ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে মে মাসে বিপিসির ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হতে পারে

ডলারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে চড়া খরচে আমদানি করে তুলনমূলক কম দামে জ্বালানি তেল বিক্রি করতে হচ্ছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনকে (বিপিসি)। এ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, এর ফলে বিপিসির ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হতে পারে বলে।
মে মাসের শুরুতে এ মাসের জন্য জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় সরকার। এর এক সপ্তাহ পর, ৮ মে কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা-ডলারের বিনিময় হার পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনে 'ক্রলিং পেগ' পদ্ধতি চালু করে। এতে প্রতি ডলারের দর ৭ টাকা বেড়ে ১১৭ টাকায় উঠে যায়।
এপ্রিল মাসে জ্বালানির তেল আমদানি করা হয়েছিল ডলারপ্রতি ১১০ টাকা হিসাবে। গত ৩০ এপ্রিল মে মাসের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ প্রতি লিটার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ১০৭ টাকা নির্ধারণ করে। আর প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ১২৪.৫০ টাকা ও অকটেনের দাম ১২৮.৫০ টাকা নির্ধারণ করে।
কিন্তু এপ্রিলে বা মে মাসে ডলারের দাম বাড়ার আগে আমদানি করা বেশিরভাগ জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধে বিপিসিকে প্রতি ডলারের দর দিতে হচ্ছে ১১৭ টাকা। এতে বিপিসিকে বাড়তি টাকা গুনতে হচ্ছে। কিন্তু তেল বিক্রি করা হচ্ছে তুলনামূলক কম দামে।
বিপিসির সূত্রমতে, ডলার সংকটের কারণে মে মাসেও সব জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ সম্ভব হবে না, কিছু বকেয়া থেকে যাবে।
প্রতি মাসে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত মিলিয়ে মোট ১৭-১৮ কার্গো জ্বালানি তেল আমদানি করে বিপিসি। প্রতি কার্গোতে গড়ে ৩০ হাজার টন তেল থাকে। বিপিসিই দেশে একমাত্র সংস্থা, যারা জ্বালানি তেল আমদানি ও বিপণন করে থাকে।
সংস্থাটি কিছুটা আর্থিক চাপের মুখে পড়বে স্বীকার করে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আগে আমদানি করা হয়েছে, কিন্তু মূল্য ডলারের দাম বৃদ্ধির পরে পরিশোধ করতে হচ্ছে, এমন ক্ষেত্রে কিছু লোকসান হবে।'
তবে লোকসান হলেও সামগ্রিকভাবে বিপিসিকে বড় চাপ নিতে হবে না বলে মনে করেন আমিন উল আহসান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন', ডাইনামিক প্রাইসিং পদ্ধতির মধ্যে বিপিসির জন্য সামান্য মুনাফা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। ফলে আগের মাসগুলোতে যে লাভ রয়েছে আর মে মাসে যে লোকসান হবে, তা সমন্বয় করলে বিপিসির জন্য বিশেষ চাপ হবে না।'
আমদানি ও চাহিদা
চলতি অর্থবছরে বিপিসি ৫০ লাখ টন পরিশোধিত জ্বালানি তেল ও ১৩ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল মিলিয়ে মোট ৬৩ লাখ টন জ্বালানি তেল আমদানি করবে।
এই হিসাবে দেশে প্রতি মাসে গড়ে ৫ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে সংস্থাটি।
বোরো মৌসুম শেষ হওয়ায় সেচে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে মে মাসে সরবরাহের পরিমাণ কম বলে জানিয়েছেন বিপিসির কর্মকর্তারা। তা সত্ত্বেও মে মাসের প্রথম ১১ দিনে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৬৪৬ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করেছে সংস্থাটি।
স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি চালু করেছে সরকার।
এ পদ্ধতিতে গত এক মাসের বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্যের চলমান গড়ের ভিত্তিতে জ্বালানি তেলের আমদানি ব্যয়, সংশ্লিষ্ট সময়ের মার্কিন ডলারের গড় বিনিময় হার, শুল্ক-কর, বিপিসির মার্জিন বা লাভ, আনুষঙ্গিক ব্যয় (পরিবহন ভাড়া, ডিলার ও পাম্প কমিশন, সিস্টেম লস) যুক্ত করে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
এছাড়া আগে থেকে থাকা বকেয়া পরিশোধেও বাড়তি ব্যয় করতে হবে বিপিসিকে। জানা গেছে, গত ২০ মে পর্যন্ত বিপিসির বৈদেশিক বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলার। এর বাইরে যেসব ক্ষেত্রে বিপিসিকে লেট পেমেন্ট দিতে হচ্ছে, সেখানেও ব্যয় বাড়বে। লেট পেমেন্টের ক্ষেত্রে সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট-এর (সোফর) সঙ্গে ২ শতাংশ বাড়তি দিতে হয়। এসব ক্ষেত্রে বিপিসির বাড়তি প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়বে।
মজুত ঠেকাতে সরবরাহে মনিটরিং করছে বিপিসি
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগামী মাসে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বে—এ বিষয়ে এ খাতের ব্যবসায়ীরা মোটামুটি নিশ্চিত। ফলে দেশের জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ীরা পণ্যটি মজুত করতে পারে, এমন আশঙ্কা রয়েছে বিপিসির। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটি তেল সরবরাহে এপ্রিল মাসে যে প্রতিষ্ঠান যত পরিমাণ তেল নিয়েছে, মে মাসে তাকে তার বেশি তেল সরবরাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বোরো মৌসুম শেষ হওয়ায় সেচের জন্য বর্তমানে জ্বালানি তেলের চাহিদা কম। পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি কম হওয়ায় পরিবহন খাতেও জ্বালানি তেলের চাহিদা কম। ফলে মে মাসে চাহিদা কিছুটা কম থাকবে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে সরবরাহ করা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও শুধু ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণেই আগামী মাসে বাংলাদেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়বেই। কারণ গত ৮ মে থেকে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে আগের তুলনায় প্রতি ডলারে ৭ টাকার বেশি দিতে হচ্ছে। এতে পণ্যের দাম, জাহাজ ভাড়া বাবদ ব্যয় বেড়েছে।
বিপিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় দুই বছর ধরে ডলারের দাম এক টাকা বাড়লে, জ্বালানি তেলের খরচও লিটারপ্রতি এক টাকা বেড়েছে। এখন ডলারের দাম ৭ টাকা বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি তেলের আমদানি খরচ সমান বাড়ার কথা। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমেছে। এজন্য দেশেও সে অনুযায়ী মূল্য সমন্বয় হবে।
বিপিসির পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড প্লানিং) অনুপম বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, 'দাম বৃদ্ধির আগাম ধারণা করে কেউ যাতে মজুত করতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিপিসির সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা সতর্ক। অস্বাভাবিক চাহিদা আছে কি না, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিপিসির ক্রেতাদের রেজিস্ট্রিও পর্যবেক্ষণ করবেন। বিপিসি থেকে ক্রেতারা কতটা তেল কিনছে, কতটা তেল বিক্রি করছে, সেগুলো দেখা হচ্ছে।'