দেশের রপ্তানি আয় কমার ব্যাপারে সতর্ক করল আইএমএফ দল, পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান

বাংলাদেশকে মঞ্জুর করা ৪.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ কর্মসূচির অধীনে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফর মিশন শেষ হয়েছে রোববার (৭ মে)। গত ২৫ এপ্রিল সফরে আসা দলটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়া অন্যান্য প্রায় সবক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য জুনের সময়সীমার ব্যাপারে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে গেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দেশের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোর অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার প্রেক্ষাপটে আগামীতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আরও কমার আশঙ্কা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বলেছে, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নির্ধারিত ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভের শর্ত পূরণ করতে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট এর ঘাটতি কমাতে হবে।
এছাড়া, আইএমএফ এর দেওয়া ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের চুক্তিতে আগামী জুন ও সেপ্টেম্বরের মধ্যে যেসব শর্ত বাস্তবায়নে সরকার রাজি হয়েছে, সেগুলো সময়মত বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েছে সংস্থাটির প্রথম রিভিউ মিশন।
রোববার (৭ মে) সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে রযাত প-আপ মিটিংয়ে আগামী নভেম্বরে দ্বিতীয় কিস্তি পাওয়ারা আগে যেসব শর্ত র্পূরণ করার কথা রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে জোর দিতে বলেছে সংস্থাটি।
সভায় উপস্থিত ছিলেন, অর্থ বিভাগের এমন একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ আইএমএফ এর শর্ত অনুযায়ী ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা সম্ভব হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে আইএমএফকে জানানো হয়েছে।"
ঋণের শর্ত বাস্তবায়ন পরিস্থিতি প্রথমবারের মতো রিভিউ করতে দুই সপ্তাহের সফরে গত ২৫ এপ্রিল ঢাকায় আসে আইএমএফ'র ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। বাংলাদেশে অবস্থানকালে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক সভা শেষে গতকাল (৭ মে) ঢাকা ছেড়েছেন আইএমএফ কর্মকর্তারা।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তা জানান, ঋণ প্রোগ্রামে জুনের মধ্যে যেসব শর্ত পূরণ করার কথা রয়েছে, সেগুলো অর্জনের জন্য সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে আইএমএফ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। তবে জুনের মধ্যে নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সংস্থাটির।
আইএমএফ বাংলাদেশকে সতর্ক করে বলেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে এবং মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। ফলে আগামী দিনে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় আরও কমতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
রোববার আইএমএফ'র জারি করা এক বিবৃতিতে প্রতিনিধি দলের নেতা রাহুল আনন্দ বলেন, "অবিরাম মূল্যস্ফীতির চাপ, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রধান বাণিজ্য অংশীদার দেশগুলোর অর্থনীতিতে ধীরগতি বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং টাকার মানের ওপর প্রভাব ফেলবে।"
একইসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, এমন চ্যালেঞ্জিং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর মধ্যে একটি।
আইএমএফ কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয়কে বলেছে, ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত ০.৫ শতাংশ বাড়ানো কিংবা ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি কমাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে, তা এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবহিত করলেও কোন পদ্ধতিতে ওইসব পদক্ষেপ কার্যকর করা হবে, তা জানায়নি সংস্থা দুটি।
এ প্রেক্ষাপটে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা বলেছেন, আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে। "বাজেট প্রস্তাবের আগে তা উন্মুক্ত করা যৌক্তিক হবে না।"
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক রোববার টিবিএসকে জানান, আকুর বিল পরিশোধ করার পর বাংলাদেশের গ্রস বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ ২৯.৭৬ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে।
"তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বকেয়া কিস্তি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আওতায় বিতরণ করা ঋণসহ বিভিন্নখাতে ব্যয় করা বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ বাদ দিলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ হবে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার," বলেন তিনি।
আইএমএফ'র ঋণ চুক্তি অনুযায়ী, গত মার্চে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ ২২.৯৫ বিলিয়ন ডলার থাকার কথা ছিল, যা অর্জন করতে পারেনি সরকার। আগামী জুনের লক্ষমাত্রাও অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।
আগামী নভেম্বরে আইএমএফ'র ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে সেপ্টেম্বরে আবার রিভিউ করতে আসবে আইএমএফ মিশন। তার আগেই সংস্থাটির শর্ত অনুযায়ী নিট রিজার্ভ ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলার হতে হবে; আর ডিসেম্বরে উন্নীত হতে হবে ২৬.৮১ বিলিয়ন ডলারে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তা জানান, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী মার্চ মাস থেকে রূপপুর প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের আসল ও সুদ বাবদ ৩২৯ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে আলাদা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বকেয়া সুদ ও আসল পরিশোধের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।