যেভাবে আফগান যুদ্ধ জিতেছে পাকিস্তান

ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর গত দুই শতকে বিশ্বের অসংখ্য দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এক সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হওয়ার পরও অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের এ নেশায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেও মজেছে পরবর্তীকালে। কিন্তু, দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘ যুদ্ধ ছিল আফগানিস্তানে আগ্রাসন। সমরশক্তির শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েও কীভাবে এ যুদ্ধে পরাজয় ঘটলো তা নিয়ে এখন ভাবনার অন্ত নেই ওয়াশিংটনে।
নীতি-নির্ধারক, রাজনীতিক, কূটনীতিক, পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ মহলের এমন ভাবনা চিরকালীন। হয়তো আরও দীর্ঘদিন তারা পরাজয়ের নানান দিক খুঁজে বের করবেন। কিন্তু, যে প্রশ্নটি আসলেই করা দরকার তা হলো; এ যুদ্ধে আসলে কে জিতেছে?
নিশ্চিতভাবেই প্রথমে মৌলবাদী তালেবান গোষ্ঠীকে বিজয়ী হিসেবে বলা যেতে পারে, ইতোমধ্যেই যারা নিজেদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও ঘোষণা করেছে। এ সরকারে শীর্ষ মন্ত্রীদের মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ ঘোষিত কয়েক জন শীর্ষ সন্ত্রাসী। অর্থাৎ, সুস্পষ্ট বিজয়ের পর তালেবান সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও পরাজিত পশ্চিমা শক্তির ইচ্ছাকে কাঁচকলা দেখাল। কিন্তু, তালেবানের চেয়েও বড় জয় পেয়েছে সম্ভবত গোষ্ঠীটির দীর্ঘদিনের পৃষ্ঠপোষক: পাকিস্তান।
গত মাসে তালেবানের কাবুল দখলের পর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়ে অধিকাংশ মার্কিন মিত্র রাষ্ট্র বিস্ময়, ক্ষোভ ও দুঃখ প্রকাশ করেছে। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া কিন্তু এমনটা ছিল না। দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানিস্তানের নির্বাচিত সরকার পতনে বিজয় উদযাপন করেন। তিনি বলেন, তালেবান 'দীর্ঘদিনে দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙ্গে' জাতিকে মুক্ত করেছে।
তাঁর এ মন্তব্যে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই, কারণ ৯/১১ পরবর্তী সময়ে যেদিন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, সেদিন থেকেই এক দ্বৈত খেলা খেলেছে পাকিস্তান। মাঝেমধ্যেই দেশটির গোয়েন্দারা আল কায়েদা ও তালেবানের কিছু নেতার হদিশ যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছেন। সাহায্য করেছেন তাদের গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদে। এমন এক সহযোগিতামূলক অপারেশনে মার্কিন ও পাকিস্তানী স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা তালেবানের অন্যতম যুগ্ম-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারকে করাচি থেকে গ্রেপ্তার করে।
অপরদিকে, পাকিস্তানী সেনা ও গোয়েন্দা বাহিনীগুলোর কিছু গ্রুপ তালেবানকে আশ্রয়, প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন অব্যাহত রাখে। শুধু তালেবান নয়, তাদের অন্যতম মিত্র ও পশ্চিমাদের কাছে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হাক্কানি নেটওয়ার্কও এসব সুবিধা পেয়েছে।
আফগানিস্তানে মার্কিন যুদ্ধের প্রথম ১০ বছরে এ দ্বৈততা নিয়ে পর্দার আড়ালে গোপন বাকবিতণ্ডা চলেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে। কিন্তু, ২০১১ সালে কাবুলে ন্যাটো জোটের একটি সামরিক ঘাঁটিতে হাক্কানি নেটওয়ার্কের ভয়াবহ ট্রাক বোমা হামলা ও তারপর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে মার্কিন দূতাবাসে গ্রুপটির সশস্ত্র অভিযানের পর এই নীরবতার পর্দা ছিন্ন করেন তৎকালীন মার্কিন জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন।
পাকিস্তানের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্সের বর্ধিত হাত হিসেবে কাজ করছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক।'
মুলেনের এ অভিযোগে অবশ্য কারো আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না। আইএসআই- এর গোপন খেলার কথা ততদিনে বিশ্বের কারো অজানা ছিল না। কারণ, কয়েক মাস আগেই ২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে নিরাপদ আশ্রয়ে থাকা ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করে মার্কিন সেনারা।
অথচ এই অ্যাবোটাবাদেই রয়েছে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর সর্বোচ্চ সামরিক শিক্ষা কেন্দ্র, যা অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট পয়েন্ট মিলিটারি একাডেমীর সাথেই তুলনীয়। ঠিক এ কারণেই মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর সর্বোচ্চ প্রধান হিসেবে মুলেন অভিযানের আগে তাঁর পাকিস্তানী প্রতিপক্ষদের কিছুই জানাননি।
২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানকে মোট দুই হাজার কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ২০১১ সালের পর থেকে এই সাহায্যের পরিমাণ কমতে শুরু করে। আর ২০১৮ সাল নাগাদ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় জরুরি কিছু সহায়তা বাদে পাকিস্তানকে দেওয়া অন্যান্য সব রকম সাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।
একমাত্র সামারিক সাহায্য বন্ধ করা ও সমরাস্ত্র সংগ্রহের কিছু নিষেধাজ্ঞার মতো ব্যবস্থার মাধ্যমেই অবাধ্য গ্রাহক পাকিস্তানকে কিছুটা শাস্তি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে এসেই আফগানিস্তান থেকে সরে আসার উপায় খুঁজতে থাকেন। তবে যুদ্ধ সমাপ্তির আগে শেষবারের মতো তালেবানকে পরাস্ত করার কৌশল হিসেবে মোতায়েন করা সেনা সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ান তিনি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম বছরেও মার্কিন সেনা উপস্থিতি ও অভিযানের তীব্রতা বেড়েছিল। কিন্তু, তারপর তালেবানের সঙ্গে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি করে ট্রাম্প প্রশাসন। প্রকৃতপক্ষে নিশ্চিত আত্মসমর্পণের ওই চুক্তিই বাস্তবায়ন করেছেন জো বাইডেন।
তাই তালেবান পাকিস্তানের বিজয়ে উল্লাস করবে এটাই স্বাভাবিক, কারণ দেশটির গোপন রাষ্ট্রীয় শক্তিগুলো ২০০১ সালের পর থেকেই তালেবানকে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।
পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে এখন পর্যন্ত নীরব আছে বাইডেন প্রশাসন। কিন্তু, আশ্চর্য বিষয় আফগানিস্তানের অনেক মানুষই এনিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার কাবুলে কিছু বিক্ষোভকারী তাদের নিজেদের দেশের ব্যাপারে পাকিস্তানকে নাক না গলানোর দাবি জানিয়ে স্লোগান দেয়।
এই সাহসী বিক্ষোভকারীদের প্রতিও অন্তত আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু, তেমনটাও হয়তো হবার নয়। জো বাইডেন সেনা প্রত্যাহারের সময় থেকেই বলে আসছেন, আফগান ভূমিতে সেনা উপস্থিতি না থাকলেও দেশটিতে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিমান হামলা চালানোর সক্ষমতা বজায় রাখবে যুক্তরাষ্ট্র। যার অর্থ আগামীতে আফগানিস্তানে গোয়েন্দা নজরদারি ও বিমান হামলা চালাতে পাকিস্তানের আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দরকার হবে।
আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের অনন্ত যুদ্ধ হয়তো শেষ হয়েছে, কিন্তু সীমান্তের ওপাড়ে পাকিস্তান যে পরাশক্তিকে হারাতে সাহায্য করেছিল আজো তার ওপর কিছু সুবিধা বজায় রেখেই চলছে।
- লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট এলি লেক। ইতঃপূর্বে, দ্য ডেইলি বিস্টের জ্যেষ্ঠ জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়াও, ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউ ইয়র্ক সান ও ইউপিআই- এর মতো গণমাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বিষয়ক প্রতিবেদকে হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত