পশ্চিমাঞ্চল অর্থনৈতিক করিডর: ধীর গতিতে আটকে গেছে বড় স্বপ্ন

তহবিল আছে, বৈশ্বিক দুটি দাতাসংস্থা দিয়েছে ২.৪ বিলিয়ন ডলার অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি। তবু দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রুটের সংযোগ স্থাপনের হাই-প্রোফাইল উদ্যোগ– ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডরের প্রথম পর্যায় অনুমোদনের তিন বছর পরেও – ভৌত নির্মাণকাজ শুরুই হয়নি।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ যশোর-ঝিনাইদহ দুই লেনের ৪৮ কিলোমিটার সড়ককে- ছয় লেনের মহাসড়কে রুপান্তরের চেষ্টা যেন থমকে পড়েছে। দেশের অন্যান্য বড় প্রকল্পগুলোয় যেসব বাধা দেখা দেয়– ভূমি অধিগ্রহণ ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় নানান জটিলতা– সেই একই কারণগুলোকে আবারো এই দেরির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। এতে বাস্তবায়ন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হবে দেশের জনগণ ও অর্থনীতি।
মাত্র তিন শতাংশ আর্থিক অগ্রগতি হওয়ায় ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডর অ্যান্ড রিজিওনাল এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (উইকেয়ার) এই অঙ্গটি বাস্তবায়নের জন্য ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পরিকল্পনার আওতায়, এই করিডরের প্রায় ২৬০ কিলোমিটার স্থানীয় সড়ক ও হাইওয়ে নেটওয়ার্ককে দুটি স্থলবন্দর – বেনাপোল ও ভোমরা – এবং একটি সমুদ্রবন্দর মোংলার সাথে যুক্ত করার কথা রয়েছে।
করিডর উন্নয়নে প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে বিশ্বব্যাংক ১.৪ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আরো ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। বাকিটা অর্থায়ন করবে সরকার।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-র কর্মকর্তারা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, এসব তহবিল উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ – সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে ঈশ্বরদী ও ঝিনাইদহ হয়ে যশোর পর্যন্ত, এবং নাভারন থেকে সাতক্ষীরা হয়ে ভোমরা স্থলবন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত করিডরের উন্নয়ন কাজে সাহায্য করবে।
ধাপে ধাপে এর বাস্তবায়ন কাজ করা হবে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে সরকারের প্রস্তুতকৃত এক প্রকল্প নথিতে বলা হয়েছে, বাস্তবায়নে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
প্রত্যাশিত সুফলগুলো কী
দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বাণিজ্যের বিকাশে এই অর্থনৈতিক করিডরের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রকল্প নথিতে বলা হয়েছে, বাণিজ্যের তিনটি গেটওয়ে – দুটি স্থলবন্দর ও একটি সমুদ্রবন্দর থাকায় দেশের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চল – আঞ্চলিক বাণিজ্যের পাশাপাশি ভারত, নেপাল ও ভূটানের সাথে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্যেও কেন্দ্রীয় অঞ্চল।
পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রস্তাবিত ওয়েস্টার্ন করিডরটি সাউথ এশিয়ান সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো-অপারেশন (সাসেক) রোড করিডর-৪ এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাবান্ধা আর বুড়িমারী স্থলবন্দরের সঙ্গে ভারত, ভূটান ও নেপালের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে ভূমিকা রাখছে করিডরটি।
বাংলাদেশের পশ্চিম অংশে একটি পরিবহন করিডর ধরে যোগাযোগ ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নতির লক্ষ্যে নেওয়া এই প্রকল্পে রয়েছে ১০টি জেলা– যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, পাবনা, নাটোর, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও সিরাজগঞ্জ।
বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সড়কটির উন্নয়ন কাজ শেষ হলে গাড়ি পরিচালনার ব্যয় কিলোমিটারে ২০ শতাংশ কমবে। রাস্তায় গতি বৃদ্ধির কারণে ভ্রমণে সময় কমবে প্রায় ১৫ শতাংশ।
এই করিডরের প্রায় ২৬০ কিলোমিটার রাস্তাকে দেশের প্রথম স্মার্ট হাইওয়েতে রূপান্তরের কথা রয়েছে। যেখানে দেশে প্রথমবারের মত স্থাপন করা হবে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস)। এতে সিসিটিভির মাধ্যমে যানবাহনের গতিবিধি সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের ফলে সড়ক নিরাপত্তা বাড়বে।
সড়কগুলো চার বা ছয় লেনে উন্নীত করলে ভোমরা, বেনাপোল বন্দর হয়ে ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বাড়বে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এর পাশাপাশি, মোংলা সমুদ্র বন্দরের সংযোগ উন্নত হওয়ায় বহির্বাণিজ্যের সুযোগও বাড়বে বলে মনে করেন তারা।
সড়ক উন্নয়ন বা নির্মাণের সময় ইউটিলিটি ডাক্ট স্থাপন করা হলে বছরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ হবে। পুরো সড়কে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপনের পরিকল্পনা থাকায় ডিজিটাল কানেকটিভিটিতেও করিডরটি ভূমিকা রাখবে বলে সরকারের পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর প্রকল্প দলিলে দাবি করা হয়েছে।
পরিকল্পনায় যা রয়েছে, কারা অর্থায়ন করবে
সড়ক ও জনপথ অধিদফতর সূত্র জানায়, মোট চারটি ভাগে ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডর প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন হবে।
