Skip to main content
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
The Business Standard বাংলা

Tuesday
December 16, 2025

Sign In
Subscribe
  • মূলপাতা
  • অর্থনীতি
  • বাংলাদেশ
  • আন্তর্জাতিক
  • খেলা
  • বিনোদন
  • ফিচার
  • ইজেল
  • মতামত
  • অফবিট
  • সারাদেশ
  • কর্পোরেট
  • চাকরি
  • প্রবাস
  • English
TUESDAY, DECEMBER 16, 2025
আঘাতের কথা, কথার আঘাত 

ইজেল

সৈকত দে
10 July, 2021, 09:50 am
Last modified: 10 July, 2021, 03:41 pm

Related News

  • হিটলারের প্রশংসা ও রাজনীতিবিদদের অপমান করল মাস্কের চ্যাটবট গ্রোক
  • ‘পদাতিক’-এ খোদ সত্যজিতের গলার আওয়াজ, এআই দিয়ে বড় চমক সৃজিতের
  • ফরিদপুরে মৃণাল সেনের বাড়ির খোঁজে
  • চালচিত্র এখন: মৃণাল সেনকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন অঞ্জন দত্ত  
  • মৃণাল সেনের এক শ হলো

আঘাতের কথা, কথার আঘাত 

দীপেশ জানাচ্ছেন দুই কুস্তিগীরের ঝগড়ার গল্প- ‘কুস্তি করতে করতে শরীর দুটো এমন মিলেমিশে গেছে যে হাতের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বীর অণ্ডকোষ পেয়ে যেই না তাকে খুব জোর চাপ দিয়েছে এক কুস্তিগির, অমনি তার নিজেরই সদ্য সদ্য কেষ্টপ্রাপ্তি। কারণ শরীর দুটো এমনি বেঁকে- চুরে মিশে গিয়েছিল যে ওই অণ্ডকোষ যে তার নিজেরই সেটাও কুস্তিগির মানুষটি বুঝে উঠতে পারেনি!’
সৈকত দে
10 July, 2021, 09:50 am
Last modified: 10 July, 2021, 03:41 pm

১.
অপমান জিনিসটা সারাজীবন হাড় মাংসের উপর দিয়ে বয়ে যায় যে কোনো সংবেদনশীল মানুষের। যিনি সহ্য করতে পারেন তিনি থেকে যান, সৃজনের শস্যে আরেকটু পূর্ণ হয়ে ওঠে এই ধোঁয়াধুলিবালিগালিমাখা সভ্যতায়। নইলে তিনি অকালপ্রয়াত মেধাবী হন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা-ই ধরা যাক না কেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রহ্মসাধনার ফাঁকে ফাঁকে চৌদ্দটি সন্তানের পিতা হয়েছিলেন। চতুর্দশতমটি জগৎ আলো করে আছে৷ উজ্জ্বল আমাদের মননের জগৎ। ভাগ্যিস, তেরোটির পর আরেকজন সন্তানের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন ব্রহ্মসাধক পিতা!  

ভেবে দেখুন একবার, রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পুজা পর্বের গান আলাদা করা মুশকিল। সুফী কবিদের মতো ঈশ্বর আর  প্রেমিকা এখানে একাকার। গানগুলো একমনে শুনলে আর  শেষ দশ বছরের চিত্রকলার উৎসার দেখলে কোনো অনুভবী শ্রোতা, দর্শকের মনে হতে পারে একজন  মানুষ প্রাণপণে চেষ্টা করছেন অপমানের যন্ত্রণাকে সৃজনশীলতায় রূপান্তর করতে, আরেকটু শমিত হয়ে উঠছেন কেউ। লেখাজীবনের শুরু থেকেই কম অপমানের শিকার হতে হয়নি তাঁকে। নতুন ধরণের গদ্য লিখতে গিয়ে সেসব  পড়ে বোঝার সহিষ্ণুতা না রেখেই তখনকার সমালোচকরা তাঁকে নিয়মিত বিরতিতে অপমান করে গেছেন। 

বাংলা ১৩৮৪ সালের পঁচিশে বৈশাখের পুণ্য লগ্নে প্রকাশিত হলো একটি বই। 'জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দল'। সুজিতকুমার সেনগুপ্ত প্রণীত৷ সেখানে শুরুতেই দেখি – ' সময়টা ১৯২১ খ্রীস্টাব্দ। বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার খবর বিভিন্ন বিদেশী সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্র মারফৎ ভারতে এসে পৌঁছাতে শুরু করেছে। আশ্চর্য চমকে ভরা দিনগুলি৷ এমন তো আগে আর কখনো হয়নি - বলতে কি - কোনো ভারতীয় সাহিত্যিক খোদ ইয়োরোপে যে এতো আন্তরিকতা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সংবর্ধিত হতে পারেন, তা এদেশের মানুষের কল্পনার বাইরে ছিলো।' তারপরেই একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করেন তিনি -  ' ইংলণ্ডে রবীন্দ্রনাথের সম্বর্দ্ধনার খবরে দেখিতেছি- ইংলণ্ডের অনেক সুধী স্বীকার করিতেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও ভাবুক - এ বিষয়ে তাঁহার তুল্য দ্বিতীয় ব্যক্তি জগতের কোন দেশে নাই। আনন্দের কথা নয়? তবে কি না দেশের লোক এতদিন তাহা বুঝিতে পারে নাই। ইদানীং রবীন্দ্রনাথ ভক্তবৃন্দের বগলেই বিরাজ করেন, দর্শন দুর্ঘট। বিস্ময়ের এই যে, দেখিতে দেখিতে জগতের সাহিত্য এত  দরিদ্র - প্রায় দেউলিয়া হইয়া গিয়াছে যে রবীন্দ্রনাথ সর্বশ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইলেন। কোন কোন সুধী এই জগৎব্যাপী কবি জরিপের সার্ভেয়ার ছিলেন, তাহা বলিতে পারি না, যাঁহারা আমাদের ধন্য করিলেন, তাঁহারাই ধন্য।' এই মন্তব্যটি 'সাহিত্য'  সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতির ( ১৮৭০- ১৯২১)।  

১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক সংখ্যা সাহিত্যে মন্তব্যটি করেন তিনি। রবীন্দ্রজীবন ব্যাপ্ত করা যে দ্বেষ, ঈর্ষা ও অপমানের গলিত লাভা বয়ে গেছে, এটি তার ছোটো নমুনামাত্র৷ রবীন্দ্রোত্তর যুগকে রবীন্দ্র- ধুত্তোর যুগ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছিলো। কৃত্তিবাস যুগে লেখা হয়েছিলো- 'তিন জোড়া পায়ের লাথিতে লুটিয়ে পড়ে রবীন্দ্র রচনাবলী।' পাকিস্তানীরা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করতে চেয়েছিলো, তার ধারাবাহিকতায় প্রায়ই স্বাধীন বাংলাদেশেও রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকারের চেষ্টা আমাদের চোখে পড়ে৷  এ বড়ো লজ্জার৷ আবার পেছনের ইতিহাসে গেলে দেখি – ' আমার ত মনে হয় আজকাল গুরুদেবের বিরুদ্ধে যাই লিখুন না কেন তার একটা মূল্য আছে- আশ্রমের মোহান্তদের সমালোচনা সর্বদাই ভালো।' বন্ধু বুদ্ধদেব বসুকে ৫.১০.৩৮ তারিখে লিখছেন সমর সেন। আরেকদিক থেকে সমর সেন যখন সমমনা কবিবন্ধুদের নিয়ে রবীন্দ্রদর্শনে গেলেন তখন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠিতে আমরা স্নেহপরায়ণ কবির দেখা পাচ্ছি – 

'কল্যাণীয়েষু, সমর সেদিন তোমরা কবির দল এসে খুসি হয়ে গেছ শুনে আরাম বোধ করছি। তোমরা আতিথ্যের যতটা প্রশংসা করেচ তার যথোচিত কারণ খুঁজে পাচ্ছিনে। অল্পে খুশি হবার শক্তি যদি তোমাদের থাকে সে একটা দুর্লভগুণ বিশেষত বাংলা দেশে৷ আমাকে বোধ হয় আগে থাকতেই তোমরা দুর্ধর্ষ দুর্জ্জন বলে কল্পনা করে এসেছিলে তারপরে যখন দেখলে মানুষটা নেহাৎ আপত্তিজনক নয় কেবল দোষের মধ্যে যার তার সঙ্গে হাসি তামাসা করে থাকে, বয়স বিচার করে না, তখন নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছিলে।... ঢুঁ খেয়েছিলে প্রশান্তের কাছে, তর্কের যোগ্য শিকার পেলে সে রেয়াৎ করে না - আমি হাসি, তর্ক করিনে। তোমাদের লেখায় "হালকা"  কথাটা অত্যন্ত বেশি ব্যবহার করে থাকো, হালকা ঝড়, হালকা হাতি, হালকা ঢেউয়ে নৌকাডুবি, ইত্যাদি, আমার সম্বন্ধে গদ্য কবিতা যদি লেখো তবে ঐ হালকা বিশেষণটা সহজে ব্যবহার করতে পারবে৷ ১৭ই বৈশাখ ১৩৪৫। ইতি তোমাদের কবি অগ্রজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।' 

এই চিঠিতে আমরা দেখছি, রবীন্দ্রনাথের হৃদয়ের দিকটা। 'তর্কের যোগ্য শিকার' পেলে তিনি তর্ক করেন না হাসেন।  একই  রবীন্দ্রনাথ কিন্তু স্পেনের অলোকরঞ্জন কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথ ও তাঁর স্ত্রীর একাধিক সহৃদয় পত্রের কোনো জবাব দেন না৷ অথচ হিমেনেথ তখনই বেশ পরিচিত নাম। তাঁরা এমনকি জানতে চাইছেন ডাকঘর নাটকের ঘন্টাধ্বনির কোনো বিশেষ ভারতীয় ধরণ আছে কি না, তিনি নিরুত্তর থাকেন৷ অবাক লাগে, অজস্র তুচ্ছ চিঠির উত্তরও তিনি বেশ জমিয়ে লিখছেন তখন৷ জীবনানন্দের প্রতি রবীন্দ্রপত্র তো ইতিহাস হয়ে ওঠে – 'চিত্ররূপময়' শব্দে।  হিমেনেথ ও জীবনানন্দের প্রতি সুবিচার করেন নাই রবীন্দ্রনাথ, প্রাণস্পর্শের বাসনার  চিঠিতে নিরুত্তর থাকা এক ধরণের অপমান বৈকি। আবার নিবিষ্ট জীবনানন্দ গবেষক, জীবনানন্দ অনুসন্ধান যার জীবনব্যাপী কাজ, গৌতম মিত্রের দুই খণ্ডের বই 'পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে' পড়লে জীবনানন্দের সারা জীবন জুড়ে পাওয়া দগদগে অপমানগুলো আমাদের সামনে ভেসে ওঠে অন্য আরো অনেক তথ্য ও ইতিহাসের সাথে সাথে। 

২.
এইবার অন্য প্রসঙ্গে যাই। আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেনের ছোট ছেলে অধ্যাপক অরুণ সেন, কবি সমর সেনের বাবা, পৃথিবীর দার্শনিকেরা ধরাধামে আবির্ভূত হয়ে কে কি বলেছেন, সেটা তিনি শারীরিক ভাবে প্রদর্শন করতেন। যেমন বলতেন, 'হেগেল কেম'  বলে দুবার মাথা চাপড়াতেন, তারপর বলতেন, 'অ্যান্ড হি সেড, দিজ ওয়াজ অল!' মানে হেগেল বলেছেন, মাথা বা মন-ই হল সব, আর কিছু নেই। তারপর বলতেন রুশোর কথা- 'রুশো কেম' বলে তিনি তিনবার বুক থাপড়াতেন, 'অ্যান্ড হি সেড, দিজ ওয়াজ অল!' অর্থাৎ রুশোর মতে, হৃদয়-ই সব, আর কিছু তার ধারে কাছে আসতে পারেনা। তারপর আসতো মার্ক্সের কথা। তখন তিনি পেটে তিনবার থাবড়া মারতেন, মেরে বলতেন,'অ্যান্ড হি সেড, দিজ ওয়াজ অল।'

