পরিত্যক্ত মার্কিন গবেষণায় ভর করে পারমাণবিক শক্তিতে বড় অগ্রগতি চীনা বিজ্ঞানীদের

চীনের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো একটি পরীক্ষামূলক পারমাণবিক চুল্লিতে জ্বালানি ভরেছেন সেটি বন্ধ না করেই—যা জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প এ শক্তি উৎপাদনে বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে।
এ চুল্লিতে ব্যবহৃত হয়েছে গলিত-লবণের (মল্টেন-সল্ট) একটি প্রোটোটাইপ প্রযুক্তি, যেখানে ইউরেনিয়ামের বদলে তরল থোরিয়াম জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস-এর এক সভায় গত ৮ এপ্রিল প্রধান গবেষক জু হংজি বলেন, 'পারমাণবিক প্রযুক্তিতে এখন চীন অগ্রগামী।'
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) তথ্যমতে, ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম থোরিয়াম চুল্লি তৈরি হয়েছিল। পরে ইউরেনিয়ামকে প্রধান জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার শুরু করে দেশটি। আর থোরিয়াম নিয়ে গবেষণাগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। চীনের গবেষকেরা এখন সেই পুরোনো গবেষণাকেই নতুনভাবে কাজে লাগিয়েছেন।
'যুক্তরাষ্ট্র তাদের গবেষণা সবার জন্য উন্মুক্ত রেখেছিল। তারা একটি যোগ্য উত্তরসূরির অপেক্ষায় ছিল, আর আমরা সেই উত্তরসূরি,' বলেন জু। ঈশপের একটি গল্প উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'খরগোশ মাঝে মাঝে ভুল করে, তখন কচ্ছপ এগিয়ে যায়।'
চুল্লিটি চীনের গোবি মরুভূমিতে, মঙ্গোলিয়ার সীমান্তের কাছে অবস্থিত বলে জানা যায়। এটি ২০২৪ সালের জুনে কার্যক্রম শুরু করে। চুল্লিটি ২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম, যা প্রায় ২ হাজার পরিবারের চাহিদা পূরণ করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর মতে, এটি সাধারণ ইউটিলিটি-স্কেল জেনারেটরের চেয়ে দ্বিগুণ ক্ষমতাসম্পন্ন।
থোরিয়াম চুল্লি এক ধরনের গলিত-লবণ চুল্লি (এমএসআর)। এতে তরল থোরিয়ামকে গলিত লবণের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়, যা একসঙ্গে কুল্যান্ট ও জ্বালানি হিসেবে কাজ করে।
চুল্লির চেম্বারে ঢোকার পর এই মিশ্রণটি ১,১১২ ডিগ্রি ফারেনহাইট (প্রায় ৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় উত্তপ্ত হয়। এরপর নিউট্রনের আঘাতে থোরিয়াম রূপ নেয় ইউরেনিয়াম-২৩৩-এ, যা ফিশনের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে।
মল্টেন-সল্ট চুল্লিকে সাধারণ ইউরেনিয়াম চুল্লির চেয়ে অনেক নিরাপদ ধরা হয়। এগুলোর জ্বালানি আগে থেকেই তরল, তাই গলে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। আর বাতাসের সংস্পর্শে এলে ঠান্ডা হয়ে এটি শক্ত হয়ে যায়, ফলে চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনার আশঙ্কা কম।
এ ধরনের চুল্লি তুলনামূলকভাবে কম পারমাণবিক বর্জ্য তৈরি করে। এমনকি ইউরেনিয়াম চুল্লি থেকে আসা কঠিন বর্জ্যও এখানে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
যদিও গলিত-লবণ চুল্লিতে ইউরেনিয়ামও ব্যবহার করা যায়, বিজ্ঞানীরা থোরিয়ামকেই বেশি পছন্দ করেন। কারণ এটি বেশি সহজলভ্য এবং মজুদের পরিমাণ ইউরেনিয়ামের চেয়ে তিন গুণ বেশি।
চীন অনেক দিন ধরেই একটি পূর্ণাঙ্গ থোরিয়াম-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চেষ্টা করছে। বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের প্রায় ২৭ শতাংশই আসে চীন থেকে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০৬০ সালের মধ্যে দেশকে কার্বন-নিরপেক্ষ করতে চান।
সম্প্রতি দেশটি নিজেদের ভূখণ্ডে বিপুল পরিমাণ থোরিয়ামের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে। জাতীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপ বলছে, এই সম্পদ দিয়ে আগামী ৬০ হাজার বছর চীনের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা সম্ভব—জানিয়েছে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।
গলিত-লবণ চুল্লির ধারণা আসে ১৯৪৬ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনী একটি পারমাণবিক-চালিত সুপারসনিক জেট তৈরির পরিকল্পনা করেছিল। পরে নানা সমস্যার কারণে ১৯৫৪ সালে প্রকল্পটি বাতিল হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল—গলিত লবণ ধাতব কাঠামো ক্ষয় করে ফেলছিল।
পরবর্তীকালে থোরিয়াম চুল্লি তৈরির অনেক চেষ্টা হলেও থোরিয়ামের দুর্বল তেজস্ক্রিয়তার কারণে টেকসই বিক্রিয়া ঘটানো কঠিন হয়ে পড়ে।
চীন ১৯৭০ সাল থেকেই থোরিয়ামভিত্তিক গলিত-লবণ চুল্লির ওপর গবেষণা চালিয়ে আসছে। তারা কীভাবে এই প্রযুক্তিগত সমস্যাগুলোর সমাধান করেছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে জু হংজি বলেন, টানা দীর্ঘ সময় ধরে একাগ্রভাবে কাজ করার ফলেই এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, 'পারমাণবিক প্রযুক্তিতে সফলতা এক দিনে আসে না। ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে একই বিষয়ে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হয়। তবেই ফল আসে।'