এর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে যশোর থেকে ঝিনাইদহ পর্যন্ত ৪৮.৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে ৪,১৮৭.৭০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্প অনুমোদন করা হয় ২০২০ সালের নভেম্বরে। এতে ২,৭০৫.৬৫ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।
নাভারন থেকে সাতক্ষীরা হয়ে ভোমরা স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫৮ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রায় ৫,০০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে পৃথক একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। তবে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, প্রাথমিক নকশাসহ প্রকল্প প্রস্তাবনার কাজ এখনও শুরু হয়নি।
ঝিনাইদহ থেকে ভোমরা পর্যন্ত দুই পর্যায়ে ১০৬.৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে মোট ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। মূল করিডরের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক উন্নয়নেও এর একটা অংশ ব্যয় হবে।
এ ছাড়া প্রস্তাবিত ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডরের ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়া হয়ে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত ৯৯.৪২ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে পৃথক একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এতে প্রায় ৬,৯৮০ কোটি টাকা ঋণ দেবে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। ২০২৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এর কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।
গত সপ্তাহে এই প্রস্তাবের বিষয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা করেছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। এতে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, কিছু সুপারিশ মানার শর্তে প্রকল্প প্রস্তাবটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর ব্যাপারে সভায় ঐক্যমত্য হয়েছে।
এ বিষয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, পরিকল্পনা কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে, সেই অনুযায়ী কাজ হবে।
সওজ সূত্র জানায়, পুরো করিডরটির শেষ অংশ হিসেবে বনপাড়া থেকে হাটিকামরুল পর্যন্ত ৫৪.০৮ কিলোমিটার সড়কের কাজ করা হবে সর্বশেষ পর্যায়ে। সব মিলে প্রায় ১৫৩ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি দেবে এআইইবি।
অগ্রগতি মন্থর কেন
মাত্র ১০ বছরে পুরো ২৬০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কথা থাকলেও পরামর্শক নিয়োগ, প্রয়োজনীয় সমীক্ষা ও ডিটেইল ডিজাইনে বিলম্ব; ভূমি অধিগ্রহণে জটিলতা আর ভৌত কাজের ঠিকাদার নিয়োগ না হওয়ায় প্রথম পর্যায়ের কাজ এখনও শুরু হয়নি।
উইকেয়ার প্রোগ্রামের প্রথম পর্যায়ের পরিচালক জাবিদ হাসান টিবিএসকে বলেন, সাম্প্রতিক সভার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে ভূমি সংক্রান্ত জটিলতার অবসান করা হচ্ছে। ভৌত কাজের ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি করতে তিনটি প্রস্তাব সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। চুক্তি সই সাপেক্ষে চলতি বছরের মধ্যেই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
বর্ধিত মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
কিন্তু, এর চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান।
তিনি বলেন, স্মার্ট অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তুলতে যতোটা স্মার্ট পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল, বাস্তবে তা দেখা যায়নি। এ কারণেই তিন বছর পরেও প্রথম পর্যায়ের কাজ শুরু করা যায়নি।
হাদিউজ্জামান বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর পর্যায়েই ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্রয় প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করতে হয়। অথচ প্রকল্পটি অনুমোদনের তিন বছর পরও ভূমির জটিলতার কথা বলা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, এই ব্যবস্থাপনার অধীনে ১০ বছরে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন তিনি।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এর নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, 'সড়কগুলোকে করিডরে রুপান্তর করতে আমাদের সাফল্য বেশ কম। সাসেক-২ সড়ক প্রকল্প কিছুটা অগ্রগতি দেখিয়েছে, তবে বার বার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর পরেও এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাজ বাকি রয়েছে।'
তিন বছরেও ওয়েস্টার্ন ইকোনমিক করিডর প্রোগ্রামের আওতায় ৪৮.৫ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়নের কাজে তেমন অগ্রগতি না থাকার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'শেষপর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ আবার বাড়াতে হবে, ফলে এই উদ্যোগের অধীন অন্যান্য প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও অনাকাঙ্খিত বিলম্বের আশঙ্কা রয়েছে।'
সেলিম রায়হান বলেন, অবকাঠামো প্রকল্পের বিলম্ব হলে সরকারকে বাজেট বাস্তবায়নে অতিরিক্ত ব্যয় করতে হয়। এ ধরনের দেরির ফলে কাঙ্ক্ষিত সুবিধাভোগীরা প্রকল্পের সুফল বঞ্চিত হয়, এতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থনৈতিক ও আর্থিক ক্ষতি হয়।