অটোমোবাইল দুনিয়ার কেন্দ্র বদলে দিচ্ছে ইলেকট্রিক কার

অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গত কয়েক দশকের অন্যতম বড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে আমাদের আয়ুস্কালেই।বিক্রি বৃদ্ধির কারণে প্রধান প্রধান অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিচ্ছে, যা ২০২১ সালেই বৈদ্যুতিক যানকে (ইভি) সংস্থাগুলোর প্রধান পণ্য রূপে গ্রহণ করে বাণিজ্যিক গতিপথ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
শুধু তাই নয়, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নানান দেশের সরকার ও অটোমোবাইল উৎপাদকরা ইভির বাজার অংশীদারিত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০৩০ সাল নাগাদ বিক্রি হওয়া নতুন গাড়ির ৫০ শতাংশ ইভি হবে বলে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। তবে এসব যানবাহন কোথায় উৎপাদিত হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
ঐতিহ্যগতভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অটোমোবাইল শিল্পের নিবাস মধ্যপশ্চিমাঞ্চলে, কিন্তু এবার দক্ষিণপূর্ব ও দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সামনে এই শিল্পে অগ্রণী হয়ে ওঠার মল্লযুদ্ধে জেতার সুযোগ দেখা দিয়েছে।
এ পর্যন্ত বাজার অংশীদারিত্বের সামান্য কয়েক শতাংশই দখল করতে পেরেছে ইভি। তবে ভবিষ্যৎ উন্নতির উদাহরণ সৃষ্টি করেছে টেসলা ইঙ্ক। কোম্পানিটি একটি প্রচলিত যান উৎপাদনের কারখানাকে রূপান্তর করে তা ইভি উৎপাদনের উপযোগী করে তুলেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার এই কারখানাটি আগে ছিল জেনারেল মোটরস কর্পোরেশনের আওতাধীন। টেসলা সেখানে প্রচলিত জ্বালানির জনপ্রিয় মডেলকে ইভি হিসেবের উৎপাদন শুরু করে।
টেসলার কৌশল অন্যদের জন্য অনুকরণীয়। প্রথমে বাজারে সম্ভাবনাময় অথচ মুষ্টিমেয় কিছু পণ্য উন্নয়নে মনোনিবেশ করে এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পণ্যের উন্নতি সাধন করে, সেটিকে ক্রেতাদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। ফলে ক্রেতারাও নতুন মডেলের গাড়িটি কিনতে উৎসাহ দেখান।
ইতোমধ্যেই টেসলাকে অনুকরণ করেছে রিভিয়ান অটোমোবাইল ইঙ্ক। ইলিনয় রাজ্যে মিতশুবিশি কর্পের মালিকানাধীন একটি কারখানা কিনে ও রূপান্তর করে সেখানে কোম্পানিটি এখন ইলেক্ট্রিক ট্রাক উৎপাদন করছে।
তবে বছরে মাত্র কয়েক লাখ ইউনিট বৈদ্যুতিক যান উৎপাদন ও বিক্রির সাথে ২০৩০ সাল নাগাদ বার্ষিকভাবে ১ কোটি ইউনিট উৎপাদন ও বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রার বড় পার্থক্য রয়েছে।
তাই অনিবার্যভাবেই পরবর্তী ধাপ হচ্ছে উৎপাদন সক্ষমতার ব্যাপক সম্প্রসারণ, ইতোমধ্যেই সে কার্যক্রম শুরু হয়েছে। প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন পরিকল্পনা ঘোষণাও করছে কোম্পানিগুলো।
এখানেও অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে টেসলা। নেভাদা রাজ্যের রেনো অঞ্চলে ব্যাটারি উৎপাদনের সুবৃহৎ এক কারখানা স্থাপন করেছে ইলন মাস্কের কোম্পানিটি। টেক্সাস রাজ্যের অস্টিনে নির্মাণাধীন রয়েছে তাদের নতুন একটি ইভি উৎপাদন স্থাপনা।
কিন্তু বিনাযুদ্ধে রণেভঙ্গ দিতে চাইছে না অন্যরাও। অন্তত যুদ্ধ শুরুর এ পর্যায়ে তো নয়ই। তারাও টেসলার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে।
মার্কিন অটোমোবাইল শিল্পে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এমনই একটি পদক্ষেপ ফোর্ড মোটরস কো. এর সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার এসকে ইনোভেশন ইঙ্কের অংশীদারিত্বের ঘোষণা। যৌথভাবে তারা এক হাজার ১৪০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে কেন্টাকি ও টেনেসিতে ইভি সংযোজন ও ব্যাটারি উৎপাদন কারখানা স্থাপন করবে। এটি হবে ১৯০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ফোর্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।
২০২৫ বা ২০২৬ নাগাদ ইভি চাহিদার যে আভাস দেওয়া হয়েছে, তা পূরণ করতে চাইলে মোটরযান প্রস্তুতকারকদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। যাতে সময় থাকতেই তারা উৎপাদনের দরকারি স্থাপনা ও সক্ষমতা তৈরি করতে পারে। বৃহৎ বিনিয়োগ ঘোষণার সেটাই বড় কারণ। কিন্তু, এসব সিদ্ধান্তের ফলে প্রধানত ইলেকট্রিক যান তৈরি ও বিক্রির ভবিষ্যতের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ছে তারা। এব্যাপারে ব্লুমবার্গের কলামিস্ট ন্যাথানিয়েল বুলার্ড বলেছেন, 'পুঁজি বিনিয়োগই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।'
