ট্রাম্পের অবমাননার রাজনীতি: বিরুদ্ধে গেলেই বিতর্কিত এআই ভিডিও থেকে শুরু করে সবকিছুকে হেয় করার ‘নেশা’

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্মিত এক বিতর্কিত ভিডিও প্রকাশ করে মার্কিন রাজনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। ভিডিওটিতে ট্রাম্প নিজেকে এমন এক 'রাজা' হিসেবে উপস্থাপন করেন, যিনি কিনা স্বীয় সমালোচক নাগরিকদের ওপর 'মলত্যাগ' করছেন। তার শাসনপদ্ধতি ও সমালোচকদের প্রতি এই ধরনের 'উচ্চমার্গের' দৃষ্টিভঙ্গি অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।
গত শনিবার দেশজুড়ে 'নো কিংস' (No Kings) শীর্ষক ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে পড়ে ট্রাম্প তার নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে একটি এআই-জেনারেটেড ভিডিও পোস্ট করেন। ভিডিওটিতে দেখা যায়, মুকুট পরা ট্রাম্প 'কিং ট্রাম্প' লেখা এক 'টপ গান' স্টাইলের যুদ্ধবিমান চালাচ্ছেন। টাইমস স্কয়ারের ওপর দিয়ে ট্রাম্পের বিমান উড়ে যাচ্ছে এবং বিক্ষোভকারীদের ওপর তরল বোমা ঢালছে। ব্যাকরাউন্ডে বাজছে কেনি লগিনসের জনপ্রিয় গান 'ডেঞ্জার জোন'।
বিমানটি আমেরিকান শহরগুলোর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, যেখানে অসংখ্য বিক্ষোভকারী জড়ো হয়েছেন। আর 'রাজকীয়' বিমান থেকে তাদের ওপর নির্দ্বিধায় বাদামি রঙের তরল বর্ষণ করা হচ্ছে। হোয়াইট হাউসের যোগাযোগ পরিচালক স্টিভেন চেউং সানন্দে ভিডিওটি শেয়ার করে আরও বিতর্ক উসকে দিয়ে লেখেন যে, প্রেসিডেন্ট 'নো কিংস' পরাজিতদের ওপর 'মলত্যাগ' করছেন!
এর আগেও তিনি এআই ব্যবহার করে একটি টিকটক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন যেখানে দেখানো হয়, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসি গ্যাবার্ড সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলার পর এআইয়ের তৈরি ভিডিওটি শেয়ার করেন ট্রাম্প।
তবে ট্রাম্প যে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে অবজ্ঞা করেন, অথবা আমেরিকান শহরগুলোকে দমনযোগ্য উপনিবেশ হিসেবে দেখেন, তা অবশ্য নতুন কোনো বিষয় নয়। অতীতে তিনি সামরিক বাহিনীকে বলেছিলেন, বিদেশি অভিযানের জন্য মার্কিন শহরগুলোকে 'প্রশিক্ষণ ক্ষেত্র' হিসেবে ব্যবহার করা উচিত।
এছাড়াও, তিনি লস অ্যাঞ্জেলেসসহ অন্যান্য শহরে আতঙ্ক ছড়াতে সেনা ও ফেডারেল এজেন্ট পাঠিয়েছেন। আমেরিকার ডেমোক্র্যাট প্রভাবিত রাজ্যগুলোর বাসিন্দাদের নাগরিক থেকে প্রজায় পরিণত করার প্রেসিডেন্টের এই নিরন্তর প্রচেষ্টা এতই নিয়মিত হয়ে গেছে যে, তা এখন খুব একটা শিরোনামও হয় না – হয়তো স্বাভাবিক বলেই গণ্য করা হয়।
তবে পর্যবেক্ষকদের কাছে যে বিষয়টি বিস্ময়কর, তা হলো ট্রাম্পের এই অবমাননাকর মনোভাবের পাশাপাশি নিজেকে এবং নিজের পদমর্যাদাকে 'স্বেচ্ছায় কলঙ্কিত' করার এই অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা। সাধারণত, অধিকাংশ জাতীয় নেতা স্বেচ্ছায় মল-মূত্রের মতো নোংরা বিষয়ের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেন না। বরং ক্ষমতাবানদের ছোট করতে সাধারণত 'বহিরাগতরাই' এমন কুরুচিপূর্ণ আক্রমণ করে থাকে। শাসকরা নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এই 'অভিজাত' নিয়ম একেবারেই ভিন্ন।
