ডাক্তার কতদিন নিধিরাম সর্দার থাকবে?

'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'। কিন্তু এক রমণী অন্য রমণীর সংসারে সুখ বয়ে আনতে পারেন কি? পারলেও কতটুকু! স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃত পরিবর্তন ও সংস্কার অন্য গোত্রের মানুষ দিয়ে আসলেই কি সম্ভব? হলেও বা কতটুকু?
অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে দ্য কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর ১৯৯৮ এর বিশেষ দুটি ধারার মাধ্যমে আমাদের সেনাবাহিনীর কমিশন্ড অফিসারদের দুমাসের জন্য স্পেশাল এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এতে করে উদ্ভূত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আসবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যেহেতু সব খাতের পাশাপাশি স্বাস্থ্যখাতের সংস্কারের বিষয়টিও সামনে এসেছে, সেহেতু আমার ১০ বছর আগের একটি কলামকে আবারো নতুন করে লেখার প্রয়োজন মনে করলাম।
বিসিএসের মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একজন নবীন চিকিৎসক যখন ইউনিয়ন বা উপজেলাপর্যায়ে চিকিৎসা দিতে যান, দুঃখজনক হলেও সত্য যে প্রচলিত সিস্টেম তখন তাকে সিস্টেমে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে। ইচ্ছা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সম্ভব হয় না এই বিসিএস কর্মকর্তার।
অথচ প্রথম শ্রেণির গেজেটেড বিসিএস কর্মকর্তা হিসেবে তার একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা সহকারী সচিবের সমান ক্ষমতা ও দায়িত্বপ্রাপ্তির কথা ছিল। কিন্তু শুধু আউটডোরে বসে প্যারাসিটামল, মেট্রো আর গ্যাসের বড়ি লিখেই একজন নবীন সরকারি কর্মকর্তার মেধা, মনন ও শ্রমের অপচয় করা হয়। এটাই সিস্টেম। অথচ দেশকে তার দেওয়ার ছিল অনেক কিছুই।
একটু পরিষ্কার করে বলা প্রয়োজন।
আমাদের অনেকেরই জানা যে উপজেলা বা গ্রামপর্যায়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য অনিরাপদে পড়ে থাকে কোয়াক এবং ফার্মেসির দোকানদারদের হাতে।
অ্যান্টিবায়োটিক, দামি স্যালাইন, ব্যথানাশক, স্টেরয়েড এর যথেচ্ছ ব্যবহার, যেনতেন করে ক্ষত সেলাই, দুঃসাহসিক শল্যচিকিৎসা, অসংক্রামক রোগের অযাচিত চিকিৎসা/অপচিকিৎসা, সংক্রামক রোগের অপূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা ইত্যাদি করে গ্রামের মানুষের ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকির অবস্থা তৈরি হয়েছে বহু বছর ধরে। অথচ কেউই এর প্রতিকার বিধানের কোনো প্রচেষ্টা করেনি। এদের অপচিকিৎসার কি কখনো বিচার হয়েছে? কখনোই না।
আবার একজন গরিব অসুস্থ মানুষ উপজেলা হাসপাতালে, ইউনিয়ন সাবসেন্টারে বা কমিউনিটি ক্লিনিকে গেলেন সেবা নিতে। কিন্তু তিনি প্রত্যাশিত সেবা পেলেন না। হয় তার সঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মী বা সেবিকারা দুর্ব্যবহার করলেন, কিংবা যেকোনো সেবার জন্য তার কাছ থেকে প্রয়োজনের বেশি মূল্য নেওয়া হলো। অথবা অ্যাম্বুলেন্সের চালক রোগী নিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন– অব্যবস্থাপনা যেটাই হোক না কেন ভুক্তভোগী কিন্তু কোনো বিচার পান না।
চিকিৎসকেরা এ সময় অসহায় অনুভব করেন। কারণ তিনি একজন সাধারণ ক্ষমতাহীন মেডিক্যাল অফিসার। কেউ তার আদেশ না শুনলে বিধিমালা যাই বলুক প্র্যাকটিকালি তার কিছুই করার নেই। কারণ কর্মচারীরা তাদের কাজের জন্য ব্যবহারিক অর্থে কেবল একজন ইউএইচএফপিও কিংবা সিভিল সার্জনের কাছে দায়বদ্ধ।
