। বিশ্বকাপ শেষে সেটা আরও বেড়েছে। অনেকদিন ধরে চলা এই সময়টায় কীভাবে নিজেকে ঠিক রেখেছেন?
মাশরাফি: আমি এতকিছু আসলে ভাবিনি। একেবারেই ভাবিনি। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করেছি। আল্লাহ আপনার কাছ থেকে যেটা নিয়ে নেবেন, কোনোদিনই আপনি সেটা ফিরে পাবেন না। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই ফিরিয়ে আনার। আবার আল্লাহ আপনাকে যেটা দেবেন, পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই আপনার থেকে কেড়ে নেবে। এটায় বিশ্বাসী আমি। তবে সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতে হবে, যেমন ওই সময় আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। মন যা বলেছে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর কারও সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ভাবিনি। বিসিবি বা নির্বাচক, তাদের কোনো কিছু নিয়ে আমি ভাবিনি। তারা তাদেরটা ভাববে, আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
টিবিএস: একটা টুর্নামেন্ট খারাপ যেতেই এতো কথা, অবসর প্রসঙ্গ তুঙ্গে; তখন মনে হয়েছে কিনা মানুষ পেছেনের কথা ভুলে যায়?
মাশরাফি: এটার মূল কারণ হয়তো রাজনীতি। আমার কাছে মনে হয় রাজনৈতিক একটা বিষয় আছে। আমাদের দেশে অরাজনৈতিক বলে কেউ আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে। সবাই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। অরাজনৈতিক বলে কেউ নেই। সবারই একটা নির্দিষ্ট দল বলেন, পছন্দ বলেন; এটা সবারই আছে। না হলে আপনি ভোট দিতে যেতেন না। ওইটা একটা কারণ বলা যায়।
তারপরও বিশ্বকাপে খারাপ খেলেছি, ওটা নিয়ে অবশ্যই সমালোচনা হতো। রাজনীতি না করে শুধু খেলোয়াড় থাকলেও এই সমালোচনা হতো। কড়া সমালোচনাই হতো। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে যে আমাকে পুশ করা হয়েছে, এটা শুধু বিশ্বকাপ না, রাজনৈতিক কারণ আছে। কারণ এটা বিশ্বকাপের আগে থেকেই হয়ে আসছিল। বিশ্বকাপের আগেই আমাকে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। সেটা পুরোপুরি রাজনৈতিক। বিশ্বকাপের পর যারা সমালোচনা করেছে, আমি তাদেরকে খুবই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। তারা সমালোচনা করতেই পারে। বাকি যাদের কথা বিসিবি বা যারা আছে, তাদের কথা কোনো এক সময় পরিস্কার করে বলব।
টিবিএস: বিশ্বকাপের পর সাকিব আল হাসান বলেছেন, অধিনায়ক পারফর্ম না করলে দলের জন্য কঠিন হয়ে যায়। ওখানেই বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে। আপনি কী মনে করেন?
মাশরাফি: অনেক বড় সত্যি কথা। এর মধ্যে আমি দুটি জিনিস খুঁজে পাই। গত চার-পাঁচ বছরের আমার সফল ক্যাপ্টেন্সি প্রমাণ করে যে আমি পারফর্মার ছিলাম। আর এই বিশ্বকাপে দল সফল নয়, কারণ আমি পারফর্ম করিনি। একটা স্টেটমেন্ট সাকিবের কথায় বোঝা যায়, শেষ ৫-৬ বছর আমি সফল, কারণ আমি পারফর্ম করেছি। বিশ্বকাপে দল ভালো খেলেনি কারণ আমি পারফর্ম করিনি।
ম্যাসেজটা সাকিবই পরিস্কার করে দিয়েছে। বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে যেভাবে এগিয়ে আসতে হয়, আমি সেটা মোটেও করতে পারিনি। তবে অধিনায়ক হিসেবে বাজে সিদ্ধান্ত নিইনি। আমি পারফর্ম করতে পারিনি। কিন্তু দল হারলে আমরা তো কাউকে না কাউকে পিক করি। এটা আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। তো আমাকে পিক করা খুব সহজ ছিল, কারণ আমি পারফর্ম করতে পারিনি। আর কিছু জায়গায় তামিমকে ধরা হয়েছে।
টিবিএস: ড্রেসিং রুমের কথা বাইরে যাওয়া নিয়ে সাকিব বলেছিলেন, দলের কথা বাইরে গেলে দলের মনোবল নষ্ট হয়। সাকিব বলেছেন এটাই যথেষ্ট দলকে পিছিয়ে দেয়ার জন্য। আপনি কীভাবে ভাবেন?