যদিও 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন' (MAGA) শিবিরগুলোতে আত্ম-অবমাননার এক অদ্ভুত বিকৃত আনন্দ যেন সবসময়ই বিদ্যমান। হানা আরেন্ডট বিংশ শতাব্দীর সর্বগ্রাসী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, 'নিষ্ঠুরতা, মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অবজ্ঞা এবং সাধারণ নৈতিকতাহীনতাকে স্বীকার করা বিপ্লবী মনে হয়েছিল, কারণ এটি বিদ্যমান সমাজের দ্বৈততাকে ধ্বংস করে বলে মনে করা হয়েছিল।'
ট্রাম্প এবং তার অনুসারীদের ঘিরেও একই রকম উল্লসিত 'নিহিলিজম' বা শূন্যবাদ দীর্ঘকাল ধরে রয়েছে, যারা প্রায়শই তার অপ্রত্যাশিত উত্থানকে ট্রোলিংয়ের একটি বিশ্ব-ঐতিহাসিক কীর্তি হিসেবে দেখেন – একবিংশ শতাব্দীর সভ্য জগতে যার তুলনা মেলা ভার।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই তার প্রশাসন ঘিরে এক ধরনের টানাপোড়েন দৃশ্যমান। একদিকে, তার মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে জাঁকজমকের প্রতি প্রবল আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়, অন্যদিকে, তিনি ও তার সঙ্গীরা যেন অবচেতনভাবে সবকিছুকে অবমাননা ও অবমূল্যায়ন করার এক গভীর প্রবণতা লালন করেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঐতিহ্যবাহী নান্দনিকতার প্রতি 'প্রগাঢ় শ্রদ্ধা' জানানোর কথা বলা হলেও, বাস্তবে দেখা যায় এক অদ্ভুতুড়ে ভিন্ন চিত্র।
গত আগস্টে ফেডারেল স্থাপত্য বিষয়ক এক নির্বাহী আদেশে আধুনিকতাবাদকে প্রত্যাখ্যান করে ধ্রুপদী নকশার আহ্বান জানানো হয়েছিল, যা 'আমেরিকান স্বশাসনের ব্যবস্থার মর্যাদা, উদ্যোগ, তেজস্বিতা ও স্থিতিশীলতা' ফুটিয়ে তুলবে বলে দাবি করা হয়। অথচ একই সময়ে, হোয়াইট হাউসের ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনকে মার-এ-লাগো-র 'আভিজাত্যপূর্ণ' আঙিনার মতো রূপ দিতে নির্দেশ দেন ট্রাম্প।
সম্প্রতি, হোয়াইট হাউসের ইস্ট উইংয়ের সম্মুখভাগ ভেঙে একটি 'বিশাল বলরুম' তৈরির কাজ ইতোমধ্যেই শুরু করে দেয়া হয়েছে–হয়তো আরও 'রাজকীয়' অনুষ্ঠানের জন্য।
প্রশাসনের প্রভাবশালী নান্দনিকতা প্রাচীনত্ব থেকে নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) থেকে তৈরি সস্তা ও স্থূল উপকরণ (A.I. slop) থেকে এসেছে – যত স্থূল ও অপ্রাপ্তবয়স্ক হবে, ততই ভালো, এমনটাই যেন তাদের মূলমন্ত্র। যেমন, হোয়াইট হাউসের জাপানি স্টুডিও জিবলির অ্যানিমেশন স্টাইলে তৈরি ক্রন্দনরত অভিবাসীর ছবি – কতটা 'সংবেদনশীল'!
গত সপ্তাহে, হাফপোস্ট যখন হোয়াইট হাউসের কাছে জানতে চেয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের আসন্ন বৈঠকের স্থান হিসেবে হাঙ্গেরি কেন বেছে নেওয়া হলো, তখন হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট জবাব দেন, 'তোমার মা করেছে'!
