দাহ্য পদার্থ রাখার অবকাঠামো ছিল না বিএম কনটেইনার ডিপোর

কেমিক্যাল-জাতীয় পদার্থ কিছু নিয়মনীতি মেনে সংরক্ষণ ও পরিবহন করতে হয়। সামান্য ত্রুটি হলেই সেগুলো প্রাণহানির কারণ হয়ে ওঠে। বিএম কনটেইনার ডিপোতে কেমিক্যাল পণ্য সংরক্ষণে ডিপো কর্তৃপক্ষের অবহেলা এবং গাফিলতি ছিল বলে মন্তব্য করেছেন বিস্ফোরক পরিদপ্তর ও রসায়নবিদরা।
বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিএম কনটেইনার ডিপোতে দাহ্য পদার্থ রাখা হয় এটি আমাদের জানানো হয়নি। এ ধরনের পণ্য সংরক্ষণের জন্য বিশেষ ধরনের অবকাঠামো প্রয়োজন। কিন্তু ডিপোতে সে ধরনের ব্যবস্থা ছিল না।'
এদিকে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তর জানিয়েছে, এর আগে ২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকায় ইনকনট্রেড ডিপোতে বিস্ফোরণে ৪ শ্রমিক নিহত হয়। একটি প্রাইম মুভারের ট্যাংক রিপেয়ার করতে গিয়ে ওই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
গত বছরের ১১ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে পি শেডে পড়ে থাকা বিপজ্জনক পণ্যে আগুন লাগে। এসব ঘটনার পরও টনক নড়েনি চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস ও বিস্ফোরক পরিদপ্তরের।
সামাজিক সংগঠক হাসান মারুফ রুমী বলেন, মানুষের জীবনের চিন্তা না করে বিস্ফোরক দ্রব্যের শেড আলাদা না করায় এ ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তর, বন্দর, কাস্টম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর কেউ এ দায় এড়াতে পারে না।
চট্টগ্রাম হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী টিবিএসকে বলেন, 'হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড অত্যন্ত ক্ষয়কারী বিস্ফোরক। এটি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তাপমাত্রা মেনটেইন করে রাখতে হয়। তাপমাত্রায় ঘাটতি হলে কিংবা নড়াচাড়া করতে অসুবিধা হলে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এর ঘনত্বের কারণে এটি স্পর্শ করলেও চামড়া পুড়ে যায়। বড় কনটেইনারে রাখতে গিয়ে ডিপো কর্তৃপক্ষ বিষয়গুলোকে সেভাবে মেজার করেনি। অন্যান্য ক্ষতিকর পদার্থের মতো হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডকে সতর্কতার সাথে রাখা হয়নি। এর ফলে কনটেইনার বিস্ফোরণ হয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।'
এদিকে কনটেইনার পরিচালনায় বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছিল বলে জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, '৩০-৩৫ বছরে এমন ঘটনা আর ঘটেনি। তাই বলা যায়, এটি নিছক দুর্ঘটনা। আমরা ৫ সদস্যদের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ৭ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আমদানি পণ্যের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে আইন রয়েছে। যদি কোনো প্রতিষ্ঠান এমন ক্ষতির মুখে পড়ে তবে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে।
'এজন্য আমরা তদন্ত করব। এছাড়া চট্টগ্রাম কর্তৃপক্ষ, কাস্টমস এবং ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়েও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এটিরও প্রতিবেদনে দেওয়া হবে।'
পোশাক উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি রাকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, 'শুধুমাত্র বিএম কনটেইনার ডিপো নয়, এ ধরনের রাসায়নিক পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরসহ অনান্য বেসরকারি ডিপোতেও রয়েছে। এসব পণ্য সময়মতো খালাস কিংবা নিলামে না তোলার ফলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে আর হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উচিত কেমিক্যাল পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে খালাস এবং রক্ষণাবেক্ষণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা।'
তিনি আরও বলেন, 'এখন আমরা দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা নিয়ে বেশি জোর দিচ্ছি। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে আমরা পরবর্তীতে কাজ করব। পণ্যের ইন্সুরেন্স, বিদেশি ক্রেতাদের সাথে সমন্বয় করে ক্ষতির বিষয়টি কীভাবে সমন্বয় করা যায় সেটি নিয়ে বিজিএমইএ কাজ করবে।'
রাসায়নিক পণ্য নিয়ে আবারো আলোচনায় চট্টগ্রাম বন্দর
বিএম কনটেইনার ডিপোতে কেমিক্যাল বিস্ফোরনে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আবারো চট্টগ্রাম বন্দরে কেমিক্যাল পণ্য নিয়ে ঝুঁকির বিষয়টি আলোচনায় উঠে এসেছে।
ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সর্বশেষ ৫ এপ্রিল প্রস্তুত করা হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বন্দরে ২৫৯ কনটেইনার বিপজ্জনক পণ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৪ সালের পণ্যও রয়েছে। বিপজ্জনক পণ্যের তালিকায় রয়েছে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, সালফেট, সালফিউরিক এসিড, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, থিনার, সোডিয়াম সালফেট, মিথানল, ইথাইল হেক্সানল, নাইট্রিক এসিড, ক্যালসিয়াম অক্সাইডসহ বিভিন্ন রাসায়নিক পণ্য।
এসব পণ্য নিয়ে বিপাকে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিলামে বিক্রি কিংবা ধ্বংস করার জন্য পণ্যগুলো বুঝিয়ে দিলেও বন্দর ইয়ার্ড থেকে সেগুলো সরিয়ে নিচ্ছে না চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরের পর বছর এভাবে রাসায়নিক পণ্য পড়ে থাকায় বড় ধরনের বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। লেবাননের বৈরুত বন্দরের পুনরাবৃত্তি যেন চট্টগ্রাম বন্দরে না ঘটে সেই লক্ষ্যে এসব পণ্যের দ্রুত বন্দর ইয়ার্ড থেকে অপসারণ চায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বিপজ্জনক পণ্য ও পণ্যবাহী কনটেইনার অপসারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে চিঠিও দিয়েছেন। এতে উল্লেখ করা হয় এই বিপজ্জনক পণ্য ও কনটেইনারসমূহ একদিকে যেমন বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করছে, তেমনি বন্দরকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম বলেন, 'বিএম কনটেইনার কর্তৃপক্ষের অবশ্যই উচিৎ ছিল হ্যাজার্ডাস পণ্য আলাদা করে রাখা। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, বাংলাদেশের অন্য ডিপোগুলোতেও হ্যাজার্ডাস পণ্য আলাদা করে রাখা হয় না। হ্যাজার্ডাস পণ্যের জন্য পৃথক আইসিডি প্রয়োজন।'
তিনি আরও বলেন, বিস্ফোরক পরিদপ্তর, কলকারখানা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর যদি ডিপোগুলোতে পরিদর্শনের বাধ্যবাধকতা থাকে তাহলে অবশ্যই ডিপোগুলোতে পরিদর্শন করা উচিৎ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান এবং সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
তদন্ত কমিটি
বিএম কনটেইনার ডিপোর কর্মকর্তা নাজমুল আকতার খান বলেন, '২৪ একর জমিতে এই ডিপো। প্রায় ৪৩০০ কনটেইনার ছিল। ৩০০০ হাজার খালি। ৪৫০ আমদানি ও ৮০০-এর মত রপ্তানি কনটেইনার। রাসায়নিক পণ্যের কনটেইনার আলাদা রাখা হয়। কত রাসায়নিক কনটেইনার ছিল, তা জানা নেই। সরকারের কাছে আহ্বান, পুরো তদন্ত হোক। কী হয়েছে, তা জানা যাবে।
'আমাদের কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনসহ সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটিকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার ঘোষণা দিয়েছে। এটি দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা বা কোনও প্রতিপক্ষ দ্বারা ইচ্ছাকৃত অনিষ্ট সাধন কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।'
বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (চলতি দায়িত্ব) আব্দুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাত স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে সরেজমিনে পরিদর্শনপূর্বক তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
অধিদপ্তরের সহকারী মহিপরিদর্শক শিপন চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে শ্রম পরিদর্শক (স্বাস্থ্য) শুভংকর দত্তকে। আরেক সদস্য হলেন শ্রম পরিদর্শক (নিরাপত্তা) মো. শামীম হোসেন।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, জেলা প্রশাসনের উদ্যোগেও একটি তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে বিএম ডিপোর ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ম্যানেজারকে প্রধান করে ৫ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালে চট্টগ্রামের স্মার্ট গ্রুপ বিএম কনটেইনার ডিপো গড়ে তোলে। শুরুতে প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় স্মার্ট গ্রুপের সঙ্গে নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠানও যুক্ত ছিল। পরবর্তীতে নেদারল্যান্ডের ওই প্রতিষ্ঠান মালিকানা ছেড়ে দিলে একক মালিকানায় আসে স্মার্ট গ্রুপ। গ্রুপটির মালিকানায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প কারখানা স্মার্ট জিন্স, বিএম এলপি গ্যাস। এছাড়া আরএমজি, টেক্সটাইল, এনার্জি, লজিস্টিকস, রিয়েল এস্টেট, লাইফ স্টাইল, ফুড সহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে।
৪ জুন রাতে চট্টগ্রামে সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে কেমিক্যাল বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৪৯ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক।