বিলাসবহুল পণ্যে শুল্ক বাড়ানোর পক্ষে আইএমএফ, সরকারি বিনিয়োগ কমা নিয়ে প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিলাসবহুল পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সুপারিশ করেছে।
চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট সময়ে এবং আগামী অর্থবছরের জন্য রাজস্ব আহরণে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের শর্ত দিয়েছে বহুপাক্ষিক ঋণদাতা সংস্থাটি। শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশকে এ অর্থবছরের বাকি সময়ে প্রতি মাসে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করতে হবে।
তবে, প্রস্তাবিত কর বৃদ্ধির বিষয়টি কেবল আমদানি পর্যায়ে প্রযোজ্য হবে না-কি বিলাসবহুল পণ্যের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ উভয় পর্যায়েই এটি প্রযোজ্য হবে—সে বিষয়ে আইএমএফ নির্দিষ্ট করে কিছু বলেনি।
এসবের পাশাপাশি আইএমএফ বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে সরকারি বিনিয়োগ কেন কমছে, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে।
সোমবার (৭ এপ্রিল) ঢাকায় এনবিআরের সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল আর্থিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
বর্তমানে, দেশে বিলাসবহুল যানবাহনের ওপর আমদানি শুল্ক সর্বোচ্চ ৮০০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে—যা বৈশ্বিক পর্যায়ে অন্যতম সর্বোচ্চ হার। একইভাবে, মদ ও সিগারেটের ওপর সর্বোচ্চ আমদানি শুল্ক ৬০০ শতাংশ পর্যন্ত উঠতে পারে।
বিলাসবহুল পণ্যের শ্রেণিভুক্ত অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে প্রসাধনী, গয়না, ব্র্যান্ডেড পোশাক, জুতা, কিছু ইলেকট্রনিক গ্যাজেট এবং সাজসজ্জার সামগ্রী।
বৈঠকে ছয় সদস্যের আইএমএফ দল সুপারিশ করেছে যে, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিদ্যমান ভ্যাট ও আয়কর ছাড় পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা উচিত।
তারা সর্বত্র ১৫ শতাংশ হারে একটি আদর্শ ভ্যাট হার প্রবর্তনের পাশাপাশি বিদ্যমান ন্যূনতম কর ব্যবস্থাও বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বৈঠকে আইএমএফের উপস্থাপনায় বলা হয়েছে, 'এই ব্যবস্থাগুলি বাস্তবায়নের পরেও যদি রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হয়, তাহলে বিলাসবহুল পণ্যের ওপর আবগারি শুল্ক আরও বাড়ানোর সম্ভাবনা বিবেচনা করা যেতে পারে।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে এ সুপারিশের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, 'এই সুপারিশটি অন্যান্য পরামর্শের পাশাপাশি করা হয়েছে। আমরা এটি পর্যালোচনা করব।'
অর্থনীতিবিদরা নীতিগতভাবে এই প্রস্তাবকে সমর্থন করলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ এবং রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড)-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক টিবিএস-কে বলেন, 'রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনে বিলাসবহুল পণ্যের ওপর কর বাড়ানো যেতে পারে। তবে আমদানিকৃত ও দেশীয় উত্পাদিত বিলাসবহুল পণ্যের ওপর সমানভাবে সম্পূরক শুল্ক প্রয়োগ করা উচিত।'
তিনি আরও বলেন, বিলাসবহুল পণ্যের সংজ্ঞা স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা জরুরি।
আরেক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ মোস্তফা আবিদ খানও একই মত প্রকাশ করে টিবিএস-কে বলেন, 'বিলাসবহুল পণ্যের ওপর কর বাড়ানো হলে, তা আমদানিকৃত ও দেশীয়—উভয় পণ্যের ওপরই সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিত। অন্যথায়, এটি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিমালার পরিপন্থী হবে।'
আইএমএফ মেয়াদোত্তীর্ণ কর ছাড় বহাল রাখার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তারা সুপারিশ করেছে, ধাপে ধাপে বর্তমান কর ছাড় বাতিল করে হ্রাসকৃত হারের পরিবর্তে সর্বজনীনভাবে একটি আদর্শ ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার প্রয়োগ করা হোক।
চ্যালেঞ্জিং হতে পারে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা
চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এনবিআর ২ লাখ ১৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে—যা গড়ে প্রতি মাসে ২৭ হাজার কোটির সামান্য বেশি।
আইএমএফ চলতি অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা জিডিপির ৭.৯ শতাংশ। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আগামী চার মাসে গড়ে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা মাসিক আদায় করতে হবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও, পরের বছরের লক্ষ্য পূরণে উল্লেখযোগ্য হারে অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন হবে—যা অতীতে দেশে কখনো অর্জিত হয়নি।
এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অবাস্তব। ওয়াশিংটনভিত্তিক ঋণদাতা সংস্থা আইএমএফ আগামী অর্থবছরের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৫৭ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের শর্ত দিয়েছে—মূলত কর অব্যাহতি হ্রাস এবং করহার বৃদ্ধির মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে।
