আইএমএফ এর শর্তের মধ্যেও জানুয়ারি-মার্চে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা।
৪.৭ বিলিয়ন ডলারের আইএমএফ ঋণের কিস্তি ছাড়ের জন্য নির্ধারিত শর্ত মানতে যেয়ে এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে দেশের ব্যাংকিং খাত। এরমধ্যেও কমছে না খেলাপি ঋণ।
মার্চ মাসে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১,৩১,৬২০ টাকা, যা মোট বকেয়া ঋণের ৮.৮০%।
গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১,২০,৬৫৬ কোটি টাকা; মোট বকেয়ার ৮.১৬%।
ব্যাংকাররা বলেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রপ্তানিকারকরা শিপমেন্ট বিলম্ব, অর্ডার বাতিল, বায়ারদের অর্থপ্রদানের বিলম্ব এছাড়া গ্রাহকের মেয়াদী ঋণ পরিশোধে বিশেষ ছাড় উঠে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩ এর মার্চ শেষে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৭৯৫৮ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ১৯.৮৭%। যদিও গত ২০২২ এর ডিসেম্বরে তাদের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৬৪৬০ কোটি টাকা।
এই হিসাবে চলতি বছরের মার্চে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯২২১ কোটি টাকা।
এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ২০২৩ এর মার্চ শেষে দাঁড়িয়েছে ৬৫৮৮৮ কোটি টাকা যা মোট ঋণের ৫.৯৬%। আগের প্রান্তিক ২০২২ এর ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ৫৬৪৩৪ কোটি টাকা। সে হিসেবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯৪৫৪ কোটি টাকা।
যদিও অর্থঋণ আদালতে ব্যাংকগুলোর ১,৬৬,৮৮৬ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। এই ঋণগুলোও ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল যা রাইট আপ করে ব্যালেন্স শীট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
বছরের শুরুতে কেন খেলাপি ঋণ বাড়ে?
ব্যাংক এশিয়া সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী টিবিএসকে বলেন, "অনেক গ্রাহক লোনের টাকা পরিশোধে নানা কারণে ডিলে করে। ব্যাংকগুলো ওইসব গ্রাহকদের থেকে টাকা উত্তোলন জোরদার করতে বছরের শুরুতে অনেক গ্রাহককে খেলাপি করে থাকে।"
"খেলাপি হয়ে গেলে গ্রাহক অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ পেতে নীতিগত সমস্যায় পরে। তাই গ্রাহক খেলাপি মুক্তি পেতে ঋণের টাকা পরিশোধে চেষ্টা করে। যার কারণে বছরের প্রথম প্রান্তিকে দেখা যায় খেলাপি ঋণ বেশি পরিমাণে বাড়ে।"
তিনি আরো বলেন, "ব্যবসায়ীরা বছরের শুরুতে বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়ায়। যদি গ্রাহক খেলাপি থাকে, ডিসেম্বরের দিকে যেকোনভাবে পুনঃতফসিল করতে চেষ্টা করে। কারণ তিনি নিয়মিত গ্রাহক হলে নতুন করে ঋণ পেতে সুবিধা হয়।"
বাংলাদেশের জন্য ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদনের বিষয়ে আইএমএফ কান্ট্রি রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে এই বছরের জুনের মধ্যে ঋণ ক্লাসিফিকেশনে আন্তর্জাতিক প্র্যাক্টিস করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, তারা ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকের গড় নন-পারফর্মিং লোন (এনপিএল) অনুপাত ১০% এর নিচে এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের এনপিএল ৫% এর নিচে নামিয়ে আনবে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রপ্তানিকারকরা শিপমেন্টে বিলম্ব, অর্ডার বাতিল এবং ক্রেতাদের কাছ থেকে দেরিতে অর্থ পাওয়ার মতো সমস্যাতে রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলো স্ট্রেসড সম্পদ বৃদ্ধির সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।"
মাহবুবুর বলেন, "এছাড়াও টাকার উচ্চ অবমূল্যায়ন, জ্বালানি মূল্য বৃদ্ধি, গ্যাসের নিম্নচাপ এবং আমদানি সীমাবদ্ধতা, শিল্প উৎপাদনে ধীরগতি এবং ঋণগ্রহীতাদের ঋণ পরিষেবা ক্ষমতা হ্রাসের কারণে ব্যাংকগুলোকে বিপুল পরিমাণে ফোর্সড ঋণ দেওয়া হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের সমনের দিনগুলোতে খেলাপি ঋণ আরও ডিফিকাল্ট হবে কারণ আমাদের ইম্পোর্ট কমে যাচ্ছে, রেমিট্যান্স কমছে, ইনভেস্টমেন্ট কমছে।"
খেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রকৃত কোন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়না। এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে বলে দাবি করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জা মো. আজিজুল ইসলাম।
তিনি বলেন, "যারা ঋণ নিয়ে পরিশোধ করছেন না তাদের শাস্তি না দিয়ে নানাভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এ কারণে খেলাপিরা ঋণের টাকা শোধ করছেন না। বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে খেলাপি বাড়তে থাকবে। তাই যারা খেলাপি তাদের ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। ঋণ আদায় নিশ্চিত করতে হবে। যারা ঋণ পরিশোধ করবে না তাদের শাস্তি দিতে হবে।"
ঋণ পুনর্নির্ধারণ নীতির প্রভাব
গত বছরের অক্টোবর এবং ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কমেছে ১৩,৭৪০ কোটি টাকা। নতুন ঋণ পুনর্নির্ধারণ নীতি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পরিশোধ শিথিল করায় এটি সম্ভব হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মার্চে ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বাড়ে কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন বছরের শুরুতে ব্যাংকগুলোতে অডিট করে।
"এর মাঝের সময়টায় অনেক ব্যাংক কিছু খেলাপি ঋণ গোপন করে যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অডিটে উঠে আসে। সেই ঋণগুলো নতুন বছরের প্রথম প্রান্তিকে খেলাপির তালিকায় দেখাতে হয়, এ কারণে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে," বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, গ্রাহকরা কোভিডের কারণে ২০২০-২০২১ সালে ঋণ পরিশোধে ছাড় পেয়েছে। ২০২২ এর ভিন্ন ভিন্ন আকারে ঋণে পরিশোধের ছাড় ছিল। তবে ২০২৩ এ গ্রাহকদের ঋণ পরিশোধে পুরোপুরি ছাড় উঠে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে।
গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ কমার অন্যতম কারণ হিসেবে এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, বহিঃবিশ্বে যুদ্ধাবস্থা প্রলম্বিত হওয়ায় এর দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক প্রভাবে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি বিবেচনায় গত বছরের ডিসেম্বর প্রান্তিকে মেয়াদী ঋণের বিপরীতে মাত্র ৫০% পরিশোধ করলেই খেলাপি থেকে মুক্তির সুযোগ ছিল; এ বছর আর সে নিয়ম নেই।