ব্যাংকে টাকা রাখার খরচ আরও বাড়তে পারে

ব্যাংকে টাকা রাখার খরচ আগামী বছর আরও বাড়তে যাচ্ছে। ২০২২ সালের পর ফের আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংকে জমা থাকা টাকার ওপর এক্সাইজ ডিউটি বা আবগারি শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এই খরচ সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যাংকে টাকা জমা রাখার ওপর শুল্ক বাড়িয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
যদিও এনবিআরের এমন উদ্যোগের সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এ কারণে ব্যাংকে টাকা জমা রাখার প্রবণতা কমে যেতে পারে। রাজস্ব বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে এমন পদক্ষেপ নিয়ে এসব খাতের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হবে না বলে মন্তব্য করছেন তারা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ব্যাংকে থাকা ব্যালেন্সের ওপর বিদ্যমান এক্সাইজ ডিউটির পরিমাণে পরিবর্তন আনা হতে পারে।"
যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এক বছরে ব্যাংকে থাকা ব্যালেন্সের ওপর নির্দিষ্ট হারে এই টাকা কর্তন করা হয়, যা এক্সাইজ ডিউটি নামে পরিচিত। এমনকি, কোনো কোনো ব্যক্তি ঋণ নিতে গেলেও তার অ্যাকাউন্টে ওই ঋণের অর্থ জমা হলে, তাকেও এই শুল্ক দিতে হয়।
বর্তমানে এক বছরের মধ্যে যেকোনো সময় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এক লাখ টাকা জমা টাকার ওপর কোনো আবগারি শুল্ক দিতে হয় না। এক লাখ টাকা থেকে ৫ লাখ পর্যন্ত স্থিতির ওপর ১৫০ টাকা দিতে হয়, যা আগামী বাজেটে ২০০ টাকা হতে পারে বলে বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
৫ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর বিদ্যমান শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৬০০ টাকা হতে পারে।
১০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত স্থিতির ওপর বর্তমানে ৩,০০০ টাকা দিতে হয়। এই রেঞ্জকে দুটি ভাগে ভাগ করা হতে পারে। প্রথম ভাগে ১০ লাখ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত রেঞ্জকে অপরিবর্তিত রেখে ৫০ লাখ টাকা থেকে ১ কোটি টাকার ওপর ৩,০০০ টাকা থকে বাড়িয়ে ৫,০০০ টাকা করা হতে পারে। অর্থাৎ, এই রেঞ্জের মধ্যে এক বছরে ব্যাংকে কারো টাকা থাকলে তার শুল্ক বাড়তে যাচ্ছে প্রায় ৬৭ শতাংশ।
বর্তমানে বছরে যেকোনো সময়ে কোনো ব্যাংক হিসাবে ১ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংকে স্থিতি থাকলে তার ওপর এক্সাইজ ডিউটির পরিমাণ ১৫,০০০ টাকা। এই শ্রেণির ব্যাংক হিসাবধারীদের দুটি ভাগে ভাগ করা করা হতে পারে। ১ কোটি টাকা থেকে ২ কোটি টাকার হিসাবধারীদের অপরিবর্তিত রেখে ২ কোটি টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত রেঞ্জের হিসাবধারীদের ওপর তা বাড়িয়ে ২০,০০০ টাকা করা হতে পারে।
আর ৫ কোটি টাকার উপরে জমা থাকা অর্থের ওপর বিদ্যমান ৫০,০০০ টাকার এক্সাইজ ডিউটি অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে বলে জানিয়েছে সূত্র।
এদিকে, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের সাবেক সভাপতি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "তুলনামূলক যাদের অল্প পরিমাণ টাকা ব্যাংকে থাকে, এভাবে ট্যাক্স (এক্সাইজ ডিউটি) বেড়ে গেলে তো তারা সরকারকে কিছু বলতে পারে না। আমাদের সাথে হৈ চৈ করে। এসব কারণে একাংশের মধ্যে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।"
"বর্তমানে তারল্য সংকট রয়েছে। এমন সময়ে এভাবে শুল্ক বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষের টাকা তুলে নেওয়ার প্রবণতা এতে নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "সরকারের উচিত অন্যান্য খাত থেকে, বিশেষত যারা করের বাইরে– রিফর্ম আনার মাধ্যমে সেখানে নজর দেওয়া। তা না করে বিদ্যমান করদাতাদের ওপর চাপ বাড়ানো যৌক্তিক হবে না।"
"কেননা এমনিতেই মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করছে," যোগ করেন তিনি।
সরকারের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া যৌক্তিক নয় এবং এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে তা ব্যাংকে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন এনবিআরের সাবেক সদস্য ড. সৈয়দ মো. আমিনুল করিম।
তিনি বলেন, "বর্তমানে বিভিন্ন কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে, অনেকে রাখতে চাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে এক্সাইজ ডিউটি বাড়ানো হলে তা ব্যাংকে সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।"
তিনি বলেন, "এমনিতেই বর্তমান রেট বেশি। নতুন করে এ সিদ্ধান্ত নিলে ব্যবসায়ের খরচও বাড়বে। কেননা ব্যবসায়ের কারণেই অনেকের প্রচুর ট্রানজেকশন করতে হয়।"
এনবিআরের ট্যাক্স পলিসির সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "যখন বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়, তখন এ ধরনের সহজ আদায়ের সোর্স হিসেবে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এবারও তাই হচ্ছে। এটি অর্থনীতিতে ক্ষত তৈরি করবে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ১৫ কোটি ৩৫ লাখ। এরমধ্যে যারা এক্সাইজ ডিউটির আওতায় আসবে, অর্থাৎ ২ লাখ টাকার উপরে হিসাবধারীর সংখ্যা প্রায় ৯৯ লাখ। আর এক কোটির উপর হিসাবধারীর সংখ্যা ১ লাখ ১৭ হাজার।