মার্ক্সের মতে, খিদেটাই সব, বা খিদের জন্যই সব কিছু। অন্নই ব্রহ্ম। সব শেষে পৌঁছতেন বিশ শতাব্দীর গোড়ার মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডে। তাঁর সম্পর্কে অরুণ বাবুর অতটা আবেগ থাকতো না। হাত টাতের ব্যবহার করতেন না। বলতেন, 'অ্যান্ড ফ্রয়েড কেম', তারপর একটু থেমে স্বর নামিয়ে বলতেন,'হি ওয়েনট ইভেন ডাউনওয়ার্ডজ'। অর্থাৎ ফ্রয়েড পেটের আরও তলার দিকে নির্দেশ করেছিলেন। পবিত্র সরকারের একটি কলাম থেকে এইটুকু জেনে আমাদের আনন্দ হয় আবার তাঁর সুপুত্র সমর সেনের চিঠিপত্র পড়ে আনন্দের পাশাপাশি বিস্ময়ের কমতি হয় না। এ কোন সমর সেন, যিনি বাংলা কবিতার একজন  বরপুত্র অথচ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও অতি অল্প কবিতা লিখেছেন৷ সাহিত্যিক অসীম রায়কে কবিতা না লেখার কারণ জিজ্ঞাসার উত্তরে জানাচ্ছেন,'আমি তো এখন টি এর মাথা কাটি।' অর্থাৎ প্রুফ দেখেন, কেন না তখন তিনি ফ্রন্টিয়ারের মেধাবী সম্পাদক। এবার সমর সেনের চিঠিপত্রের দিকে তাকানো যাক। এক জায়গায় লিখছেন,'সুকান্ত কি মহাকবি? আমার কল্পনা ও বোধশক্তি এত  কমে গিয়েছে যে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারি না।'  

বিষ্ণু দে-কে ৮.১০.৩৮ তারিখের চিঠিতে লিখছেন, চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনার কথা আর  সেই সূত্রে একটু ঠুকে দিচ্ছেন জীবনানন্দ দাশকে – 'মফস্বলের কোনো কলেজে চাকরী পেলে শুষ্কপ্রায় কবিপ্রেরণা জীবনানন্দবাবুর মতো আবার চাগিয়ে উঠবে বোধহয়। তখন বরিশাল-বাসী জীবনানন্দবাবুর মতো অন্তঃপ্রেরণা ভোরের শালিকের মতো আবার বুকের মধ্যে বাসা বাঁধবে, কীটপতঙ্গকে নিরন্তর দার্শনিক প্রশ্ন করব, সাদা ঘোড়ায় চেপে নক্ষত্রলোকে যাওয়ার বন্দোবস্তও হবে।...' আবার রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র সাহিত্যিক, সঙ্গীত সমঝদার ধূর্জটিপ্রসাদের মতামত নিয়ে আবারো বিষ্ণু দে-র কাছেই – 'ধূর্জটিবাবু আজকাল আবার সমালোচনার নামে সুধীন্দ্রনাথের চর্চা শুরু করেছেন৷ বাংলা কবিতা=সুধীন্দ্রনাথ; সুধীন্দ্রনাথ=ভারতীয় ঐতিহ্য। ভাট্ পাড়া ও লক্ষ্মৌ - দুয়ের সমন্বয় বড়োই বিচিত্র৷ তারপর রবীন্দ্রনাথ আবার তাঁকে কী যেন করার ভার মৃত্যুর পূর্বে দিয়ে গেছেন৷ কলেজে ছেলেরা প্রায়ই একটা লাইন আওড়াতো, সেটা মনে পড়ছে; কত ঢংই দেখালি খেঁদি, অম্বলে দিলি আদা।' রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের অল্প কয়েক মাস পর নভেম্বরের পনেরো তারিখ এই রচনার তারিখ৷ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় লোকায়ত দর্শনের গুণী গবেষক, সাহিত্যিক সমর সেনের বন্ধুস্থানীয় ছিলেন৷ টাকাপয়সা আসলে কিছুই নয়, সেই কথাটা বোঝাতে গিয়ে লিখছেন-

'টাকা ব্যাপারটা মশাই কিসসু নয়। অবশ্য কবিতা, গান ইত্যাদিও কিসসু নয়। আসলে কিছুই কিসসু নয়৷ সবচেয়ে জরুরী জিনিষ হচ্ছে সকাল বেলায় কোষ্ঠ পরিষ্কার করে পাইখানা, রাত্রে ঘুম... অফিসে সাহেবের সোনা বাঁধানো দাঁতে হাসি, আর মাঝে মাঝে তরল সান্ত্বনা। এসব যদি ভালো না লাগে তাহলে কম্যুনিস্ট হয়ে যেতে পারেন৷ আমার মাঝে মাঝে ভয়ানক ইচ্ছে হয়, কিন্তু মাত্র ৩৫-এ চলবে না।'