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শহর ও রাজ্য চাইছে ইভি তৈরির বা সহযোগী অবকাঠামো তাদের এলাকায় নির্মিত হোক। এতে স্থানীয় কর্মসংস্থান ও অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। ফলে একত্রিত হতে শুরু করেছে সাফল্যের কাঠামো।
প্রথমেই বলা যাক, অর্থায়ন ও নির্মাণের জন্য প্রস্তুত টেসলার দুটি বৃহৎ প্রকল্পের কথা। নেভাদা ও টেক্সাসে প্রকল্প দুটির আয়তন যথাক্রমে- আড়াই হাজার ও তিন হাজার একর জুড়ে, যা নিউইয়র্কের ম্যানহাটন অঞ্চলের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
মেম্ফিসের বাইরে ফোর্ডের পরিকল্পিত স্থাপনার আকার হবে আরও বড়, তিন হাজার ৬০০ একর জুড়ে বিস্তৃত।
নিজ অঞ্চলে কারখানা স্থাপনে বিপুল কর ছাড় ও প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় সরকারগুলো। যেমন- টেনেসি রাজ্য সরকার চোখ কপালে ওঠার মতো অঙ্কের বা ৫০ কোটি ডলার কর ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে ফোর্ডকে। কারখানায় কর্মীর সংখ্যা বাড়লে, ছাড়ের পরিমাণ আরও বাড়বে।
টেনেসিতেই অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ বৃহৎ বিদ্যুৎ সরবরাহক সরকারি সংস্থা টেনেসি ভ্যালি অথরিটি। ফল বিদ্যুৎ খরচে ভর্তুকি দেওয়ার মতো সঙ্গতিও আছে রাজ্য প্রশাসনের। আর ইভির ব্যাটারি নির্মাণ কারখানায় সাধারণ সংযোজন কারখানার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয়। এক্ষেত্রে টেনেসি সস্তা ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎশক্তি সরবরাহ করে শিল্প প্রতিষ্ঠানটিকে প্রতিযোগীদের থেকে এগিয়ে থাকতে সাহায্য করবে।
এতদিন গ্যাসোলিন ( জীবাশ্ম তেল) চালিত যানবাহন উৎপাদনে মিশিগান যে ভূমিকা রেখে আসছে, ইভি উৎপাদনে তেমনই কেন্দ্র হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন মার্কিন প্রদেশগুলোর নেতারা। এজন্যই তারা এই মুহূর্তকে শিল্পটিকে আকর্ষণের সুবর্ণ সময় মনে করছেন, যা একবার হারালে আর আসবে না।
এমন চিন্তার কারণও স্পষ্ট। জলবায়ু মোকাবিলার চাপ বাড়ায় ইলেকট্রিক গাড়ি চালিত ভবিষ্যতের বিকল্প নেই। এত বড় একটি শিল্প হাতছাড়া হওয়ার অর্থ অর্থনৈতিক গুরুত্ব হারানো। এধরনের একটি শিল্পকেন্দ্র হাজার হাজার মধ্য সাড়ির কর্মসংস্থান সৃষ্টি কর, নিকটবর্তী এলাকায় শিল্প সহযোগী সরবরাহ চক্র গড়ে ওঠার কারণে আবার তৈরি হয় কর্মসংস্থানের দ্বিতীয় ঢেউ।
ফলে দর কষাকষিতে সুবিধাজনক স্থানেই আছে বৃহৎ মোটরযান উৎপাদকরা। তারা নেভাদা, অ্যারিজোনা, টেক্সাস, কেন্টাকি, টেনেসি, জর্জিয়া ও সাউথ ক্যারোলিনার মতো রাজগুলোকে পরস্পর প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করেছে।
শিল্প প্রতিযোগিতার এই লড়াইয়ে কোন রাজ্যের শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা বা না করার সিদ্ধান্তও বড় প্রভাব ফেলবে। ইভি শিল্পের রূপান্তর কালে অধিকাংশ কোম্পানিই চাইছে ইউনিয়ন-হীন রাজ্যে আসতে। আর সেই সুযোগও এবার তাদের সামনে। ফলে ইভি শিল্পের কল্যাণে মধ্যপশ্চিমাঞ্চলে সবুজ শিল্প বিকাশ ও অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের যে ভিশন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সামনে এনেছেন তা রুঢ় বাস্তবতার মুখে ব্যর্থ হবে, কারণ দক্ষিণের রাজ্যগুলো যে হারে প্রণোদনা ও ছাড় দিতে পারবে তা মধ্যপশ্চিমাঞ্চলের রাজ্যগুলি দিতে পারবে না।
হাইওয়ের ধারে শিল্পের জন্য বিপুল জমি, সস্তা ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সংযোগ, কোটি কোটি ডলার করছাড় এবং এমনকি গাড়ি শিল্পে ইউনিয়ন-হীন শ্রমের সুবিধা দিয়ে নিঃসন্দেহে এসব রাজ্যে ইভি দুনিয়ার অগ্রণী কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। হেরে যাওয়াদের ভবিষ্যৎ ভাবনা একান্ত তাদের নিজেদেরই করতে হবে।
- লেখক: মার্কিন গণমাধ্যম ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট কনর সেন। তিনি পিচক্রিক ইনভেস্টমেন্টস নামক একটি বিনিয়োগ সংস্থারও প্রতিষ্ঠাতা। ইতঃপূর্বে তিনি দ্য আটলান্টিক ও বিজনেস ইনসাইডারে প্রতিবেদক ছিলেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত