আইএমএফের খেলাপি ঋণ নীতি বাস্তবায়নে বাড়তি সময় চাইতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক

আগামী ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়ার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণিকরণের নতুন নীতি, যা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণেরও অংশ। তবে এই তারিখ নিয়ে আইএমএফের সাথে ফের আলোচনায় যেতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই ব্যাংকখাতের ভঙ্গুর দশা দিন দিন প্রকাশ পাচ্ছে, আর সেই আলোকেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
নতুন নীতিমালা অনুসারে, ঋণ পরিশোধের তারিখের পর তিন মাস কেটে গেলে মন্দ ঋণ (এনপিএল) হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হবে, যা বিদ্যমান ৬ মাসের গ্রেস পিরিয়ডের চেয়ে কম। এটি ব্যাসেল-৩ বৈশ্বিক ব্যাংকিং বিধিমালার সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত হয়েছে। ২০২৩ সালে আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচি গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ব্যাংক যেটি বাস্তবায়নে সম্মতি দিয়েছিল।
কিন্তু, ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকায়— যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণকৃত ঋণের ২০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে গেছে, একবছর আগের চেয়েও এটি ৯ শতাংশ বেশি হওয়ায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও কঠোর নতুন নীতিমালাটি কার্যকরে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক মানদণ্ড কার্যকর হলে, মন্দ বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে; ফলে ২০২৬ সালের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনাও সম্ভব হবে না।
আইএমএফের পর্যালোচনা ও সম্ভাব্য পুনঃআলোচনা
আগামী ১৭-১৯ এপ্রিল ঢাকায় আসার কথা রয়েছে আইএমএফের চতুর্থ পর্যালোচনা মিশনের। এসময় তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সমন্বয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এদিকে আইএমএফের ঋণের তৃতীয় কিস্তি আগামী ফেব্রুয়ারিতে ছাড় হওয়ার কথা থাকলেও— আনুষ্ঠানিক কোনো কারণ দেখানো ছাড়াই পিছিয়েছে সংস্থাটি।
আগামী ২১-২৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ও আইএমএফের বসন্তকালীন সভায় বিষয়টি তুলতে পারেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
ব্যাংকখাতের ঋণমান অবনমন ও তার অর্থনৈতিক প্রভাব
আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি বা ঋণমাণ নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস, সম্পদের মানে অবনতির কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের অবনমন করেছে। কিন্তু, আরও কঠোর ঋণ শ্রেণিকরণের নীতিমালা এই অবস্থার আরও অবনতি করবে, আরও ব্যবসাবাণিজ্য খেলাপিতে পরিণত হবে অর্থনৈতিক গতিমন্থরতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে।

তবে ব্যাসেল-৩ এর বাস্তবায়ন বাংলাদেশ একাই পেছাতে চায় তা নয়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাড়তি সময় চেয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাই থেকে এটি অনুসরণ করবে আমেরিকান ব্যাংকগুলো, যেখানে তিন বছরের ট্রাঞ্জিশন পিরিয়ড থাকবে। অন্যদিকে মাঝারি আকারের ব্যাংকগুলোর ওপর চাপ কমাতে ব্যাসেল-৩ এর কিছু বিধিবিধান স্থগিত করেছে ইইউ। আন্তর্জাতিক এসব ঘটনাপ্রবাহের সূত্র ধরে বাংলাদেশের পক্ষেও এনিয়ে আলোচনার যুক্তি জোরালো হয়েছে।
খেলাপি ঋণ ছাড়াতে পারে ৫ লাখ কোটি টাকা
গতবছর বাংলাদেশের খেলাপি ঋণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে যার পৌঁছায় ৩ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকায়। এরমধ্যে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার খেলাপি প্রকাশ পায় আগস্টে সরকার পরিবর্তনের ছয় মাসের মধ্যেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক মুদ্রানীতিতে প্রক্ষেপণ রয়েছে, মোট বিতরণ করা ঋণের ৩০ শতাংশ এবং ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়াতে পারে খেলাপি ঋণ। এর পেছনে ভূমিকা রেখেছে, বিগত সরকারের সময়ে ব্যাংকখাতে দুর্বল নিয়ন্ত্রণ, কাঠামোগত অদক্ষতা এবং অর্থপাচার ও বিদেশে পুঁজি পাচারের মতো অবৈধ আর্থিক চর্চা।
এরমধ্যে সম্পদ মানের অবনতি নিয়ে ঘনীভূত সংকট— দেশের ব্যাংকখাতের ভাবমূর্তিকে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ফলে স্থানীয় ব্যাংকগুলোর পক্ষে বিদেশি ব্যাংকের ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে বলে জানান ওই কেন্দ্রীয় ব্যাংকার।
অতীতে বৈশ্বিক মানদণ্ড থেকে বিচ্যুতি ও তার পরিণাম
বৈশ্বিক ঋণ শ্রেণিকরণের বিধিমালা প্রথমে ২০১২ সালে অনুসরণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, যেখানে নির্দিষ্ট তারিখে ঋণের কিস্তি পরিশোধ নাহলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ, এবং তিন মাস পর থেকে খেলাপি হিসেবে শ্রেণিকরণ করা হতো। তবে ২০১৯ সালে ৬ মাসের গ্রেস পিরিয়ডের শিথিল একটি নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যার সুবাদে কোনো ঋণ মন্দ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার আগে ৯ মাস পর্যন্ত সময় পেতেন খেলাপিরা।
ব্যাসেল-৩ মানদণ্ড অনুসরণ থেকে এই সরে আসার কারণে ব্যাংকগুলো কাগজেকলমে বিপুল খেলাপি ঋণ এড়াতে পেরেছিল। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি, আর্থিক স্বাস্থ্যের দৈন্যদশার কারণে গত এক দশকের মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংক ধসে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌছেঁছে। তাছাড়া, ২০১২ সালের ঋণ পুনঃতফসীলিকরণ নীতিমালার আওতায়— খেলাপিরা তিনবার পর্যন্ত ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ পান, এভাবে ব্যাংকগুলো তাঁদের মন্দ ঋণ সম্পদকে লুকাতে পেরেছে।
তবে এসব ছাড়ের পরেও— বৈশ্বিক রেটিংস সংস্থাগুলো তখন বাংলাদেশের ব্যাংকখাতের ঋণমান অবনমন করেনি। তবে খেলাপি ঋণ বিপুল হারে বাড়ায় এবং আরও কঠোর নীতিমালার আশু বাস্তবায়নকে ঘিরে— ঋণমানের আরও অবনমনের আশঙ্কা রয়েছে।
তাই বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের যে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার ফলাফলের ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে দেশের আর্থিকখাতের স্থিতিশীলতার ভবিশ্যৎ গতিপথ। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক বিধিমালার প্রতিপালন নিশ্চিত করার সঙ্গে অর্থনৈতিক বাস্তবতার ভারসাম্য রক্ষা করাটাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।