শেষ দু লাইনে নিশ্চয়ই তখনকার কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিচ্যুতি বিষয়েই শ্লেষ করছিলেন সমর সেন৷ কোষ্ঠকাঠিন্যজনিত সমস্যার কথা আরেকভাবে ফিরে আসছে বন্ধু দেবীর কাছেই কবিতা লিখতে পারা না পারা নিয়ে বলতে গিয়ে, সাতান্নের ছাব্বিশ অক্টোবর, ' মাইরি বলছি এখানে এসে কোন কবিতা লিখিনি, সংসারের যা ঝামেলা আর যা শীত।  তাছাড়া 'ভালো'  কবিতা যখন লিখতাম তখন কোষ্ঠকাঠিন্যের যুগ এখন রোগটা প্রায় সেরে গিয়েছে, তাই লেখা আসে না৷ সুভাষ আবার ঘন ঘন ভালো কবিতা লিখছে শুনে চিন্তিত বোধ করছি৷ গীতার প্রেমে পড়েছে না কি? না কোষ্ঠকাঠিন্যে ভুগছে? ' উল্লেখ্য, সুভাষ মানে সুভাষ মুখোপাধ্যায় আর  গীতা তাঁর যাপনসঙ্গী। সমর ভাবছেন, প্রেম আর  কোষ্ঠকাঠিন্য কবিতা লেখা না লেখার প্রভাবক। 

সস্ত্রীক সুভাষ মুখোপাধ্যায়

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ফেসবুকের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত সেই যুগেও বড়ো মানুষেরা নিজেরা নিজেরা আমাদের প্রজন্মের কবি সাহিত্যিকদের মতো খোঁচাখুঁচি করতেন চিঠিতে। 

৩.
বন্ধুর চিঠি বন্ধুকে। দীপেশ চক্রবর্তী আর রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেইল চালাচালির নির্বাচিত ইতিবৃত্ত। উপহার পেয়েছিলাম বন্ধু সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে৷ সেখানে রাঘব লিখছেন, "ফুকোর দৌলতে বাঙালি ইন্টেলেকচুয়ালরা দেহ চিনেছে৷ ভুলে গেছে বাউলের দেহতত্ত্ব, ভারতচন্দ্রের যৌনতা- এখন বাংলা ব্যান্ড তা সরবরাহ করছে এইভাবে, 'সকালে ভাত খাব না, রাতে রাত আমায় খাবে।' সেক্স জিনিসটা, প্রেমিকাকে সম্বোধনের এই ভাষাটা অন্তত বাংলা ভাষা নয়৷ এই অর্থে যে, একটা ভাষার এক- এক ধরণের চলন থাকে। ভাব থাকে। ওই ভাবটাকে বাদ দিয়ে ভাষাটাকে ভাবাই যায় না।" আর দীপেশ জানাচ্ছেন দুই কুস্তিগীরের ঝগড়ার গল্প-  'কুস্তি করতে করতে শরীর দুটো এমন মিলেমিশে গেছে যে হাতের কাছে প্রতিদ্বন্দ্বীর অণ্ডকোষ পেয়ে যেই না তাকে খুব জোর চাপ দিয়েছে এক কুস্তিগির, অমনি তার নিজেরই সদ্য সদ্য কেষ্টপ্রাপ্তি। কারণ শরীর দুটো এমনি বেঁকে- চুরে মিশে গিয়েছিল যে ওই অণ্ডকোষ যে তার নিজেরই সেটাও কুস্তিগির মানুষটি বুঝে উঠতে পারেনি!'

দীপেশ চক্রবর্তী

পথের পাঁচালী আর  তেরো নদীর পারে দুটি চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে  রাঘব দীপেশকে লিখছেন – 'বাংলা ফিল্মে নিউ রিয়্যালিজম সত্যজিৎ পথের পাঁচালীতে প্রথম আনলেন বলে একটা প্রচার আছে, সবাই সেটা মানেন। পথের পাঁচালী নিশ্চয়ই, নিঃসন্দেহে একটা মহৎ ছবি৷ কিন্তু বাংলা ফিল্মে ক্যামেরা প্রথম সম্পূর্ণরূপে স্টুডিয়োর বাইরে একটা গোটা ছবি জুড়ে কাজ করে বারীন সাহার তেরো নদীর পারে ছবিটিতে।...  বারীন সাহার ছবিকে প্রশংসা করার জন্যে সত্যজিৎ রায়কে ছোটো করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷ সত্যজিৎবাবু প্রশংসা না-করলে সে-ছবি অত্যন্ত উঁচু মানের ছবি হিসেবে বাঙালির কাছে কোনো স্বীকৃতি পাবে না - অবস্থা তখন এ-রকম। মানে মিড সিক্সটিজের কথা হচ্ছে। এখন বারীনদা সত্যজিৎ রায়কে আলাদা করে নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করে আসেননি ছবিটি দেখার জন্যে - তাই তিনি উপহার পেলেন একটা শক্তপোক্ত স্তব্ধতা। আমি তোমাকে মূর্ত উদাহরণ দিলাম আমাদের এখানকার বৈঠকি সংস্কৃতির। যা আজও বহমান।'

এই নীরবতার ষড়যন্ত্র, যুগে যুগে প্রবহমান, অসংখ্য ভালো বই, সিনেমা এইসব গন্ডগোলের মধ্যে পড়ে প্রচার পায় না। পেতে পারে না৷ সেই রবীন্দ্রকালে সবাই যখন গুরুবাদে মুখর আর  কবিগুরু নির্বিচারে সার্টিফিকেট বিলোচ্ছেন তখন আমরা দেখি ঋজু একজন মানুষ, জগদীশ গুপ্তকে। ঠাকুরবাড়ি থেকে হাঁটা দূরত্বে থাকলেও কোনোদিন সার্টিফিকেটের লোভে যাননি৷ এখনো সমাজের কেষ্ট বিষ্টুদের ফ্রি বই না দিলে সে বই হারিয়ে যেতে থাকে নিয়মিত ভাবে।

জগদীশ গুপ্ত

দীপেশ দুঃখ করে বলছেন, 'এখন মানুষে-মানুষে দেখা হলে 'সত্যের' খাতিরে আগের রাত কারও সঙ্গে শুয়েছিল কি না, এটা জানতে চাওয়া কুশল জিজ্ঞেস করার একটা অংশ হয়ে দাঁড়াবে।' মৃণাল সেন এবং আরও কয়েকজন 'মানুষের' লেখকের কথা বলতে গিয়ে রাঘব লিখছেন বন্ধুকে, দুই হাজার পাঁচের নয় ফেব্রুয়ারি - 'দীপেশ, মৃণাল সেন এবং বেশ কিছু লেখক নিম্নবর্গের মানুষের প্রতি একটা মমতা একটা কনসার্ন প্রকাশ করেন সেটা নিশ্চয়ই খুব ভালো ব্যাপার।