আর এসব তথাকথিত প্রশাসনিক পদের আসীন আমাদের স্যারেরা এত দায়িত্বে জর্জরিত থাকেন যে এসব বিচার-জবাবদিহির বোঝা তারা নিতে চান না। আর একজন কর্মচারীর এসিআর-এ (বাৎসরিক গোপনীয় প্রতিবেদন) স্বাক্ষর করেন তারাই। কর্মচারীরা চিকিৎসকদের খুব একটা তোয়াক্কা করার কথা মনে করেন না। তাই কোনো কর্মচারীর অন্যায়কে সহ্য করে নেওয়া ছাড়া একজন সরকারি চিকিৎসকের আর কিছুই করার থাকে না।
দিন শেষে যা হয় তা হলো- নবীন একজন চিকিৎসক যিনি স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন, সেখানে নিজেই ট্রেডিশনের পুতুলে পরিণত হন। এক সময় তিনি উপজেলাপর্যায় ছেড়ে পোস্টগ্রাজুয়েশন বা অন্যান্য কারণে জেলাপর্যায়ে বদলি হন। ফলে অপচিকিৎসা আর অব্যবস্থাপনার আকড় হয়ে পড়ে থাকে উপজেলা/ইউনিয়নপর্যায়ের স্বাস্থ্যখাত। বছরের পর বছরে ধরে এভাবেই চলে এসেছে। এই অন্ধকার কাটেনি আজও।
অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাইলে উপজেলাপর্যায়ে একজন চিকিৎসককে আর 'নিধিরাম সর্দার' করে রাখা চলবে না।
'মেডিকেল অফিসার' পদবির পরিবর্তে উপজেলাপর্যায়ে একজন সরকারি চিকিৎসকের পদের নাম করতে হবে 'উপজেলা চিকিৎসা কর্মকর্তা ও নির্বাহী স্বাস্থ্য ম্যাজিস্ট্রেট'।
কেবল চিকিৎসা প্রদানের জন্য সরকার একজন চিকিৎসককে উপজেলাপর্যায়ে পাঠাননি। চিকিৎসা প্রদানের পাশাপাশি জনগণের স্বাস্থ্যখাতের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি বিষয়ে তিনি তদারকি করার ক্ষমতা রাখবেন। চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ধাপগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিকারে তিনি প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নিতে ও দণ্ড দিতে পারবেন। তাকে ইউএইচএফপিও কিংবা সিভিল সার্জনের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। এই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রতিবিধানে সরাসরি ইউএনও মহোদয় ও স্থানীয় পুলিশ স্টেশনের ওসি তাকে সহযোগিতা করবেন।
দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়, কিছু কিছু পরীক্ষার হলে পরিদর্শককেও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া হয়। অথচ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের মতো এত সংবেদনশীল একটি খাত আমরা প্রায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত রেখে চলেছি।
১৮৯৭ সালে প্রণীত জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট ১৮৯৭ অনুযায়ী ফৌজদারী আইন সম্পর্কে জানা ও তার প্রয়োগের ক্ষমতাই ম্যাজিস্ট্রেসি। এ দায়িত্ব মেডিক্যাল সায়েন্সে অভিজ্ঞ একজন সরকারি চিকিৎসকের হাতে পৌঁছালেই তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের পরিবর্তন আনা সম্ভব।
কোনো চিকিৎসক যদি কোনো কারণে এই অর্পিত দায়িত্ব নিতে না চান, তবে তিনি তা সারেন্ডার করতে পারবেন। কিন্তু উপজেলাপর্যায়ে একাধিক নির্বাহী স্বাস্থ্য ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে হবে।
আমার ঘরের কোথায় ডিফেক্ট আমিই ভালো জানব। বাইরের মানুষ বা অন্য ঘরের মানুষ এসে আমার ঘরের সমস্যা ঠিক করে দিয়ে যেতে পারবে না। ইচ্ছাশক্তি ও বিচক্ষণতা দিয়ে উপজেলাপর্যায়ের স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব ঘটাতে পারেন তরুণ চিকিৎসক কর্মকর্তারা। আসুন এই বৃহৎ ক্যাডারের ঐক্য ও প্রতিভাকে দেশের কাজে নিয়োজিত করার প্রয়াস নিই।
জয়তু বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ।
লেখক: সার্জারি বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট