চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা: জোবরা গ্রামে সহিংসতার ক্ষতচিহ্ন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে জোবরা গ্রামের মডেল মাদ্রাসার পাশেই পাঁচ বছর ধরে দোকান করছেন নান্নু মিয়া। একপাশে নাস্তার দোকান আর অন্যপাশে মুদি মালামাল বিক্রি করতেন তিনি। কয়েকটি এনজিও থেকে পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দোকান বড় করেছিলেন মাত্র কয়েক মাস আগে। বর্তমানে ঋণের কিস্তি দিতে হচ্ছে।
সবকিছু ভালোই চলছিল। তবে গত রোববার (৩১ আগস্ট) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় গ্রামবাসীর সংঘর্ষের সময় নান্নু মিয়ার দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখন দিশেহারা এই দোকানি।
সংঘর্ষের একদিন পর আজ সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) দুপুরে দোকানের সামনে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলেন নান্নু মিয়া। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তিনি বললেন, 'আমার পুরো দোকান যৌথবাহিনীর সামনেই লুটপাট করা হয়েছে। দোকান বন্ধ ছিল। এরপরও তালা ভেঙে লুট করা হয়েছে। ১১ বস্তা চাল পর্যন্ত নিয়ে গেছে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু যৌথ বাহিনী নির্বিকার।'

বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় ভাড়া বাসায় দেরিতে ঢোকায় এক ছাত্রীকে চড় মারেন দারোয়ান। এটিকে কেন্দ্র করে গত শনিবার গভীর রাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে শিক্ষার্থীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরদিন সকালে ফের সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আহত হন। পরে কর্তৃপক্ষ জানায়, সংঘর্ষে ৪০০-৫০০ জন আহত হয়েছেন।
নান্নু মিয়ার দোকানের পেছনের অংশের ধান খেতে শিক্ষার্থীরা হামলার শিকার হন। তাদের সেখানে কোপানো হয়েছিল। ঝামেলা বুঝে সকাল থেকে দোকান বন্ধ রেখেছিলেন তিনি। এরপরও শেষ রক্ষা হয়নি।
নান্নু মিয়ার দোকান ও এর আশপাশের পুরো গ্রাম আক্রান্ত হয়েছিল সোমবার। এই এলাকায় বাসা-বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ভাড়া থাকেন। আশাপাশের ভবন, কাঁচা, পাকা বাড়িগুলোর ভাঙচুরের চিহ্ন দৃশ্যমান।
নান্নু মিয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন সেখানে বসা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী। তারা বাড়ি চলে যাবেন।

নরসিংদী ও কুষ্টিয়ার এই দুই শিক্ষার্থী বিস্তারিত পরিচয় জানাতে অসম্মতি জানান। তারা টিবিএসকে বলেন, 'এই যে বাড়িঘরের ভাঙচুরগুলো হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসীর মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, এটা দীর্ঘ সময় বহন করে নিয়ে যেতে হবে। যা কারো জন্যই ভালো নয়।'
জোবরা গ্রামের জনগণপাড়ার বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন পেশায় দিনমুজুর। তার ঘরের টিনগুলো কোপানো হয়েছে। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'দুপুরে ভাত খেতে এসেছিলাম। হুট করে হামলা হয়। ছোট দুটো বাচ্চাকে নিয়ে বিল পেরিয়ে একটি পাকা ঘরে অবস্থান নিয়েছি।'
জনগণপাড়া সমাজের সর্দার মোহাম্মদ নাছের উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, 'আমার বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়েছে। দোকানের সিগারেটগুলো নিয়ে গেছে। এই এলাকার অনেক জায়গায় হামলা চালানো হয়েছে। আমরা ঘরে তালা দিয়ে বসেছিলাম।'

জোবরা গ্রামের পশ্চিম পাড়ার দিলোয়ারা বেগম বলেন, 'ফ্রিজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। মুরগি নিয়ে গেছে। আলমারি ভেঙেছে। আমরা তো নিরপরাধ।'
একই এলাকার আব্দুর রহিম বলেন, 'আমার গোয়াল থেকে দুটি গরু নিয়ে গিয়েছিল। এরপর একটি ছেড়ে দিয়েছে। আরেকটি গরু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে আনা হয়েছে।'
গৃহবধূ লামিয়া ইসলামের অভিযোগ, রোববার সকালে দুজন শিক্ষার্থী আমাদের বাসায় বাথরুমে ঢুকে পড়েছিল। তাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে আমাদের ঘর ঘেরাও করে ভাঙচুর করা হয়েছে।

ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আব্দুল কাদের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'দুই শতাধিক ঘরবাড়ি ও দোকানপাট আক্রান্ত হয়েছে। একটি নোহা গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। চারটি মোটর বাইক পোড়ানো হয়েছে। চারটি সিএনজি চালিত অটোরিকশা ভাঙচুর, একটি পোড়ানো এবং একটি ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা ভাঙচুর করা হয়েছে। দোকানপাট, ঘর-বাড়িতে লুটপাট চালানো হয়েছে।'
এ বিষয়ে জানতে হাটহাজারী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু কাওসার মোহাম্মদ হোসেনকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
তবে চট্টগ্রাম জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিল্প ও ডিবি) মোহাম্মদ রাসেল বলেন, জোবরা গ্রামে ঘরবাড়ি আক্রান্তের খবর শুনেছি। তবে সংখ্যা কত, তা আমাদের কাছে নেই। ভুক্তভোগীরা অভিযোগ দিলে হয়তো জানা যাবে।