মাশরাফি: আমি বলব ও সত্যি কথাই বলেছে।
টিবিএস: বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে গত বছর অক্টোবরে ধর্মঘটে গিয়েছিলেন ক্রিকেটাররা। আপনাকে জানানো হয়নি এতো বড় আন্দোলনের ব্যাপারটি। ব্যাপারটি কষ্ট দিয়েছে কিনা, কী মনে হচ্ছিল তখন?
মাশরাফি: বিষয়টা আমিও আগেও পরিস্কার করেছি। এখনও বলছি যেকোনো খেলোয়াড় এটা বলতে পারবে না যে তারা আমাকে বিষয়টা জানিয়েছে। ওখানে কয়েকজন এ রকম মিথ্যাচার করেছে যে মাশরাফি ভাই এখন এমপি, উনি আসবে না; কেউ বলছে মাশরাফি ভাই জানে, উনি আসবে না। এমন কথাও বলছে যে, মাশরাফি ভাই ব্যস্ত, উনি ঢাকায় নেই। যখন অনেকে প্রশ্ন করছে মাশরাফি কোথায়, তখন এই মিথ্যা কথাগুলো ওখানে বলা হয়েছে। কেন বলা হয়নি সেটা আমি ভাবতেও চাইনি। তামিম বলেছে যে আমাকে ফোন করেছিলো। হ্যাঁ, করেছে, এটা ঠিক। কিন্তু সে আমাকে বিষয়টি পরিষ্কার করেনি।
এর তিন-চারদিন আগে যখন ওর সাথে কথা হয়, তখন একটা চুক্তি নিয়ে কথা হচ্ছিলো। তারপরও নাকি ও আমাকে ফোন দিয়েছিলো, কিন্তু আমি অনলাইনে ছিলাম না। কিন্তু আমাকে পাওয়া কোনো কঠিন জিনিস না। অনেক প্রয়োজনে অনেকে বাসায় আসে। কিন্তু আন্দোলনের মতো একটা বিষয়ে আমাকে জানানো হয়নি। এটা নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই।
প্রশ্ন করলে অনেক কিছুই করা যায়। আপনারা কেউ তো পজিটিভভাবে প্রশ্ন করেন না, আপনারা বলেন কেন যাননি। কী কারণ ছিলো। তখন কিন্তু শুনতে ভালো লাগে না। তখন তো বলতে হয় কারণ তো একটাই— তারা আমাকে বলেনি। কেন বলেনি সেটা আমি জানি না। কিন্তু মাশরাফি এমপি হয়েছে বলে আসবে না, এমপির সাথে খেলোয়াড়দের কী সম্পর্ক; এই কথাগুলো মিথ্যা ছিলো। ওরাই যখন বিষয়টা বুঝতে পারে না, সাধারণ মানুষের দোষ দিয়ে লাভ কী?
টিবিএস: বাংলাদেশের ভারত সফরে, বিশেষ করে টেস্টে হতশ্রী পারফরম্যান্স কী সাকিব, তামিমের অনুপস্থিতির কারণেই? যদিও পাকিস্তান সফরে তামিম ফিরলেও তেমন পার্থক্য ছিল না। কী মনে হয়?
মাশরাফি: সাকিব যে ফর্মে আছে, স্বাভাবিকভাবেই প্রভাব ফেলতে পারতো। তামিমও বেস্ট খেলোয়াড়। তারা সব সময়ই ভালো খেলে আসছে। এটা সত্যি কথা যে, তাদের একসাথে পারফর্ম করা অনেক বড় ব্যাপার। টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাপারে বলতে পারছি না। কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে অবশ্যই ভালো হতে পারতো।
টিবিএস: মুস্তাফিজুর রহমান যেভাবে এলো, লম্বা একটা সময় খেললো, এরপর ক্রমেই নিম্নমুখী পারফর্ম্যান্স; এমন হওয়ার পেছনে কোনো কারণ খুঁজে পান?
