সমঝোতার মাধ্যমে কি ১৪,৫০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব?

২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৪৫ লাখ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতি অনুসরণ করে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে এই ঋণের ১ শতাংশ আদায় করতে হবে ব্যাংকগুলোকে।
টাকার অঙ্কে এর পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।
কিন্তু এডিআর বা সমঝোতার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় করা কতটুকু সফল হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদেরা।
ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১৬.১৮ লাখ কোটি টাকা, যার মধ্যে ৯ শতাংশ খেলাপি।
খেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধে মামলা না করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে ঋণ আদায় করতে রোববার (১২ মে) ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে প্রত্যেক ব্যাংকের খেলাপি ঋণস্থিতির ন্যূনতম ১ শতাংশ নগদ আদায় এডিআরের মাধ্যমে করতে হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়েছে।
তবে অনেক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ ভালো হলেও সেটি কতটুকু সফল হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
তারা বলেন, যে টার্গেট দেওয়া হয়েছে, সেটি তাদের জন্য অনেক বড়। কারণ যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, তারা ফেরত দেবেন না ধরে নিয়েই ঋণ নিয়েছেন। ফলে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা যে নতুন পদ্ধতিতেও ঋণ ফেরত দিতে চাইবেন না, এটা নিশ্চিত।
নাম না প্রকাশের শর্তে একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, দেশের অর্থ ঋণ আদালত অনেক শক্তিশালী হওয়ার পরও ঋণ ফেরত পেতে ৭-৮ বছর সময় লেগে যায়। অনেক ক্ষেত্রে ঋণের টাকাটা পাওয়াও যায় না।
'ফলে কোনো গ্রাহক অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করে ৭-৮ বছর পর ঋণ ফেরত দেওয়ার বদলে কেন ব্যাংকের সঙ্গে নেগোসিয়েশন করতে চাইবেন?' বলেন তিনি।
যারা সমঝোতা (নেগোসিয়েশন) করবেন, তাদের সততা এডিআরের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা বলেন, যেখানে হাজার কোটি টাকা ক্লাসিফাইড ঋণ নিয়ে সমঝোতা করা হবে, সেখানে সমঝোতাকারীর সততা অনেক বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। কারণ সমঝোতাকারী দুর্নীতিগ্রস্ত হলে ব্যাংকগুলোকে এর ক্ষতির দায় নিতে হবে।
একইসঙ্গে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা যারা বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বা আছেন, তারাও প্রক্রিয়াটিকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, এডিআরের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বড় হলেও একটা লক্ষ্যমাত্রা থাকা উচিত।
তিনি বলেন, 'বর্তমানে মামলা করে ঋণ আদায় করায় দীর্ঘসূত্রিতা রয়েছে। তবে এডিআর খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়াকে লম্বাও করে ফেলতে পারে। ব্যাংকগুলোকে এখন এই এডিআর প্রক্রিয়ার আন্ডারস্ট্যান্ডিং, ট্রেনিং ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। এছাড়া এডিআর প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের ব্যাংকগুলোর প্রত্যেককে আলাদা নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। আমাদের চেষ্টা থাকবে প্রক্রিয়াটি দ্রুত শুরু করার।'
খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার (বিআইএসি) ও অন্যান্য সালিশ কেন্দ্রের সহায়তা নিতে বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিআইএসি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ (রুমী) আলী টিবিএসকে বলেন, 'কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো একটি উদ্যোগ নিয়েছে। এখন আমাদের আরও কিছু কাজ করতে হবে।
'কী প্রসেসে সামনে এগোব, এটা নিয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। এর জন্য আমরা সামনে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বসব।'
সালিশের মাধ্যমে দুই বছরে ১৫ হাজার কোটি খেলাপি ঋণ কমানো বড় টার্গেট উল্লেখ করে এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান রুমী আলী বলেন, 'আমাদের আগে কাজটা শুরু করতে হবে। টার্গেটের ভয়ে তো আর কাজ বন্ধ করে রাখা যাবে না।'
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সালিশ করাটা ভবিষ্যতের জন্য ভালো হবে মন্তব্য করে সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, 'ইন্সটিটিউশনের মাধ্যমে সালিশ করা হলে সেখানে তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। ফলে কোনো সমঝোতার পাঁচ বছর পরেও এ সম্পর্কে তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়। একক কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে সালিশ করা হলে তথ্য সংরক্ষিত না-ও হতে পারে।'
তিনি বলেন, 'লোন কোর্ট ছোট, সেখানে মামলার পরিমাণও অনেক, তাই ব্যাংকগুলোর টাকা আদায়ে অনেক বছর লেগে যায়। তাই ব্যাংকগুলোকে সালিশ করতে এগিয়ে আসতে হবে। সেইসঙ্গে যেসব গ্রাহক সালিশে আগ্রহী হবেন, তাদের কিছু সুযোগ-সুবিধাও দিতে হবে। এছাড়া যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি আছেন, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নির্দেশনা ভালো হলেও হুট করে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন বলে মন্তব্য করেন ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও এমরানুল হক।
তিনি বলেন, 'শক্তিশালী অর্থ ঋণ আদালত থাকার পরও আমরা টাকা আদায় করতে পারি না। গ্রাহকেরা হাইকোর্টে চলে যান।
'এছাড়া যিনি নেগোশিয়েটর হবেন, তাকে ব্যাংক-গ্রাহক দুই পক্ষেরই আস্থা অর্জন করতে হবে। আমাদের সে দিকটাও দেখতে হবে। সেইসঙ্গে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের টাকা আদায়ে সালিশি প্রক্রিয়ায় আসতে বাধ্য করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আলাদা আইন করতে হবে, যেন তারা রেহাই না পায়।'
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনায় অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দ্রুত আদায়ে আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
এই আইন অনুসারে, আদালত রায় বা আদেশ প্রদানের আগে মামলার যেকোনো পর্যায়ে উভয় পক্ষ আদালতের অনুমতিক্রমে বিকল্প পদ্ধতিতে মামলা নিষ্পত্তি করতে পারবে।
ব্যাংকার ও গ্রাহক উভয়পক্ষের সম্মতিতে তালিকাভুক্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ মধ্যস্থতাকারী অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, আইনজীবী, অথবা অন্য যেকোনো উপযুক্ত ব্যক্তি যাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সফলতার ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে তাদেরকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে নির্বাচন করতে হবে।
খেলাপি ঋণ আদায়ে মধ্যস্থতাকারীকে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে পারিশ্রমিক নির্ধারণ ও যথাসময়ে তা পরিশোধ নিশ্চিত করতে হবে।