মৃণাল সেন

আজকাল আমার আর  একটা জিনিস মনে হয় - ওইভাবে দেখতে গিয়ে আমরা অনেক সময় সমবেদনা জানাতে গিয়ে মানুষগুলোকে আরও ছোটো করে ফেলি না তো। কথাটা এইজন্য বললাম এই মানুষরা বঞ্চিত নিশ্চয়ই কিন্তু সেটা কি এঁদের একমাত্র পরিচয়। এঁরাও তো স্বপ্ন দেখেন, শিল্পরসিক, জীবনের সম্পর্কে এঁদের কাছেও অনেক শিক্ষণীয় জিনিস আছে - সেসব বাদ দিয়ে মানুষগুলোকে শুধু শোষিত বঞ্চিত করে দেখা ও দেখানোর মধ্যে কোথায় একটা কষ্ট হয়। যেন এঁদের কোনো দেশ নেই,  সভ্যতা নেই, স্মৃতি নেই। আমার মনখারাপ করে৷ লজ্জা করে, এজন্য যে মনে হয় আমিও এঁদের ওইভাবেই হয়তো এঁকেছি অনেক গল্পে। ভুল বললাম কী।... '

৪.
১৯৯৬ সালের তেসরা এপ্রিল 'এবং জলার্ক' পত্রিকা ঔপন্যাসিক, গল্পকার অসীম রায়ের আড়াইশো পৃষ্ঠার বেশি দিনপঞ্জী পাঠকের সামনে নিয়ে আসে। পাতায় পাতায় লেখকের বই পড়ার, নিজের লেখার, সমাজের বদল আর নিত্য নতুন চলনের বিবরণ এবং ব্যক্তি অসীমের যা বৈশিষ্ট্য অতুলনীয় শ্লেষ৷ একটা এন্ট্রির টুকরো দেখি – 'সাম্প্রতিক বাঙালি কবিদের নিয়ে একখানা সমালোচনার বইয়ে সুধীন্দ্র দত্তকে বলা হয়েছে বাংলার এলিয়ট, বিষ্ণু দে পল এলুয়ার, বুদ্ধদেব বসু বদেলিয়ার আর  জীবনানন্দ দাস র্যাবো, এভাবে ভাগাভাগি চলতে থাকলে আর দশ পনেরো বছর পরে আমাদের জন্যে আর কোনও ইউরোপীয় লোক অবশিষ্ট থাকবে না।' আমার শহর চট্টগ্রামে বছর আঠারো উনিশ আগে 'বাংলার সক্রেটিস' উপাধি বিতরণের হিড়িক পড়েছিলো এক অধুনালুপ্ত মাসিক পত্রিকার তরফে। প্রথমে হয়েছিলেন অধ্যাপক  হুমায়ূন আজাদ। তারপর একটি দৈনিকের আবাসিক সম্পাদক৷ কিছুদিন পুরাণ পাঠের সৌজন্যে জেনেছিলাম, দেবরাজ ইন্দ্র কোনো ফিক্সড লোক নন, এটা একটা পোস্টের মত,  নানাজন কালে কালে হন। সক্রেটিস প্রসঙ্গে এই কথাটা মনে আসাতে নিজে নিজে হেসেছিলাম। 

যামিনী রায় ও বিষ্ণু দে

বাংলা সাহিত্যের দুরন্ত যুবক ছিলেন দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যাল। 'অচলপত্র' সম্পাদক। ট্যাগলাইন - ছেলেদের দুধ গরম করার একমাত্র মাসিক৷ শুরু থেকেই আক্রমণাত্মক তবে অগ্রজ 'শনিবারের চিঠি'-র মতো বিষাক্ত আক্রমণ নয় বরং তুলনামূলক নির্মল। আমরা এখন কিছু উদাহরণ দেখবো পরপর। তারাশঙ্করকে খুঁচিয়ে লিখছেন – 'কেনে'  লিখলেই যে লোকে এখন বই কেনে। আবার নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছিলেন –

'এই কংগ্রেস কর্মীটি রাঢ়ের খররৌদ্রে মাইলের পর  মাইল পায়ে হেঁটে দেশকে দেখবার সুযোগ পেয়েছেন, মেলার বটগাছতলায় খড়ের বিছানায় শুয়ে জীবনকে বুঝতে চেয়েছেন।' দীপ্তেন্দ্রকুমারের সরস উত্তর – 'খররৌদ্রে মাইলের পর মাইল ঘুরলেই যদি সাহিত্যিক হওয়া যেত, তাহলে তো প্রত্যেক জীবন - বীমার দালালরাই তা হত। সৃষ্টির জন্য যা প্রয়োজন তা প্রতিভা,  নর্দমার ধারে শুয়ে থাকা নয়।

'ক্যালকাটা কেমিকেল' একবার মারাত্মক একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ একাধিক লেখকের রচনায় ভর করে ব্যবসা বাড়াবার বুদ্ধি এঁটে নরেন্দ্র দেবকে সম্পাদক করে এক সংকলন প্রকাশ করেন কর্তৃপক্ষ৷ বিশ্রী রকমের বদ বুদ্ধিটা টের পাওয়া যাবে বিভূতিভূষণের 'বুড়ো হাজরা কথা কয়' গল্পের সূত্র থেকে৷ ঐ গল্পের গ্রাম্য বউ কিছু স্ত্রী রোগের শিকার হয় যার জন্যে আর দৈবের আশ্রয় নয় এসে গেছে ক্যালকাটা কেমিকেল নিবেদিত ঔষধ।

প্রতিবাদে ক্ষিপ্ত দীপেন্দ্রের কলম চিৎকার করে উঠেছিলো -  'পৃথিবীর কোথাও নিজের দেশের সাহিত্য ও সাহিত্যিককে কেউ এভাবে অপমান করতে সক্ষম হয়েছে কি না, আমাদের জানা নেই৷ 'বুড়ো হাজরা কথা কয়' - এর মতো গল্পের এই লেজুড় যিনি জুড়তে পেরেছেন, তার নিজের লেজ থাকা এমন কিছু  অসম্ভব নয়। সেই লেজের মুখে আগুন লাগিয়ে তিনি কাদের মুখ পোড়াচ্ছেন, এটা একবার ভেবে দেখবেন কি?' 

একবার পঞ্চাশের এক কবির কবিতায় দুটি লাইন নিয়ে কথা বললেন। লাইন দুটি : 'তোমার বাহুর উপাধানে শুয়ে/ পেয়েছি পরম শান্তি।' তিনি লিখলেন – 'এ- সমস্ত কথা চিত্রাভিনেত্রী দেবযানীকে লক্ষ করে কি না আমরা জানি না। কিন্তু এটুকু জানি, উপাধান নরম না হলে তাতে শুয়ে শান্তি পাওয়া যায় না এবং যে - কোনো মেয়ের বাহুতেই হাড়ের পরিমাণ যথেষ্ট৷ হাড়ের বালিশে শুয়ে যে শান্তি পায় তার মাথায় নিশ্চয়ই গবেট পাথরের গুদোম আছে। কিন্তু উঁহু, চিত্ত ঘোষের মাথা সে-রকম নয়; যেহেতু ঐ কবিতার মধ্যেই আছে: ভ্রান্তি আমায় ক্ষমা কর দেবযানী। তার মানে বাহুর উপাধানের কথাটা একটা ভ্রান্তি। শক্ত বাহুর বদলে নরম কোন্ জায়গাটাকে উপাধান বানিয়ে শুয়ে উনি পরম শান্তি পেয়েছিলেন এই আসল  কথাটা কিন্তু চিত্ত ঘোষ বেমালুম চেপে যাচ্ছেন।' 

অচলপত্রে একবার ছেপেছিলেন - আগামী সংখ্যায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার বঙ্গানুবাদ ছাপা হবে। আরেকবার নরেশ মিত্র সম্পর্কে লিখে বসলেন –'গাধায় ও ঘোড়ায় মিলিয়ে খচ্চর হয়। কিন্তু নরেশ মিত্রকে খচ্চর বললে খচ্চর জাতির অপমান হয়।' মামলা করলেন নরেশ মিত্র। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর হেরে ভূত দীকুসা। আদর করে দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের নাম দিয়েছিলো অচলপত্র পাঠকেরা। পত্রিকায় প্রথম পাতায় মুদ্রিত অক্ষরে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন-  'শ্রী নরেশ মিত্রের কাছে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইছি। তাঁকে খচ্চর বলব না। এমনকি খচ্চরকেও আর খচ্চর বলব না।' এমন সরস ক্ষমা প্রার্থনায়, আমার বিশ্বাস, স্বয়ং নরেশ মিত্রও হেসেছিলেন। সে সময়ের মানুষদের উইট আর  সেন্স অফ হিউমার তো ছিলো আকাশ ছোঁয়া।

৫.
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার সাথে অতি শৈশবে পরিচিত না হলে আমার জীবন হয়তো অন্য রকম হতো। ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় আমাদের শহর চট্টগ্রামের বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের চতুর্থ তলায় একটি বইমেলা হয়। সেখান থেকে বাবা কিনে দেন দেবসাহিত্য কুটিরের অদ্ভুত ঘি রঙের কাগজে ছাপা 'সোনার ঝাঁপি' গল্প সংকলন। ঐ বয়সে শুধু নয়, এখন প্রায় চল্লিশে এসেও মনে হয় এমন বই হয় না। বাংলা সাহিত্যের এক ও অদ্বিতীয় কল্পনাপ্রবণ কিশোর সাধু কালাচাঁদের সাথে পরিচয় ঘটলো। প্রথম গল্পেই শ্যামল লেখেন – 'ঘরে বাইরে কালাচাঁদের এখন এত  সুনাম - কেউ আর তাকে এমনিতে কিছু দেয় না৷ যা দেয় - তার নাম মার।'
আর প্রায় শেষ দিকে –

'তারপর মারা থামিয়ে হঠাৎ কালাচাঁদকে বললেন, তুই এমন করিস কেন বলত? এমনিতে তো তুই খুব ভালো ছেলে। কোনোরকম অসভ্যতা নেই৷ তবু নিঃশব্দে এমন এক- একটা কাজ করে বসিস৷ কেন? কেন বলতে পারিস?
 
কিছু না করে চুপ করে থাকতে পারি না স্যার। 
তাই বলে এসব করিস?
ওসব তো সবাই করে।
ইতিহাস স্যার বললেন, ওসব মানে?

এই পড়াশুনো। ভালো রেজাল্ট। ফার্স্ট সেকেন্ড - মজা কোথায় স্যার? আমি বোধ হয় ওসব পারতাম না স্যার। বেশ আছি ৷ একটা কিছু করলাম। মারলেন আপনারা। মারা হয়ে গেল তো ফ্রি হয়ে গেলাম- ব্যস। আবার নতুন করে।'