মাশরাফি: মুস্তাফিজ হারিয়ে যায়নি। বরং এটা বলতে পারেন যে, জীবনের রিয়েলিটিতে সে প্রবেশ করেছে। এটাকে হারিয়ে যাওয়া বলা যায় না। ইশান্ত শর্মার একটা উদাহরণ দেই। সে এখন বল যে দিকে খুশি সুইং করাতে পারে। সে টেস্টে ভারতের মূল বোলার। কতো বছর লেগেছে ওর। ১০-১২ বছর খেলার পর সে পিক টাইমে এসেছে। মুস্তাফিজ শুরুতেই খুব ভালো করে ফেলায় আমরা আর ওর খারাপ দিন সহ্য করতে পারছি না।
ওর ক্যারিয়ার মাত্র চার বছর। ওর বয়স মাত্র ২১ বা ২২। একজন খেলোয়াড় সবচেয়ে ভালো সময়ে থাকে ২৮ থেকে ৩২-৩৩ বছর বয়সে। সে জায়গায় আসতে তার আরও ৫-৬ বছর লাগবে। আমাদের চিন্তাটা কী আসলে, সেটাই আমি বুঝি না। ওর কাটারের কথা বলে সবাই, কিন্তু কাটার দিয়ে টেস্টে টিকে থাকা কঠিন। টেস্টে কী করতে হবে, তা সে এখন শিখছে। আমার মনে হয় যে তার এখনও অনেক সময় আছে। তার যথেষ্ট সময় পড়ে আছে। সুতরাং আমাদের এটা নিয়ে অপ্রয়োজনীয় কথা না বলাই ভালো।
টিবিএস: দীর্ঘদিন আপনি পেস বোলিংয়ের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই জায়গা থেকে বাংলাদেশের পেস আক্রমণের ভবিষ্যত কীভাবে দেখেন? যারা খেলছে বা পাইপলাইনে আছেন, তাদের ওপর কতটা ভরসা রাখা যায়?
মাশরাফি: টেস্টে বিষয়টা অনেক চ্যালেঞ্জিং। এটা আমি আগে থেকেই বলছি। রাহি (আবু জায়েদ) খুব ভালো করছে। এটা বলতেই হবে। এবাদতের প্যাশন আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে এখনও আমার মনে হয় টেস্টে আমাদের পেস অ্যাটাক খুবই চ্যালেঞ্জিং সময়ে আছে। আরও দীর্ঘ সময় লাগবে। অনেক কিছু আয়ত্তে আনার জন্য প্রচুর সময় লাগবে। বিষয়টা চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অসম্ভব না। তবে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে আমার পেস আক্রমণ খুবই ভালো। বিশেষ করে সাইফুদ্দিন আসার পর আরও ভালো হয়েছে।
টিবিএস: ক্যারিয়ারের শেষ সময়ে এসে ক্রিকেটকে কী মনে হয়? আপনি সব সময় বলে এসেছেন ক্রিকেটই জীবন না; ক্রিকেট তাহলে কী?
মাশরাফি: একই কথা বলব। এটা একটা ভালো প্রশ্ন। সময়ের সাথে সাথে অনেক চিন্তা ভাবনা বদলে যায়। তারপরও ক্রিকেট নিয়ে আমার চিন্তা আগের মতোই আছে। ক্রিকেট আমার জীবনের অনেক বড় একটা অংশ; তবে এটাই জীবন নয়।
টিবিএস: দুইটা সময় ছিলো আপনার জীবনের, যখন খুব আবেগী হয়ে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটা ছিলো ওয়ানডের অধিনায়কত্ব ছাড়া। কতোটা কঠিন ছিলো?
মাশরাফি: সিদ্ধান্ত তো দুই মিনিটের ভিতরেই নিয়েছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আসলে কোনো কাজই কঠিন না। সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন ছিলো না। ঘুম থেকে ওঠার পর পাপন ভাইকে ফোন দিয়ে বলেছি- আই অ্যাম ডান। পরিবারকে জানিয়েছি। কেন নিয়েছি, সেটা হয়তো এক সময় বলবো।
টিবিএস: টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এবার খেলতে থাকা অবস্থায় ওয়ানডের নেতৃত্ব ছাড়লেন। কোনো যোগসূত্র?
মাশরাফি: আসলে যোগসূত্র নেই, যদি সত্যি বললে বলতে হয় আসলেই নেই। তবে হ্যাঁ, কোনোদিক থেকে মিশালে আপনি অনেক কিছু পাবেন। তো এই উত্তরগুলো আমি পরে আরও খোলাসা করে দিব।
টিবিএস: ২০০৯ সালে সেভাবে অধিনায়কত্ব করতে পারেননি ইনজুরির কারণে। শেষ অংশের অধিনায়কত্ব কতোটা উপভোগ করেছেন? এ সময়ে সেরা ব্যাপারগুলো কী ছিল?
মাশরাফি: এটা আসলে অনেক স্মৃতি। পাঁচ-ছয় বছর কম সময় না, অনেক স্মৃতি। ভালো লাগা-খারাপ লাগা আছে। এর ভেতর উপভোগটাই বেশি করেছি। সে জন্য ক্রিকেট বোর্ড, সতীর্থ, সাংবাদিক, সমর্থকদের ধন্যবাদ। সবাই সাহায্য করেছে, ফলাফল ভালো হয়েছে কারণ কম্বিনেশন ভালো ছিল দলের। দলের প্রত্যেকটা খেলোয়াড় সহযোগিতা করেছে, তাদের মধ্যে একতা ছিল। এই সব কারণেই সম্ভব হয়েছে এবং উপভোগও করেছি।
টিবিএস: আপনার জায়গায় তামিমকে বসানো হয়েছে। ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে তামিমের ভালো করার কতটুকু সম্ভাবনা দেখতে পান?
মাশরাফি: এটা তো আসলে এভাবে বলা যাবে না। আমি যখন শেষবার নিয়েছিলাম, আমি নিশ্চিত কেউ কোনো সম্ভাবনা দেখেনি। কারণ, চোটে পড়ে গেছি। সবার মানসিকতা এমন থাকাটা স্বাভাবিক। আমার নিজেরও কিন্তু সায় ছিল না, অনেকবার সেটা বলেছি। কোনো নিশ্চয়তা নেই, কে কেমন করবে, কে সফল হবে। কিন্তু তার ইচ্ছা, মানসিক শক্তি, তার নিবেদন, দলকে এক করে রাখার ক্ষমতা বা ইচ্ছা, এগুলা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এগুলা যতক্ষণ আছে মনের ভেতর, যদি সে সফল নাও হয় তাকে কৃতিত্ব দিতে হবে।
যেহেতু বললেন তামিমের কথা, সে এখন অধিনায়ক, আমি আশা করি এর আগে যারা সফল হয়েছেন, তাদের চেয়েও বেশি সফল সে হবে। এটা আমি চাই। তামিম অনেক স্মার্ট, সে সব বোঝে জানে। সে খেলোয়াড়দের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিতে পারবে। ওর ওই ক্ষমতা থেকেই ও পারবে। আমি মনে করি, যেটা হয়েছে খুব ভালো হয়েছে। মমিনুল টেস্ট অধিনায়ক, রিয়াদ টি-টোয়েন্টি, আমি মনে করি সব ঠিক জায়গায় আছে। সব ঠিক পথেই যাচ্ছে, ঠিক জায়গায় আছে। আসল কাজ হচ্ছে পারফর্ম করা।
টিবিএস: প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর হাতে বাংলাদেশ কতোটা নিরাপদ? মূল্যায়ন করতে বলা হলে কী বলবেন?
মাশরাফি: ওর কিন্তু আসার পর ৬ মাস হয়ে গেছে। এর মধ্যে ৩ মাস লকডাউনে আছি। কিন্তু এই ৬ মাসে কিন্তু সে বড় কোনো কিছু এনে দিতে পারেনি। এখন আমাদের দেশের ক্রিকেট যে জায়গায় আছে সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করার সময় নয়। এখন সবার সেরাটা দেয়ার সময়, এখন ক্রিকেট বোর্ড বা অন্যরা তাকে নিয়ে কী ভাবছে, আমি জানি না। সেটা ওনাদের ব্যাপার, পরিকল্পনা কেমন সব তাদের ব্যাপার। এখনই ডমিঙ্গোকে নিয়ে গভীর মন্তব্য করব না। আরও কিছু দিন যাক।
টিবিএস: গুঞ্জন আছে, ম্যাচের পরিকল্পনা নিয়ে সেভাবে কাজ করেন না তিনি। দল হিসেবে এটায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে কিনা?
মাশরাফি: আপনারা সব সময় এগুলো দেখেন, বুঝতে পারেন। জিম্বাবুয়ের সঙ্গে ৩টা ম্যাচ খেলেছি, তাও ওর সাথে আমার এমন কোনো কথাই হয়নি যে ওকে নিয়ে আমি ব্যাখায় যেতে পারব। আপনারা যেহেতু সংবাদ সম্মলেন করছেন বা অনেকের সাথে কথা হয় আপনাদের, একটা ধারণা আমার থেকে বেশি আছে। টিম-গেম প্ল্যান করে না এটা এটা কেমন কথা, সব কোচই তো ম্যাচের আগে এসব করেন।
টিবিএস: ক্রিকেটে অনেকের আইডল আপনি, রাজনীতিতেও কাজের মাধ্যমে আইডল হচ্ছেন। অবসরের পর ক্রিকেটের সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন কিনা? থাকলে রাজনীতি ও খেলা কীভাবে সামলানোর পরিকল্পনা?
মাশরাফি: দেখা যাক, আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখুক, সুস্থ রাখুক। ক্রিকেটে আইডল হয়ে কারও জন্য কিছু করতে পারিনি। কিন্তু রাজনীতিতে আইডল হয়ে অনেকের জন্য অনেক কিছু করতে পারবো।