তিনি স্পষ্টতই উদারপন্থী গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধিকে অপমান ও তার বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এর ফলস্বরূপ তিনি নিজেই একজন 'পেশাদার' প্রেস সেক্রেটারির স্থূল ব্যঙ্গচিত্র হিসেবে উন্মোচিত হয়েছেন। প্রশাসন আমেরিকার ২৫০তম বার্ষিকী হোয়াইট হাউসের সাউথ লনে একটি ইউএফসি কেজ ফাইট দিয়ে উদযাপন করার পরিকল্পনা করছে; এটি এমন এক 'অভাবনীয়' ধারণা, যা ২০০৬ সালের ব্যঙ্গাত্মক চলচ্চিত্র 'ইডিয়োক্রেসি' থেকে যেন সরাসরি ধার করা।
তবে ট্রাম্প ও তার সঙ্গীদের সবকিছুকে অবমাননা ও সস্তা করার এই প্রবণতা কেবল একটি স্টাইল বা ফ্যাশন নয়, বরং এর গভীরতর তাৎপর্য রয়েছে। দ্বিতীয় ট্রাম্প প্রশাসনের সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর বিষয়গুলির মধ্যে একটি হলো, দেশের এমন সব শক্তির স্তম্ভের ওপর আক্রমণ, যা তাদের আদর্শের প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জই তৈরি করে না। হোয়াইট হাউস মানবিক সহায়তা খাতে সমর্থন কমাবে, এটা অনুমেয় ছিল, কিন্তু শিশুদের ক্যান্সার গবেষণায় অর্থায়ন বন্ধ করবে, এটা ছিল 'অকল্পনীয়'।
একইভাবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিলুপ্ত করার চেষ্টা করবে, এটা আশা করা গিয়েছিল, কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ফেডারেল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সিকে ধ্বংস করবে না, যা দুর্যোগে আক্রান্ত লাল ও নীল উভয় রাজ্যের সম্প্রদায়গুলোকে সাহায্য করে – এই 'মহৎ' বিষয়টি ছিল বিস্ময়কর।
ট্রাম্প প্রশাসনের অভ্যন্তরে চলমান এই প্রবণতার আংশিক ব্যাখ্যা দেওয়া যায় রাসেল ভাউটের মতো প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পুরনো ধাঁচের 'ক্ষুদ্র সরকার' উন্মাদনা দিয়ে, যিনি হোয়াইট হাউস অফিস অফ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেটের পরিচালক। তবে এর পেছনে ট্রাম্পের নিজস্ব 'আক্রমণাত্মক নিরাপত্তাহীনতা' কাজ করছে বলেও মনে করা হচ্ছে। তার ব্যক্তিত্বের এক অংশ দেশকে মহিমান্বিত করতে চায়, যা কিছুটা তার নিজস্ব স্ফীত আত্ম-ধারণার প্রতিফলনই। আবার তার আরেক অংশ আধিপত্যের সীমাবদ্ধতার প্রতি ক্ষোভ থেকে সবকিছুকে ধ্বংস করতে আগ্রহী।
আগামী মাসে প্রকাশিত হতে যাওয়া রূপক উপন্যাস 'দ্য ইমার্জেন্সি'-তে লেখক জর্জ প্যাকার ট্রাম্পপন্থী ডানপন্থীদের মধ্যে থাকা অবমাননার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেছেন। বইটি মূলত স্ব-ধার্মিক 'Burghers' (শহরবাসী) এবং অসন্তুষ্ট, পরাণোয়ায় ভোগা গ্রামীণ 'Yeoman' (ভূস্বামী) দের মধ্যে সংঘাতের ওপর কেন্দ্র করে আবর্তিত।
ট্রাম্পের সাম্প্রতিক ভিডিওর প্রেক্ষাপটে, উপন্যাসের একটি বর্ণনা বেশ দূরদর্শী মনে হয়, যেখানে ইওমেনরা বার্ঘারদের শহরকে 'মল কামান' দিয়ে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে। এটা যেন মনে করিয়ে দেয়, প্যাকার যেন ক্ষণিকের জন্য প্রেসিডেন্টের 'মনোজগতে' প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
প্যাকার লিখেছেন, 'এতে এমন কিছু উদ্ধত, উদ্ভাবনী ও বর্বর, এমন নিম্নমানের বিষয় ছিল...যা শেষ বাধাও ভেঙে দেবে, আর ফেরার কোনো পথ থাকবে না।'
সম্পদ ও বিশ্বাস নিয়ে বিবাদ মীমাংসা করা সম্ভব। কিন্তু যারা সবার উপরে অন্যদের কলুষিত করতে চায়, তাদের সঙ্গে সখ্যতা কল্পনা করা কি সত্যিই সম্ভব? – প্রশ্নটি থেকেই যায়।