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

এই কথোপকথন অল্প বয়সেই আমার মধ্যে জন্ম দিয়েছিলো এক  নিরাসক্তির। যাবতীয় অপমান কিংবা মারধোরের মধ্যে থেকে বাঁচার উপায়। তা হলো,  কল্পনার মধ্যে তলিয়ে যাওয়া। যেমন, কালাচাঁদ পরীক্ষা হলে উড়ন্ত প্রজাপতির মধ্যে দেখতে পায় প্রশ্নপত্রের আত্মাকে। তার স্বপ্নে নেমে আসেন, খোদ যদুনাথ চক্রবর্তী, গণিতের কিংবদন্তী। কিংবা খুলনার ভৈরব রূপসা নদী পেরিয়ে আফ্রিকার কিলিমানজারো পর্বতে গিয়ে সাধু হয়ে আস্তানা গাড়া তার ঘুমেই সম্ভব। তখন স্কুলের বড় দাদা তার কাছে যায়, ছেলেদের কাছ থেকে টিফিন কেড়ে খেতো বলে সে ইংরেজি বর্ণমালা ভুলে যাচ্ছে। দাদার সাথে কালাচাঁদের বাবা আর  স্কুলের হেড স্যার। এসব আসলে শ্যামলের নিজের ছেলেবেলার নানা রকমফের৷ তিনি বলছেন এক জায়গায় -

'অপমান আর প্রত্যাখ্যানের কড়া রোদ যত পিঠ পুড়িয়ে দিত ততই জেদ বাড়ত। জেদ বাড়লেই লেখা ভালো হত। আমার তো কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই। না পরিবার না কোনো ক্ষমতাশালী সম্পাদকের প্রশ্রয় না কোনো পেটোয়া প্রকাশক, যিনি যা খুশি লিখি না কেন বই করে ছেপে দেবেন। আমি জানতাম লিখে আমাকে এইসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হবে। আমি লিখতে পারি। অনেকের তুলনায় অন্য রকম লিখতে পারি। লিখে সবার মুখের ওপর জবাব দেব। তাই আমাকে হরেক রকমের লেখা হরেক পত্র-পত্রিকায় লিখতে হয়েছে। কোনও ছুঁৎমার্গ রাখিনি। কবে কোন বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিকের মাননীয় সম্পাদক লিখতে বলবেন তার জন্য কলমের কালি শুকিয়ে রাখিনি। তাই হয়তো অনেক লিখতে হয়েছে। লিখতে লিখতে পিঠ বেঁকে গেছে। সব লেখা হয়তো সমান উতরোয়নি। অর্থনৈতিক পারিপার্শ্বিক আর একটু থিতু হওয়ার সুযোগ পেলে হয়তো লেখাগুলো আরও ইমপ্রুভড হত।    

আমার বন্ধুরা বড়ো ক্লাবের জার্সি পড়ে স্বনামধন্য কোচের নির্দেশে মাঠে খেলবে আর  আমি সাইডলাইনের পাশে বসে দেখব, এ অপমান সহ্য করতে পারিনি। তাই জার্সি যাই হোক না কেন, মাঠ যেমন তেমন হোক, আমি খেলা বন্ধ রাখিনি। অনামী ছোট স্কুলের ভালো ছাত্রের ভালো রেজাল্ট যেমন লোকের চোখে পড়ে না,  আমার লেখাগুলোর ভাগ্যেও তাই জুটেছে। ভালো পাঠকের চোখ এড়িয়ে গেছে। আমি দমিনি। মেনে নিয়েছি এই আমার ভবিতব্য। সময় লাগবে। তবে এও জানি, সময়ের জিনিস সময়ে না হলে তার আর তেমন স্বাদ থাকে না। ' 

আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়ে আসলেন যখন তিনি মধ্যবয়সী। আয় করা দরকার কেন না পরিবার৷ তিনি অদম্য৷ পর পর প্রকাশিত হতে লাগলো লেখা আর বই। 'অদ্য শেষ রজনী' উপন্যাসের প্রকাশ আনন্দ বাজার পরবর্তী ঘটনা। আনন্দ বাজার কেন শুধু কোনো বড়ো পত্রিকাই কিংবা বিগ বাজার যে নীরবতা দিয়ে সত্যিকারের ভালো লেখাটিকে চেপে রাখতে পারে না তার জ্যান্ত প্রমাণ শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় আর শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় আর কায়েস আহমেদের মতো লেখকরা। তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাস, গল্পসংকলন অনেকদিন ধরে প্রকাশিত হয়েছিলো অনামী প্রকাশনা থেকে।  জীবনের শেষ দিকে আনন্দ তো আর তাঁকে বাদ দিতে পারলো না। শাহজাদা দারাশুকোর মত বাংলা সাহিত্যে অপূর্ব বই লিখে অকাদেমি পেলেন।

সেসব নিয়েও শ্যামলের স্যাটায়ার আছে৷ দেখা গেলো, বাড়ির কাজের লোককে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বললেন তোকে অকাদেমি দিলাম কিংবা একশ টাকা দিয়ে বলা, এই নে জ্ঞানপীঠ। 'হাওয়া গাড়ি' উপন্যাসটি সুবৃহৎ। ন্যাশনালাইজড কোল কোম্পানির দিলীপ বসুর জবানিতে, কয়লা সংস্থার ইতিহাসের মোড়কে তিনি আনন্দবাজার পর্বের কথা-ই লিখে গেছেন। অপমানের এমন সপাট জবাব বাংলা সাহিত্যে দুষ্প্রাপ্য। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'অর্ধেক জীবন' যখন দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ পেতে শুরু করে, প্রথম কিস্তিতে শ্যামল একটি দু পৃষ্ঠার গদ্য লেখেন – 'তুই পারবি' – শিরোনামে, বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা, ইতিহাসবোধ ঐ দুই পৃষ্ঠায় উজ্জ্বল৷ ঐ দুই পৃষ্ঠা অবশ্য ওখানেই থেকে গেছে। বাংলাদেশে তসলিমা নাসরিন সংক্রান্ত দেশ পত্রিকার এক সংখ্যা নিষিদ্ধ হয়। প্রচ্ছদ শিরোনাম - বন্য গোলাপের সুগন্ধ। আশ্চর্য এক  হৃদয়স্পর্শ করা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শ্যামল আর শ্যামলের মৃত্যুর পর তসলিমা নাসরিন তাঁর এক কলামে, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অশ্লীল অভিযোগ আনেন, মি টু ধরণের। এই হলো শ্যামল। অপমান দিয়ে জোড়া জীবন ও মৃত্যু। গালিবের মতো, সফল প্রায় সকল উর্দু ভাষার লেখকের ব্যক্তিজীবনের মতো, অক্ষরের জোরেই তাঁরা প্রত্যেকে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছেন৷