এনবিআরের এক কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'পূর্ববর্তী কর-জিডিপি অনুপাতের ভিত্তিতে আইএমএফ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব।'
তিনি আরও বলেন, জানুয়ারিতে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বৃদ্ধির পর পুনরায় ভ্যাট বাড়ালে কেবল করহার বৃদ্ধি করেই প্রয়োজনীয় রাজস্ব আদায় সম্ভব হবে না।
'আমরা জুলাইয়ের পর দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের [আইএমএফ] অবহিত করেছি এবং তারা এসব চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে অবগত। তবে লক্ষ্যমাত্রা পুনর্বিবেচনার বিষয়ে এখনো তারা কোনো আশ্বাস দেয়নি,' বলেন তিনি।
ওই কর্মকর্তা আরও জানান, সরকারের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধিরা চলতি মাসে ওয়াশিংটনে আইএমএফ বোর্ডের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিষয়টি উপস্থাপন করবেন।
সরকারি বিনিয়োগ কমার বিষয়ে আইএমএফ-এর প্রশ্ন
আইএমএফ বাংলাদেশের কাছে সরকারি জনবিনিয়োগ কমে যাওয়ার ব্যাখ্যা চেয়েছে। সংস্থার একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের প্রোগ্রামিং বিভাগের সঙ্গে এক বৈঠকে এ প্রশ্ন তোলে।
বৈঠকে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের রাজস্ব আহরণের ভিত্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার নির্ধারণ করে। ফলে, এই বিষয়ে নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিতে কেবল অর্থ মন্ত্রণালয়ই সক্ষম।
তারা আরও জানান, বাস্তবায়ন সক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণেও কখনো কখনো সরকারি বিনিয়োগ কমে যায়। এ কারণে প্রায়ই বছরের মাঝামাঝি সময়ে সংশোধিত এডিপি বরাদ্দ হ্রাস পায়। প্রায় প্রতি অর্থবছরেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে বলে আইএমএফকে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
বৈঠকে পরিকল্পনা বিভাগের সচিব, প্রোগ্রামিং বিভাগের সদস্য ইকবাল আবদুল্লাহ হারুন এবং বিভাগের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গত মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) চলতি অর্থবছরের মূল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার এডিপি বরাদ্দ কমিয়ে সংশোধিত বরাদ্দ নির্ধারণ করেছে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি বরাদ্দ দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ১১.৮৩ শতাংশ কম। সাধারণত প্রতি বছর সংশোধিত বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ে, কিন্তু এবার তা কমেছে। গত অর্থবছরে সংশোধিত এডিপি বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
সূত্র মতে, গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে বাস্তবায়ন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। বরাদ্দ হ্রাসের পাশাপাশি বরাদ্দকৃত তহবিলের বাস্তব ব্যয় নিয়েও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে আইএমএফ সরকারকে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প থেকে বিরত থাকতে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানায়।
এর জবাবে পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, উন্নয়ন প্রকল্পে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নতুন প্রকল্প অনুমোদনের আগে জনমত যাচাইয়ের জন্য একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে।
স্বচ্ছতা আরও বাড়াতে প্রতিটি চলমান প্রকল্পের আপডেট তথ্য এএমএস সফটওয়্যারে অন্তর্ভুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এছাড়া, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তদারকি জোরদারে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের অধীনে একটি নতুন অধিদপ্তর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত কার্যকর নজরদারি সম্ভব হবে।
এছাড়া সরকারি ক্রয় আইন সংশোধনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলেও জানান কর্মকর্তারা, যার মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নের চূড়ান্ত পর্যায়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
আইএমএফের সুপারিশ অনুযায়ী পরিবেশগত বিষয়গুলোকেও অগ্রাধিকার দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শুল্ক আরোপ নিয়ে আলাদা বৈঠকে আলোচনা
এদিকে, আইএমএফ প্রতিনিধিদল আজ বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে একটি পৃথক বৈঠকে বসে। বৈঠকে তারা জানতে চান, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে কি না।
তারা আরও জানতে চান, রপ্তানি আয়ে সম্ভাব্য হ্রাস দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, বাণিজ্য সচিব আইএমএফ প্রতিনিধিদের অবহিত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ফলে যাতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।