ট্রাম্পের অভিবাসন কড়াকড়ি: পরামর্শ দিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের পাশে মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো

নতুন অভিবাসন নীতির কড়াকড়ির মধ্যে কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে তা থেকে শুরু করে দেশ ছাড়তে বারণ—সব ধরনের পরামর্শই এখন বিদেশি শিক্ষার্থীদের দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথমে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কিছু শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। এরপর ছোটখাটো অভিযোগ বা মামলার ভিত্তিতে হাজার হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীকে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দুই ডজনের বেশি শিক্ষার্থী, অভিবাসন আইনজীবী ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তারা জানান, এখন অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শদাতাই গোপনে শিক্ষার্থীদের আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছেন। পাশাপাশি, মামলা চলাকালীন নিয়মিত ক্লাস করারও জন্যও বলছেন তারা।
এমন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আদালতের শরণাপন্ন হয়ে বিদেশী শিক্ষার্থীদের এসব গ্রেপ্তার কতটা সাংবিধানিক—তা চ্যালেঞ্জ করেছেন।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে রেকর্ড ১১ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন। অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকান ইউনিভার্সিটিজ জানায়, গত বছর এ শিক্ষার্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে অবদান রেখেছেন ৪৪ বিলিয়ন ডলার।
তবে বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয় বলেই মনে করেন এমআইটির প্রেসিডেন্ট স্যালি কর্নব্লুথ। তিনি বলেন, 'এটি একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়, এবং আমরা তাতে গর্বিত—তবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থী ও গবেষকদের ছাড়া আমাদের অবস্থান অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে।'
সবচেয়ে বিপাকে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা
ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে থাকা অর্ধেকের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ভারত ও চীনের নাগরিক।
আমেরিকান ইমিগ্রেশন লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (এআইএলএ) জানায়, ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট (আইস) চার হাজার ৭০০-এর বেশি ভিসাধারী শিক্ষার্থীর নাম স্টুডেন্ট অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ইনফরমেশন সিস্টেম (সেভিস) থেকে মুছে দিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের বিরুদ্ধে 'অপরাধে জড়িয়ে পড়া'র অভিযোগ আনা হয়েছে।
এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই ভারতীয়। তাদের অনেকেই অপশনাল প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং (ওপিটি) কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সহকারী সচিব ট্রিশিয়া ম্যাকলাফলিন সেভিস স্ট্যাটাস হারানো শিক্ষার্থীদের দেশটি ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'আপনি যদি বেআইনিভাবে এ দেশে থাকেন, তাহলে আমরা আপনাকে গ্রেপ্তার করব, বহিষ্কার করব এবং ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রে ফেরার সুযোগ থাকবে না।'
একটি বড় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপদেষ্টা জানান, এখন পূর্ণকালীন শিক্ষার্থীদের আইনজীবী নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। যে-সব শিক্ষার্থী সেভিস থেকে নাম বাতিলের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করছেন, তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে।
নিউ ইয়র্কভিত্তিক অভিবাসন আইনজীবী ক্লে গ্রিনবার্গ বলেন, 'আমি যে-সব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের অধিকাংশের বিশ্ববিদ্যালয়ই ক্লাস চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে।'
রয়টার্স-এর একটি হিসেব অনুযায়ী, সেভিস থেকে বাদ দেওয়া ২০০-র বেশি শিক্ষার্থী আদালত থেকে আপাতত গ্রেপ্তার বা বহিষ্কারের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ পেয়েছেন।
ভার্জিনিয়ার জর্জ ম্যাসন ইউনিভার্সিটি শিক্ষার্থীদের পরামর্শ দিয়েছে, যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপদেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া কর্তৃপক্ষও শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন ইউসি অফিস অব দ্য প্রেসিডেন্ট-এর মুখপাত্র র্যাচেল জেন্টজ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সামনে গ্রীষ্মকালীন ছুটি। এ সময়টাতে অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী দেশে বেড়াতে যান। ডিউক ইউনিভার্সিটি আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে, শরৎকালীন (ফল) সেমেস্টারে তাদের আর ঢুকতে দেওয়া নাও হতে পারে।
শঙ্কায় পড়ে যুক্তরাষ্ট্র ছেড়েছেন অনেকে
ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ফেডারেল এজেন্টদের হাতে গ্রেপ্তারের ভিডিও দেখার পর অনেক বিদেশি শিক্ষার্থী আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন ভারতের এক কম্পিউটার সায়েন্সের শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ট্রাফিক আইনের মতো ছোটখাটো ভুল বা আঙুলের ছাপ দেওয়ার মতো বিষয়েও যদি ডিপোর্ট করা হয়—এ ভয়ে অনেকেই আতঙ্কে আছেন।
এ পরিস্থিতিতে অনেক শিক্ষার্থী নিজেরাই দেশটি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।
মার্চ মাসে কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া মোমাদু টাল যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করেছেন। কারণ তাকে অভিবাসন কর্তৃপক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্য ও গাম্বিয়ার দ্বৈত নাগরিক টাল বলেন, 'আমি দূর থেকে [রিমোট] পড়াশোনা শেষ করতে পারব।' তিনি যুক্তরাজ্য থেকেই ডিগ্রি শেষ করার পরিকল্পনা করছেন।
জর্জিয়ার এক ভারতীয় শিক্ষার্থী জানান, মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানোর অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একবার মামলা হয়েছিল, যদিও পরে সেটি খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু সে মামলার রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করেই তার সেভিস স্ট্যাটাস বাতিল করা হয়েছে।
'আমার কলেজ আমাকে পড়তে দিচ্ছে,' বলেন ওই কম্পিউটার সায়েন্সের স্নাতক শিক্ষার্থী। তার ভাষায়, তিনি এখন খুবই সতর্কভাবে চলাফেরা করছেন।
'আমি যদি কোনো ইউনিফর্ম পরা কাউকে দেখি, সঙ্গে সঙ্গে দিক পাল্টে ফেলি,' বলেন নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানানো এ শিক্ষার্থী।