৬.
বঙ্গীয় ভূখণ্ডে ফেসবুকের শুভ (?) আবির্ভাবের পর অপমান, অসহিষ্ণুতা ছেলের হাতের মোয়া হয়ে গেছে ৷ এর সবচেয়ে বড়ো শিকার সেলেব্রিটি অভিনেত্রী কিংবা খেলোয়াড়দের ফেসবুক পেজ৷ যৌন অবদমনের শিকার বঙ্গীয় যুব সম্প্রদায়ের কি বোর্ডের উপর, রুচির উপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কবিতে কবিতে মন্তব্য যুদ্ধ কিছুদিন পর পর বাংলা কবিতার পাঠককে আনন্দ দেয়, তাঁদের কবিতা হয়তো আর  পারে না সেটা। আদিম গোত্রপ্রধানদের মতো শিবির বিভাজনে বিশ্বাস করেন কেউ কেউ, মুখের উপর প্রতিক্রিয়াশীল বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ট্যাগ দিতে ফেসবুকে এখনো অতিরিক্ত কর আরোপিত হয়নি। এসব চলবে। চলতে থাকবে৷ জাকারবার্গের বাবার সুপুত্রটির এই যোগাযোগ মাধ্যম যতদিন থাকবে ততদিন চলবে। আমরা যদি আরেকটু সহজ হই, সহিষ্ণু হই আমাদেরই লাভ৷ সাফল্যের ধারণা যে ব্যক্তিবিশেষে আলাদা এই সরল কথা বুঝে নিতে পারলে সর্বগ্রাসী মোটিভেশন বিশারদের হাত থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। সকল অপমান, সকল খুন দেখা যায় না, এই কথাটাও মনে রাখা দরকার। যেহেতু দেখা যায় না সেহেতু খুনী শাস্তি পায় না। 

এই দীর্ঘ গদ্য, যার বেশিরভাগ নানা বইপত্র থেকে সংগৃহীত, এতোক্ষণ ধরে পড়ায়, প্রিয় পাঠিকা, আপনাকে ভালোবাসা জানাই। 

Related Topics

টপ নিউজ

মৃণাল সেন / জগদীশ গুপ্ত / দীপেশ চক্রবর্তী / যামিনী রায় / বিষ্ণু দে / শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় / সুভাষ মুখোপাধ্যায় / অপমান

Comments

While most comments will be posted if they are on-topic and not abusive, moderation decisions are subjective. Published comments are readers’ own views and The Business Standard does not endorse any of the readers’ comments.

MOST VIEWED

  • ছবি: সংগৃহীত
    ২১ জানুয়ারির মধ্যে বাজার থেকে কিটক্যাট চকলেটের লট অপসারণের নির্দেশ
  • ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: রয়টার্স
    শান্তি চুক্তির বিনিময়ে ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করল ইউক্রেন
  • প্রতীকী ছবি: আনস্প্ল্যাশ
    এনইআইআর চালু হচ্ছে ১ জানুয়ারি, হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের সময় বাড়ল ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত
  • অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও সাংবাদিক আনিস আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত
    সাংবাদিক আনিস আলমগীর ও অভিনেত্রী শাওনসহ চারজনের নামে থানায় অভিযোগ
  • প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
    ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নতুন গ্যাসকূপে খনন কাজ শুরু, দিনে মিলবে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস
  • ছবি: টিবিএস
    সাংবাদিক আনিস আলমগীর ৫ দিনের রিমান্ডে  

Related News

  • হিটলারের প্রশংসা ও রাজনীতিবিদদের অপমান করল মাস্কের চ্যাটবট গ্রোক
  • ‘পদাতিক’-এ খোদ সত্যজিতের গলার আওয়াজ, এআই দিয়ে বড় চমক সৃজিতের
  • ফরিদপুরে মৃণাল সেনের বাড়ির খোঁজে
  • চালচিত্র এখন: মৃণাল সেনকে নিয়ে সিনেমা বানাচ্ছেন অঞ্জন দত্ত  
  • মৃণাল সেনের এক শ হলো

Most Read

1
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ

২১ জানুয়ারির মধ্যে বাজার থেকে কিটক্যাট চকলেটের লট অপসারণের নির্দেশ

2
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ছবি: রয়টার্স
আন্তর্জাতিক

শান্তি চুক্তির বিনিময়ে ন্যাটোতে যোগদানের আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করল ইউক্রেন

3
প্রতীকী ছবি: আনস্প্ল্যাশ
বাংলাদেশ

এনইআইআর চালু হচ্ছে ১ জানুয়ারি, হ্যান্ডসেট নিবন্ধনের সময় বাড়ল ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত

4
অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন ও সাংবাদিক আনিস আলমগীর। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ

সাংবাদিক আনিস আলমগীর ও অভিনেত্রী শাওনসহ চারজনের নামে থানায় অভিযোগ

5
প্রতীকী ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নতুন গ্যাসকূপে খনন কাজ শুরু, দিনে মিলবে ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস

6
ছবি: টিবিএস
বাংলাদেশ

সাংবাদিক আনিস আলমগীর ৫ দিনের রিমান্ডে  

EMAIL US
contact@tbsnews.net
FOLLOW US
WHATSAPP
+880 1847416158
The Business Standard
  • About Us
  • Contact us
  • Sitemap
  • Privacy Policy
  • Comment Policy
Copyright © 2025
The Business Standard All rights reserved
Technical Partner: RSI Lab

Contact Us

The Business Standard

Main Office -4/A, Eskaton Garden, Dhaka- 1000

Phone: +8801847 416158 - 59

Send Opinion articles to - oped.tbs@gmail.com

For advertisement- sales@tbsnews.net